Ended soon
১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তার করেন। এর পর থেকে যুগ যুগ ধরে ঢাকাকে নিয়ে রচিত হয়ে চলেছে ইতিহাস। শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকা বিস্তৃত লাভ করে পশ্চিমে জাফরাবাদ-মিরপুর, পূর্বে পোস্তগোলা, উত্তরে টঙ্গী আর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তো ছিলই। শহর উন্নয়ের লক্ষ্যে মোগলরা বিভিন্ন স্থাপনা যেমন রাস্তাঘাট, সাঁকো, প্রবেশদ্বার, মসজিদসহ বেসামরিক স্থাপত্যও তৈরি করেছিল। মোঘলদের কিছু স্থাপত্যের মাঝে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত “সাত গম্বুজ মসজিদটি”।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল জাফরাবাদ গ্রামে, নদীর তীর ঘেষে। নদীটি বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ইতিহাসের এই সূত্র ধরে অনেকে বলে থাকেন মোহাম্মদপুর এলাকার নাম একসময় জাফরাবাদ ছিল। তবে প্রকৃতির সেই জৌলুস আর নেই, নেই সেই খোলা প্রকৃতি ও সৌন্দর্য। সাত গম্বুজ মসজিদটি যে মোগল আমলেই নির্মিত তা তার সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলী দেখলেই বোঝা যায়। মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোণায় জুড়ে থাকা একটি করে অণু-গম্বুজ মিলিয়ে একে সাত গম্বুজ মসজিদ বলা হয়। একসময় দূর থেকে দেখলে অণুগম্বুজ বা মিনারগুলোকেও গম্বুজই মনে হতো। মোহম্মদপুরে কোথায় সাত গম্বুজ মসজিদটি অবস্থিত তা অনেকেই জানে না, তাদের জন্যে একটু বলে রাখা ভালো, ঢাকার মোহাম্মদপুরের কাটাসুর থেকে শিয়া মসজিদের দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে বাঁশবাড়ী হয়ে। এই রাস্তাতেই যাওয়ার পথে পড়বে সাত গম্বুজ মসজিদ।
সাত গম্বুজ মসজিদ ভিডিওতে জানতে ক্লিক করুন
পূর্বে মসজিদটির আশে পাশে যখন উঁচু দালান কোঠা ছিলো না তখন মসজিদটিকে দূর থেকে দেখতে অনেকটা তাজমহলের দেখাতো। তাই স্থানীয় লোকজন অনেকেই একে ‘তাজমহল মসজিদ’ বলে ডাকতেন। আশেপাশে যখন কোনো বাড়িঘর ছিল না। তখন এটিই ছিল ঢাকায় চোখে পড়ার মতো উঁচু স্থাপনা, যা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যেত। তখন মিরপুর ব্রিজে দাঁড়ালে এটি দিব্যি দেখা যেত। মসজিদের পাশেই নদীঘাটে বড় বড় নৌকা এসে ভিড়তো। বর্ষায় পুরান ঢাকা থেকে মানুষজন নৌকা ও আর শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মসজিদটিতে মানুষজন নামাজ পড়তে আসতেন।
জানা যায়, ১৮১৪ সালে স্যার চার্লস ডি ওয়াইলির (ঢাকায় অবস্থানকাল ১৮০৮-১৮১১) আঁকা একটি চিত্রকর্ম আছে এই সাত মসজিদকে ঘিরে; যার শিরোনাম— গঙ্গার শাখা নদী বুড়িগঙ্গার তীরের মসজিদটি। এতে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর পাশেই মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বুকে বয়ে চলেছে নৌকা। ১৯৭৪ সালেও মসজিদটির চারপাশটা পানিতে তলানো ছিল। অনেকে তখন মসজিদের রেলিংয়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন। রেলিংটা ছিল মাটি থেকে অনেক ওপরে। এখন অবশ্য মাটি থেকে হাঁটুর উপরে রেলিং। তখন মসজিদটি মাটি থেকে তিনতলা সমান উঁচু ছিল। এখন মাটি থেকে বরাবর হেঁটে মসিজদে প্রবেশ করা যায়। সে-সময় মসজিদের আশেপাশে একটিমাত্র মাটির পথ ছিল। এখনকার মতো মানুষের ভিড় ছিল না। একেকবার মাত্র পাঁচ থেকে জনা সাতেক লোকের চলাচল দেখা যেত। মসজিদের পূর্বপাশে এরই অবিচ্ছেদ্য অংশে হয়ে রয়েছে একটি সমাধি। কথিত আছে, এটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি। সমাধিটি ‘বিবির মাজার’বলেও খ্যাত। এ কবর কোঠাটি ভেতর থেকে অষ্টকোনাকৃতি এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোনাকৃতির।
আরও পড়ুন: অপূর্ব কারুকাজের নির্মাণশৈলী পাগলা বড় মসজিদ
তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ঢাকা তার রাজধানীর মর্যাদা হারানোর ফলে এবং নতুন রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থাপিত হওয়ায় ঢাকা ধীরে ধীরে তার জৌলুস হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। ফলে অন্যান্য মোগল স্থাপনার ন্যায় মসজিদগুলোও দুরাবস্থায় পতিত হয়। এছাড়া, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজরা পূর্বের শাসকগোষ্ঠীদের স্থাপনাসহ সবকিছু এক ধরনের উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখতো। এভাবেই স্থাপনা গুলো আস্তে আস্তে অরক্ষিত হয়ে পড়ে।