ভালোবাসা কি মরে যাচ্ছে?

ড. লিপন মুস্তাফিজ

সেপ্টে ১৩, ২০২১ | শিল্প ও সংস্কৃতি

Ended soon

আমার একটা খুব প্রিয় গান আছে “আমার স্বপন কিনতে পারে এমন আমীর কই, আমার জল ছবিতে রঙ মিলাবে এমন আবীর কই”। আমার ধারণা আমাদের প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের এই গানটি শোনেননি। এই গানের ভিতরে এক ধরণের অহংবোধের পাশাপাশি হতাশার বহিঃপ্রকাশ আমি খুঁজে পাই। এই হতাশা দিন দিন আমাদের সবার জীবনে ভর করছে। কি কর্মক্ষেত্রে কি ব্যক্তিগত জীবনে। সেই হতাশা থেকেই সমাজের স্বাভাবিক নিয়মে পড়ছে ছেদ। আমরা জড়িয়ে পড়ছি অনৈতিক কর্মকান্ডে। মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, আমাদের ধনাত্মক এর চেয়ে ঋণাত্মক এর পানে ধাবিত হবার প্রবণতা বেশি। ফলে আমাদের জীবনের আঁকা ছবিতে আমরা রঙ মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছি।

আমাদের সবার ভিতরে একটা নিজস্ব নদী আছে। যখন তখন আমরা তাতে ডুব দেই। পরিষ্কার হয়ে ওঠার চেষ্টায়, পরিশুদ্ধ হবার চেষ্টায়। কিন্তু আবারো আমাদের সারা গায়ে লেগে যায় সমাজের নোংরা পঙ্কিলতা। এভাবেই আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে। বাস্তবতার অতলান্তিকে খাবি খেতে খেতে আমরা আমাদের সততা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি ক্রমশ; হারাচ্ছি মূল্যবোধ। আমরা কি একবারো খুজেছি কেন আমাদের এই পরিবর্তন? আমার কি পরিবর্তন? কেন আমরা সরল রৈখিকভাবে ভাবি না? কেন আমাদের ছুটে চলা? কার জন্য ছুটে চলা? এই চলার শেষ কোথায়?

দিন দিন আমরা নিজেদের কাছে পরাজিত হচ্ছি। নিজেকে আয়নায় দেখি সকালে ঘুম থেকে উঠেই। সারাদিন নিজেকে কিভাবে বিক্রি করব তার জন্য তৈরি হই। প্রস্তুত হই। আপোষ করতে থাকি। কি অফিসে কি বাসায়। একটা সময় তলিয়ে যাই আমরা। আমাদের ভালোবাসা গুলো মরে যেতে থাকে। যান্ত্রিক হয়ে পড়ি। বলতে পারি না আমি বিক্রি হই না। আমাকে কেনার মত এমন আমীর কই। সিস্টেম এর কাছে, এর কারণে, বারবার ধর্ষিত হচ্ছি। যখনই কেউ উঠে বলতে চাইছে “চাই না এই জীবন” সে পেরে উঠছে না। জীবনের রেসে সে আজ ক্লান্ত ঘোড়ার মত। এখন সে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চায়।

আয়ের থেকে ব্যয়ের পাল্লা ভারী হবার কারণে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে প্রতিটা মুহুর্ত। ব্যক্তিক আয় বাড়ছে মাত্র ৫/৬ শতাংশ, কিন্তু বাজারের প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম পূর্বের দামের দ্বিগুণ বা তার বেশী বাড়ছে। আমরা যাব কোথায়, কার কাছে নালিশ দেবো? সবাই একটু ভালো থাকার জন্য শুধু পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোঁটাবার জন্য নিজের চলার পথে বাঁক নিয়ে চলে। এই ভালো থাকা নিজের কাছে? নাকি অন্যের কাছে ভালো থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা। এর ব্যতিক্রম খুঁজে পেতে আজকাল মাইক্রোস্কোপগুলোও কাজ করছে না।

একটা সময় আমরা স্বপ্ন দেখেছি, বেতন একটু বাড়লেই স্ত্রীকে একটা সোনার চুড়ি গড়িয়ে দেবো, বাচ্চাদের দেবো ভালো জামা কাপড়। এই চিন্তা থেকে আমাদের এখন সরে আসতে হয়েছে দিন বদলের দিনে, এখন ভালো মোবাইল আর ভালো রেস্তোরার কাছে সোনার চুড়ি হার মেনেছে। জয়ী হয়েছে বাইরে ঘোরাঘুরি। এমনকি করোনার কারণেও এর কোন ঘাটতি দেখি না। চেনা অচেনা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপসহ সবাই সোচ্চার আজ বাইরে যাবার জন্য। মানুষ আর ঘরে থাকতে চায় না। হয়ত সামনে এমন একটা সময় আসবে, রফিক আজাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে সব ভেঙ্গে এক লাইনে এসে বলবে ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব।

একটা সময় কারণে অকারণে মামা চাচাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হতো, হোক সেটা একই শহরে বা ভিন্ন শহরে। হোক সেটা এক দিন বা দুই দিনের জন্য। সেটাও আজ হারাতে বসেছে। দিন দিন আমরা নিজেদেরকে এক ঘরে বন্দী করছি। নিজেদের পরিবারে সহনশীলতা কমতে কমতে আজ মুখ দেখাদেখি বন্ধ ভাই-বোনেদের। ক্রেডিট কার্ডের সহজলভ্যতার জন্য আমরা অনায়াসে নিজের সামর্থ্যের বাইরে খরচ করছি। ফলে আমাদের ধার দেনা বাড়ছে। ন্যায়, নীতির সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়ছে আমাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ভিত্তি। ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক বন্ধন। এই আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। আবার আমরা অতীতকে ভুলতে পারছি না। বার বার একই গান গেয়েই চলেছি। সব ভুলে, উদার মানসিকতা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যাবার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সময় এসেছে ডাক দেবার, নতুন প্রজন্মকে কাজে লাগাবার। এদের স্বপ্নকে উস্কে দেবার সময় এখনই।

আমাদের সামগ্রিক চিন্তা ভাবনা করে বের করতে হবে, আমি একা ভালো থেকে কি লাভ! আমাদের আশেপাশের মানুষকে সাহায্য করতে হবে। সবাইকে নিয়ে ভালো করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। টেকসই উন্নয়ণের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে দেশকে এগিয়ে নেবার জন্য আমাদের স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে নেয়া পরিকল্পনা গুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট থাকা দরকার। আর দরকার আমাদের কাজের প্রতি সম্মান ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনা। অফিস আদালতে সহকর্মীকে সম্মান করা, বিশেষ করে নারী সহকর্মী। আবার নারী সহকর্মীদেরও উচিৎ তাদের এই সুযোগের অপব্যবহার না করা। অনেক সময় অফিসে পুরুষ কর্মীদেরও হেনস্তা হতে হয়।

কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এনডিসিয়া পোর্টালটি আমাদের সবার কথা বলবে, আমাদের মনের ব্যথা বুঝবে, উন্নয়নের বিন্দু বিন্দু জল আমাদের সবার কল্যাণে কি করে কাজে লাগানো যাবে! কি করে হতাশা থেকে আমাদেরকে ফিরিয়ে আনবে! আমাদের প্রত্যাশার পারদ স্থির রাখার জন্য নানান লেখক তার লেখার মাধ্যমে আমাদের আলোকিত করবে। সমাজ ব্যবস্থার কারণে আজ আমাদের হীরক রাজার দেশের প্রজার মত শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়াতে হচ্ছে। আর নচিকেতার মত গলা ছেড়ে বলছি “এই বেশ ভালো আছি”। আর গোপনে আমরা আমাদের মনের মত মানুষ খুঁজে ফিরছি। যার সাথে মনের সব কথা অকপটে বলতে পারি। সারাদিন পেটের ভেতরে জমে থাকা কথা গুলো হজম করার জন্য। কিন্তু পারছি কই? পাচ্ছি কি? চারিদিকে কল্পনার নদী আজ শুকিয়ে যাচ্ছে, মনের গহীনে লালিত যে বাগান, সেই বাগান আজ মৃতপ্রায়। আমরা গোট্যের মত বসে আছি। কে আসবে আমাদের জীবনে? হ্যাঁচকা টান মেরে বলবে, এসো! আমার সাথে চল। ক্যালকাটা ইয়্যুথ কেয়ার এর মত গাইতে বলবে “একদিন স্বপ্নের ভোর, এক দিন সত্যের ভোর”।

হয়ত এই পোর্টাল আমাদের সাহায্য করবে হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে। বলবে, না বলা কথা। এই পোর্টাল কি পারবে আমাদের চাঙ্গা করতে? নতুন এই পোর্টাল আমাদের সেই পথ দেখাবে? কি করে চাঙ্গা করা যায়, সেই পথে হাঁটা যায়। শিল্প সাহিত্য, খেলাধুলা, রাজনীতিসহ আমাদের সবার মনের কথা বলবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি । এই প্রজন্মের হাত ধরেই আমরা এগিয়ে যাব অনেক দূরে। আমরা আমাদের চিন্তার ফলাফল দেখতে পারব নতুন লেখার মাধ্যমে। শুধু পথ চলার শুভ কামনা থাকবে, এই কামনা করছি না। আমি চাইব তাদের নতুন চিন্তা আর আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের এক আশার আলো হয়ে সমাজের দিক নির্দেশনা হয়ে কাজ করবে। বাংলাদেশের জয় হবে। উন্নয়নের সূচক একটা সময় স্থির হবে। আমরা হব সবার চোখের মণি। সুখ ও শান্তিতে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করতে পারবে। একজন লেখক হিসেবে নতুন পোর্টাল এনডিসিয়া২৪ এর কাছে এই প্রত্যাশা করতেই পারি।

ভালোবাসা কি মরে যাচ্ছে ? আমাদের ভালোবাসাকে কোন ভাবেই মরতে দেয়া যাবে না। বাঁচিয়ে রাখতেই হবে, যেকোন মূল্যেই।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন