এক মেঘের গল্প

চৌধুরী আব্দুল হাই
উন্নয়নকর্মী ও লেখক

মে ১০, ২০২২ | প্রবাসের গল্প

Ended soon

প্রথমেই বলা প্রয়োজন এটা আমার লেখা না। মেঘ নামের একটা স্পেশাল বাচ্চার মা মনিরা সুলতানা পাপড়ি ও হাবিবুর রাসেদ পলাশ এর বিভিন্ন লেখার একটা সার সংক্ষেপ মাত্র। ওরা এখন সুইডেন প্রবাসী। ২০১৫ সালে হঠাৎ মেঘকে দেখে পলাশকে মেঘের কথা জিঞ্জেস করলে পলাশ ইনবক্সে জানায় আমার মেঘ (আমার বড় ছেলে) এর প্রবলেমটা Neurological. টার্ম টা হচ্ছে CP (Cerebral Palsy)। তার ব্রেইন এর কিছু নিদৃষ্ট সেল নষ্ট অথবা ক্ষতিগ্রস্থ, যেগুলোর কাজ হচ্ছে Muscle Coordination আর Motor Movement। যে কারণে সে দাঁড়াতে বা হাটতে পারে না। এমনকি পুরোপুরি বসতেও পারে না। কোন কিছু ঠিকমতো ধরতেও পারে না। সেল গুলো নষ্ট থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে যে বিষয়গুলো শিশুরা শিখে যায় তা তাকে প্র্যাক্টিস করিয়ে শেখাতে হচ্ছে। শেখার গতি খুব ধীর। বটমলাইন হচ্ছে এ থেকে পুরোপুরি কিউর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। মেডিক্যাল সাইন্স অনুযায়ী তাকে হয়তো একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব না। তার যখন ৬ মাস বয়স তখন রোগটা ধরা পরে। এই রোগের আরেকটা ফিচার হচ্ছে – যদিও এর উৎপত্তি ব্রেইন এ, তবুও তার মানসিক কোন অস্বাভাবিকতা নাই। সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে, তার আচরণ যৌক্তিক এবং সম্পূর্ন মানবিক। তার অসুস্থতা সম্পর্কে সে পুরোপুরি সচেতন এবং সুস্থ হয়ে উঠার আকাঙ্খা তার প্রচন্ড। ডাক্তার তার ইন্টিলিজেন্স লেভেল কাউন্ট করেছে এবং আমাদের কে জানিয়েছে যে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বয়সের তুলনায় অনেক বেশী।

তার স্বরণশক্তি অসাধারণ। খুব বেশী অসুবিধা না হলে সে কারো হেল্প চায় না। বেশিরভাগ সময় এক জায়গায় শুয়ে থাকলেও কোন কমপ্লেইন করে না। হঠাৎ হঠাৎ হয়তো বলে বাবা আমাকে একটু নিচে নিয়ে যাও! এটাই তার বিনোদন। ধর তার পা চুলকাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সে চেষ্টা করে নিজে চুলকানোর, একান্তই না পারলে তখন বলে ‘বাবা একটু কষ্ট করে আমার পা চুলকিয়ে দিবা?’ এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিও-থেরাপী/ব্যায়াম। একজন থেরাপিস্ট প্রতিদিন বাসায় এসে এক ঘন্টা ব্যায়াম করায়, এজন্য প্রতিদিন পে করতে হয় ১০০০ টাকা। রাতে আমি আবার এক ঘন্টা ব্যায়াম করাই। প্রতিটা ব্যায়াম অনেক কষ্টকর, বিশেষ করে তার বয়সী একটা বাচ্চার জন্য। কিন্তু সে সচেতনভাবেই এই কষ্ট মেনে নেয়। প্রায়ই বলে আমি কি মগ্নর (আমার ছোট ছেলে) মতো হাটতে পারব বাবা? ফুটবল খেলতে পারব? সাইকেল চালাতে পারব? আমি তখন উত্তর দিই ভাল করে ব্যায়াম করলে ইনশাআল্লাহ পারবা। সে তখন আরো বেশী পরিশ্রম করে, চেষ্টা করে। আমি যখন প্রথম ছোট ছেলের জন্য সাইকেল কিনে আনি তখন মেঘ কে বলেছিলাম এটা তোমাদের দুই ভাইয়ের জন্য। মেঘ উত্তর দিয়েছিলো বাবা আমি তো হাটতে পারিনা, মগ্নই এটা চালাক, আমি দেখব কিভাবে ও চালায়!’ ছেলেটা কাঁদে না মোটেও, সবসময় হাসিমুখে থাকে। কোন খাবার দিলে জিজ্ঞেস করে তোমরা খেয়েছ? মগ্ন খেয়েছে? হামিদা (কাজের মেয়ে) খেয়েছে? এই হচ্ছে আমার বড় ছেলে, I am really proud to be his father. Finally, let me explain the reason of this disease – সম্ভাব্য কারণ গুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে জন্মের সময় ডাক্তারের অবহেলা। প্রথম শ্বাস নিতে যদি দেরী হয় সেক্ষেত্রে অক্সিজেন এর অভাবে ব্রেইন এর সেল গুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এটাকে বলে birth asphyxia. ডাক্তার হয়তো জন্মের পর পিঠে চাপর দিতে একটু দেরী করে ফেলেছিল। ল্যাব-এইড এ ওর জন্ম হয়েছিল। আমি সবচেয়ে ভাল কেবিন, ভাল ডাক্তার এর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু আরেকটা সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে Hypo-glycaemia (ব্লাড সুগার কম থাকা)। জন্মের পর ওকে সুগার ইনজেক্ট করতে হয়েছিলো। কিন্তু প্রথম দুইদিন তাঁরা ধরতেই পারে নি যে, তার ব্লাড সুগার কম! আমরা প্ল্যান করেছিলাম আর কোন বাচ্চা না নিতে। আমাদের ভয় ছিলো যদি কোন কারনণ মেঘ এর প্রতি অবহেলা প্রকাশ পেয়ে যায়! কিন্তু ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলো আরেকটা বাচ্চা নেয়ার। কারণ একটা সুস্থ বাচ্চার সঙ্গ মেঘ এর জন্যই দরকার। একারণেই দ্বিতীয় বাচ্চা নেয়া। আল্লাহর রহমতে দুই ভাইয়ের মধ্যে অনেক মিল। আমাদের জীবনের এখন একটাই টার্গেট যদি কোনভাবে মেঘকে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। আমাদের একটা স্পেশাল বেবি আছে এজন্য কোন দুঃখ নাই। কিন্তু ছেলেটার কষ্ট দেখে কষ্ট হয়, মায়া হয়।

মেঘের মা পাপড়ির ইদানিং কালের একটি লেখা থেকে আরও জানা যায়, মেঘ এর টোটাল চেয়ার আছে ৫টা, আর আছে একটা স্ট্যান্ডিং ফ্রেম এবং একটা লিফট। একটা চেয়ার চলাফেরার জন্য, একটা তার কাজ করার জন্য,বা পড়াশোনার জন্য। একটা শাওয়ার নেয়ার জন্য, একটা টয়লেটের জন্য। একটা চেয়ার আধ শোয়া অবস্থায় তার পায়ের পজিশনের জন্য। বাসা সি সি ক্যামেরা কাভারড,যাতে আমি যদি ঘুমিয়েও পড়ি, আমার হাজব্যান্ড খেয়াল রাখতে পারে। ক্যামেরার মাইক্রোফোনে বাবা ছেলেকে চিয়ার আপ করছিলো। বাচ্চাদের শুধু মা না, বাবার কেয়ার ও লাগে। একটা চেয়ার থেকে আরেকটা চেয়ারে প্রতিদিন নামাতে কতোটা কাঠখড় পোড়াতে হয়, কতোটা পরিশ্রম হয় শুধু সেই মায়েরা জানবে যার সন্তান হুইল চেয়ারে। আমাদের দেশে তো লিফট ও ব্যবহার করতে পারেনা মায়েরা। তাহলে তাদের মেরুদন্ডের কি অবস্থা, কল্পনা করুণ। আর এমন একটা স্পেশাল বাচ্চা থাকলে মায়েদের নিজের দিকে তাকানোর সময় কই। ত্রিশ এর পর সব মেয়েদের ক্যালসিয়াম ইনটেক নেয়া উচিৎ, যাতে হাড়ের ক্ষয় রোধ করা যায়। ক্যালসিয়াম তো দূর কি বাত, স্পেশাল নিড বাচ্চার মায়েদের তো নিজের চুল আঁচড়ানোর সময় হয় না। আর তাদের মেন্টাল হেলথ? পরিবারের বাকি মানুষেরা কি ভাবে, কেমন বোধ করছে মায়ের শরীরের খাঁচায় আটকে থাকা অসহায় মানুষটা? কষ্ট সবার হয়, ক্লান্তি সবার লাগে, আরাম সবার অধিকার। তাই না?  

পাপড়ি আরও লিখে – Empathy শব্দটা, সেই শব্দ যা আমাদের অধুনা বাংগালী সমাজে সবচেয়ে এলিয়েন শব্দ, সবচেয়ে না বোঝা শব্দ। সবচেয়ে কম চর্চিত শব্দ। আমরা অনেকেই হয়তো Sympathy এবং Empathy শব্দ দুটোকে গুলিয়ে ফেলি। গুলানোর কারণ ও আছে। কারণ এব দুটো শব্দের অর্থই বাংলায় “সহানুভূতি।” “সহানুভূতি” শব্দটা কে যদি একটু ব্যবচ্ছেদ করি তাহলে দেখি সহ+অনুভূতি। মানে হলো, কারোর অনুভূতির সাথে আমি সহাবস্থান করছি।  মজার ব্যপার হলো বাংলায় একই অর্থ দেখালেও, ইংরেজিতে শব্দ দুটো আলাদা এবং এদের অর্থও কিন্তু কাছাকাছি হলেও বেশ মোটা দাগের আলাদা। Sympathy হচ্ছে – আমার কোন সিচুয়েশনে বা কোন সমস্যায় বা কোন ইস্যুতে কেউ সহমর্মিতা দেখাচ্ছে কিন্তু সে তার নিজের ধ্যান ধারণা এবং বিচার-বুদ্ধিতে অটল থেকে সহমর্মিতা জানাচ্ছে, যেমন: ধরুণ আমার খুব বড় ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে, কেউ আমাকে ম্যাসেজ পাঠালো বা দেখা হলে বললো, তোমার লস এর কথা আমি শুনেছি, খুব খারাপ লেগেছে, ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে সব। 

Empathy হচ্ছে- আমার কোন সিচুয়েশন বা দুর্দশায় বা কোন ঘটনায় কেউ একজন নিজেকে আমার জায়গায় রেখে আমাকে কোন জাজ করা ছাড়া আমার মতো করে ভেবে সহমর্মিতা জানাচ্ছে, যেমন: আমার ব্যবসার ক্ষতি শুনে কেউ একজন দেখা করতে এলো, ডিটেইলস জানতে চাইলো, কিছু সৎ পরামর্শ দিলো বা আমার সাথে কিছুটা সময় কাটালো এবং আমাকে একা হতে দিলো না, আমাকে বোঝালো এমন হয়, তার সাথেও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিলো। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে, যদি কোন মোরাল সাপোর্ট লাগে সে আমাকে সেটা দেবে। লম্বা লেখা লেখছি। কিছু কথা ছোট করে বলা যায় না। অসম্পূর্ণ থাকে৷ আমাদের চারপাশে আমরা সবাই সবাইকে শুভকামনা জানাই, কন্সার্ণ জানাই, উপদেশ দেই। আসলে জাতি হিসেবে আমরা উপদেশ দেয়ার ব্যপারে ব্লেসড। আমি নিজেও দেই। তবে চেষ্টা করি তাকেই উপদেশ দেয়ার যে উপদেশ চায় আমার কাছে।  ধরুণ আমার সন্তান হয়েছে মাস খানেক হলো, আমি কোন দাওয়াতে গেলাম, আমাকে সবাই উপদেশের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, এই কোরো, সেই কোরো না। এভাবে করবে ওভাবে না। সবার উদ্দেশ্য ভালো। সবাই আমার ভালো চায়, জানি। এটা সিমপ্যাথেটিক বিহেভিয়ার। কিন্তু যেহেতু আমি মা। এবং সৃষ্টিকর্তা মা-কে এভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণ বানিয়েছেন, একেবারে কিছু না জানলেও না বুঝলেও সন্তানের লালন পালন এর বেসিকটা সে বোঝে, প্রকৃতি তাকে এভাবেই বানিয়েছে। তাই একসাথে এত গুলো উপদেশ আসলে আমার নেয়ার মতো মানসিক অবস্থা আছে কিনা, প্রয়োজনে আছে কিনা এটা বোঝা এবং সে অনুযায়ী আমাকে মোরালি সাপোর্ট দেয়া, কখনো কখনো কিছু না বলেও পাশে থাকা যায়, বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দেয় কে আমার পাশে থাকতে চায়, এরকম সহমর্মিতা হলো এম্প্যাথি। যে ধরেই নেবেনা যে আমি জানিনা, বরং আমার অবস্থান এবং অবস্থা বুঝে আমাকে সাপোর্ট দেবে। কিংবা কেউ একজন তার সন্তান নিয়ে বা পারিবারিক বন্ডিং নিয়ে একটা পোস্ট দিলো। খুব আদুরে, আবেগী পোস্ট। খুব টাচি। কিন্তু পোস্টে কিছু বানান ভুল।কিংবা পোস্টের খুব ছোট কোন বিষয় আমার ভালো লাগলোনা বা কনফিউশান হোলো বা মনে হোলো inappropriate, এবং আমি ঝাপিয়ে পড়ে কমেন্ট সেকশনে গেলাম তাকে জ্ঞান দিতে। এটা একধরণের Toxic Simpathy।  আমি যদি সত্যিই তাকে কেয়ার করি, তাহলে তাকে ইনবক্সে বলবো, খুব সাবধানে বলবো যাতে হার্ট না হয়। চেষ্টা করা উচিৎ, না বলতে। কারণ একটা ছোট ভুলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা। কিন্তু আমার নিজের জ্ঞান জাহির করার ক্যারদানিতে তার সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট হয়ে যাবে। এই যে চিন্তাটা, তার আবেগের জায়গাটাকে বোঝার চেষ্টা করে, জাজ না করে মূল ম্যাসেজটা বা কন্টেন্টটাকে এপ্রেশিয়েট করা, এটাই Empathy. আমরা কাউকে জ্ঞান দেবার লোভে ভুলে যাই সবার আমার দেয়া জ্ঞান এর দরকার নেই। সব জায়গায় আমার অপিনিয়ন প্রয়োজনীয় না। The world is already full of opinions, and it will run super good without my one…!

লেখাগেুলো পড়ে পাপড়িকে বললাম, তুমি এসব কেন অপেনলি প্রকাশ করো? বলল ভাই, আমি এই পোস্ট গুলো শেয়ার করি এওয়ারনেস এর জন্য, একজন মানুষ ও যদি স্পেশাল নিড মানুষের ব্যপারে,তাদের পরিবারের ব্যপারে চিন্তাশীল হয়,কাইন্ড হয়,সেজন্য।

পাপড়ির কথা শুনে আশ্চর্য় হই। স্পেশাল নীড বাচ্চাদের বিষয়গুলো লুকানোর একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। আর সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কার কুচিন্তা তো আছেই। এর মাঝেও পাপড়ি ও পলাশ যেভাবে মেঘের বিষয়টি ইচ্ছাকৃত ভাবে নিয়মিত সবার সামনে নিয়ে আসে তা খুবই বিরল যা ওদের মহানুভবতার প্রকাশ।

প্রিয় মেঘ হউক আমাদের জন্য প্রচন্ড উত্তপ্ত গরমের প্রশান্তি। মেঘ -মগ্ন -পাপড়ি -পলাশ পরিবার ভাল থাকুক।  

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন