জল-জ্যোৎস্নায় মোহনীয় সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর| হাওর ট্যুরিজম (পর্ব -৩)

চৌধুরী আব্দুল হাই
উন্নয়নকর্মী ও লেখক

এপ্রি ২৫, ২০২২ | ইতিহাস ও ঐতিহ‌্য

Ended soon

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় অবস্থিত টাংগুয়ার হাওড় বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রুপ জলমহালগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তারিহপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ। মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের ২য় রাসমার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাংগুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬,৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া, বন হিজল করচ বনসহ বষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০,০০০ একর।

টাংগুয়ার হাওড় প্রকৃতির অকৃপন দানে সমৃদ্ধ। এ হাওর একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরনেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারী। হিজল করচের দৃষ্টি নন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়্ এ ছাড়াও নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলফা, শতমুলি, শীতলপার্টি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দু’শ প্রজাতিরও বেশী গাছগাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। জেলা প্রশাসনের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহনের ফলে বর্তমানে এ হাওরে রয়েছে ছোট বড় ১৪১ প্রজাতির ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। নলখাগড়া বন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। শীত মৌসুমে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার পাওড়। বিলুপ্ত প্রায প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে-কিংষ্টক, শকুন এবং বিপুল সংখ্যক অতিথি পানি ছিল টাঙ্গুয়ারহাওরের অবিস্মরণীয় দৃশ্য। স্থানীয়জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেমা, বৈদর, ডাহুক নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমহারও বিস্ময়কর। সাধারণ হিসাবে বিগত শীত মৌসুমের প্রতিটিতে ২০/২৫ লক্ষ পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে ছিল বলে অনুমান করা হয়। কোন কোন স্থানে কিলোমিটারের বেশী এলাকা জুড়ে শুধু পাখিদের ভেঙ্গে থাকতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখী এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম। মাছের অভয়াশ্রম হিসাবে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী।

টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির হাওর ও অন্যতম সুন্দর, বড় ও জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হাওর। পরিযায়ী পাখি আর দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য এ হাওর সুন্দরবনের পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট। বছরের সব সময়ই এ হাওরে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে তবে শীত আর বর্ষা, এ দুই সময়ে বেড়ে যায় বহু গুণ । ‘হাওর কন্যা’ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিশাল জায়গা জুড়ে এ হাওরের রাজত্ব। সুনামগঞ্জের ছোট-বড় প্রায় ১২০ টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত টাঙ্গুয়ার হাওর। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। এছাড়াও এ হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষা মৌসুমে সব খাল, বিল ও নালা মিলেমিশে একাকার হয়ে রূপ নেয় এক বিশাল সমুদ্রের। তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার ২ লক্ষ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি।

টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে ভিডিওতে জানতে ক্লিক করুন

টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের অভয়ারণ্য বা ‘মাদার ফিশারিজ’। এ হাওরে আছে প্রায় ১৪১ প্রজাতির বেশি স্বাদু পানির মাছ। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায়ই দেখা মেলে বিরল প্রজাতির প্যালাসার ফিশ ইগলের। টাঙ্গুয়ার হাওরের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষা মৌসুমে এ হাওরের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে থাকে আর শীতের শুরুতে ধীরে ধীরে পানি কমতে শুরু করে। শীতে হাওরের পানি তলানিতে ঠেকে। তখন হাওরের বড় একটা অংশই শুকিয়ে যায়। গাছ, মাছ, পাখি আর প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্যের আধার এই হাওর পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের জন্য বর্ষাকালকে আদর্শ সময় ধরা হলেও অনেকেই অতিথি পাখি দেখার জন্য শীতকালেও হাওরে ঘুরতে যান। এছাড়া পূর্ণিমা রাতে জল-জ্যোৎস্নায় মোহনীয় সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে উঠে টাঙ্গুয়ার হাওর।

পর্যটকদের ভাষ্য মতে বর্ষায় এ হাওরের রূপ থাকে অন্যরকম। বর্ষায় দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির দূর থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচ গাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রাম গুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড় আর পাহাড়ের পাদদেশে হাওর পারে স্বাধীনতা উপত্যকা, শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী ডিসি পার্ক। হাওরে ঘেরা এ অঞ্চলে সারাদিনই আকাশে শুভ্র মেঘের ওড়া উড়ি চলে। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে হাওরের জল। তখন পুরো এলাকাকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। শীতের মৌসুমে হাওরে জল কম থাকায় পায়ে হেঁটেই হিজল ও করচ বাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। এ সময় টাঙ্গুয়ার হাওর দেশি ও পরিযায়ী পাখির অন্যতম বড় অভয়ারণ্য। হাওরে সবচেয়ে বেশি পাখি দেখা যায় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে।

প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যান। একসময় মনে করা হতো এই হাওরে শুধু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে থাকার জন্য আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকা প্রচলিত হওয়ায় এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অনায়াসে এই হাওর ঘুরে আসা সম্ভব। এছাড়া পুরো হাওরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। টাঙ্গুয়ার বেড়াতে গেলে পর্যটকদের আরও এক দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাওরের পাশ দিয়েই বয়ে যাওয়া অনন্য সুন্দর ‘জাদুকাটা’ আর ‘পাতলাই’ নদী। হাওর ভ্রমণের পাশাপাশি পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এ দুই নদী। এই দুটি নদীর পানি যেমন টলটলে, তেমনি এর দুই পাশের দৃশ্যও অনন্য সুন্দর। জাদুকাটা নদী ধরে চলে যাওয়া যায় ভারত সীমান্তবর্তী বারেকের টিলায়। আর জাদুকাটা তীরের বিশাল শিমুল বাগানও ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ফুলে ফুলে ভরা থাকে।

কিভাবে যাবেন টাঙ্গুয়ার হাওরে

টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে সুনামগঞ্জ জেলায়। ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক পথে সুনামগঞ্জে যাওয়া যায়। এছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেট হয়ে সেখান থেকেও সহজেই সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর যেতে হবে অটো রিকশায় বা লেগুনায়। এ ছাড়া এ পথে মোটরসাইকেলেও যাত্রী আনা নেয়া করা হয়৷ তাহেরপুরে থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের জন্য নৌকাই প্রধান মাধ্যম হওয়ায় এ স্থানে বিভিন্ন রকম নৌকা ভাড়ায় পাওয়া যায়। এ নৌকাগুলো সাধারণত টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল প্রবেশমুখ গোলাবাড়িতে নোঙ্গর করে। হাওরের ভেতরের পাখির অভয়ারণ্যে কোনো ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালানোর অনুমতি নেই। তাই সেখান থেকে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোট নৌকা ভাড়া করতে হবে।

বর্ষাকালে শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পীট বোট যোগে সরাসরি টাঙ্গুয়া যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘন্টায় এবং স্পীট বোটে ২ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ইঞ্জিন বোটে খরচ হয় ২,০০০/- থেকে ২.৫০০/- টাকা পক্ষান্তর স্পীড বোটে খরচ হয় ৭,৫০০/- থেকে ৮,০০০/- টাকা। বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় সেখানে রাত্রি যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই তবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ৩ কিঃমিঃ উপর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজে অবস্থান করা যায়্ গ্রীষ্মকালে শহরের সাহেব বাড়ি খেয়া ঘাট পার হয়ে অপর পার থেকে প্রথমে মোটর সাইকেল যোগে ২ ঘন্টায় শ্রীপুর বাজার/ডাম্পের বাজার যেতে হয়। ভাড়া ২০০ টাকা। সেখান থেকে ভাড়াটে নৌকায় টাঙ্গুয়া ঘরে আসা যায় । সেক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ ব্যয় হতে পারে ৩০০-৪০০ টাকা। শহুরে যান্ত্রিক ব্যস্ত জীবন থেকে একটু রেহাই পেতে অবসরে ঘুরে যেতে পারেন টাঙ্গুযার হাওর থেকে।

আরও পড়ুন: রাধা রমন দত্ত : হাওরের ধামাইল গানের জনক 

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন