Ended soon
বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও ব্যবহার বর্তমান সভ্যতাকে ভার্চুয়াল দুনিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। ভার্চুয়াল রিয়্যেলিটিতে বিশ্ব এখন নিমজ্জিত। ভার্চুয়াল রিয়্যেলিটির অন্যতম মাধ্যম – ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগ প্রভৃতি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। এগুলোকে বলা হচ্ছে౼ ‘নিউ-মিডিয়া’। বর্তমান সময়ে এই ‘নিউ-মিডিয়া’ গ্রাস করে চলেছে প্রচলিত গণমাধ্যমকে। ‘নিউ-মিডিয়া’ মূলত অনলাইন নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যম। মূলধারার মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন বা হাল আমলের অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে অন্য যে মাধ্যমগুলো রয়েছে সেগুলোই ‘নিউ-মিডিয়া’। ‘নিউ-মিডিয়া’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফরমেটের দিক থেকে ডিজিটাল আর ইন্টারনেট নির্ভর। যেমন- ফেইসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, ব্লগ প্রভৃতি। ‘নিউ মিডিয়া’য় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন নতুন প্লাটফর্ম ও টুলস তৈরি করছে বিস্ময়কর সব বৈচিত্র্য। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৪শ ৫৭ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিমিনিটে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটির অধিক মানুষ ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের এই সংযুক্তির হার প্রতিবছর ৯% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে করা এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়- নেটিজেনরা দিনে গড়ে প্রায় ১৪৪ মিনিট ব্যয় করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, প্রতিদিন টুইট করা হয় প্রায় পঞ্চাশ কোটি। মিনিটের হিসেবে দাঁড়ায় প্রায় ৬০০০টি। ইউটিউবে প্রতি মিনিটে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও কনটেন্ট আপলোড করা হয় প্রায় ৩০০ ঘণ্টার মতো। তথ্য, বিনোদন, বিজ্ঞাপন, ই-কমার্স, ই-বিজনেস, ই-মার্কেটিং, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাবৎ বিশ্বের প্রায় ৮১% ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আজকের সময়ে কোনো না কোনোভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার মূলে রয়েছে যোগাযোগ। আর এই যোগাযোগের সেতু নির্মাণ করে ভাষা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ নিজের মনের কথা বা বক্তব্য, হাব-ভাব, আবেগ, অনুভূতি বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করে। লেখ্যরূপ অধিক গুরুত্ব পেলেও ভিডিওর মাধ্যমে বাচিক উপস্থাপনাও বেশ জনপ্রিয়। হাল আমলে এসব লেখ্যরূপ বা কথ্যরূপকে পেছনে ফেলে সর্বাগ্রে জায়গা করে নিয়েছে ইমোটিকন ও ইমোজি। নেট দুনিয়ায় বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে পছন্দ, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, হাসি, কান্না, দুঃখ, রাগ౼ এসব প্রকাশে এখন আর লাইনের পর লাইন শব্দ-বাক্য ব্যবহার করছে না। নানা রকমের ইমোটিকন ও ইমোজি ব্যবহার করেই খুব দ্রুত সময়ে নিজের মনের ভাব বা আবেগ প্রকাশ করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। কখনো কখনো একটি ইমোটিকন বা ইমোজির সঠিক ব্যবহার বহু শব্দে-বাক্যে গঠিত অনুভূতির চেয়েও অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত ও চর্চিত ইমোটিকন ও ইমোজি’র ইতিবৃত্ত বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের আলোচনার বিষয়। ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সাংকেতিক চিহ্নের আধুনিক প্রয়োগ ও যোগাযোগের এই আদি ভাষার প্রযুক্তিগত রূপ প্রসঙ্গে নিম্নে আলোকপাত করা হলো:
ইমোটিকন(Emoticon)
ইমোটিকন হচ্ছে টেক্সটভিত্তিক উপস্থাপনা, বিভিন্ন প্রকার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের জন্য মুখমন্ডলের অভিব্যক্তির এক প্রকার টাইপোগ্রাফিক উপস্থাপনা। দীর্ঘ বাক্য এবং বর্ণনামূলক শব্দ ব্যবহার না করে অতিদ্রুত সংখ্যা আর বিরামচিহ্নের মাধ্যমে মুখচ্ছবিতে আবেগ প্রকাশের একটা প্রক্রিয়া। একাধিক অক্ষরের সংগঠন, যা নির্দিষ্ট কোন একটি মনোভাব ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু এটি কোন শব্দ নয়; বলা যেতে পারে অক্ষর দিয়ে তৈরি ছবি। ইমোটিকন ইতোমধ্যে যোগাযোগের প্রচলিত পদ্ধতি অতিক্রম করে নতুন সার্বজনীন ভাষা হয়ে উঠছে। ইমোটিকন (Emoticon) হল দুটি শব্দের সমন্বয়ে তৈরি౼ আবেগ (emotion) এবং আইকন (ICON)। পছন্দ, ভালোবাসা, আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, দুঃখ-বেদনা, অভিমান, রাগ প্রভৃতি ভাব ও অনুভূতি ইমোটিকন দিয়েই সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে কোনো লেখা বা ছবিতে আবেগ প্রকাশ করা যায়। এটি বিন্দু, ড্যাশ এবং অন্যান্য গ্রাফিক চিহ্নগুলির সাথে তৈরি ছবি, যা মেজাজের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠ্য বার্তায় ব্যবহৃত হয়। ইমোটিকন অনানুষ্ঠানিক ভাষার অংশ, তাই আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইমোটিকন ব্যবহার করা সমীচীন নয়। তবে নিত্যদিনের ব্যবহৃত ভাষায় ইমোটিকনের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ ধরণের চিত্রভাষা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
ইমোজি(emoji)
ইমোজি (emoji) ও ইমোটিকন (emoticon) এর কাজ একই হলেও শিল্পপ্রকরণে দুটি আলাদা বিষয়। ইমোটিকন (emoticon) হলো মুখভঙ্গির মাধ্যমে আবেগের প্রকাশ। আর ইমোজি (emoji) হলো অ্যানিমেটেড ডিজিটাল ইমেজ। ইমোজি (emoji) হলো ছোট ছোট কতগুলো আইকন। যা ডিজিটাল কমিউনিকেশন, SMS, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। ইমোজি (emoji) শব্দটি এসেছে- জাপানি ‘ই (e)’ মানে ছবি (picture) ও ‘মোজি (moji)’ মানে অক্ষর (character) থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চ্যাটবক্সে, বিভিন্ন মেসেঞ্জার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে এসব অ্যানিমেটেড ডিজিটাল ইমেজ সংযুক্ত দেয়া থাকে, যা খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। সিজেতাকা কুরিতা ইমোজির জনক। ইমোজি হল বৈদ্যুতিন বার্তা অর্থাৎ ওয়েবে ব্যবহৃত গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনার ভাবলিপি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে জাপানি মোবাইল ফোনে ইমোজির প্রথম আবির্ভাব ঘটে। এরপর অ্যাপেলের আইফোনে ইমোজি অন্তর্ভূক্ত হবার সাথে সাথে ইমোজির বিশ্বজয় শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১৭ জুলাই এখন বিশ্ব ইমোজি দিবস পালিত হচ্ছে; ২০১৪ সালে দিবসটি প্রথম পালিত হয়। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আবেগ প্রকাশের জন্য ইমোজি যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমে হিসেবে পরিণত হয়েছে। এখন আর খুশির অনুভূতি লিখে পাঠাতে হয় না। একটি মাত্র চিত্রই গ্রাহককে প্রিয়জনের সঙ্গে আবেগ প্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে। নেট দুনিয়ায় বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে পছন্দ, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, হাসি, কান্না, দুঃখ আর রাগ; নানা রকমের ইমোজি ব্যবহার করেই নিজের আবেগ প্রকাশ করা যায়। কখনো কখনো একটি ইমোজির ব্যবহার কয়েক পৃষ্ঠা লেখ্য বক্তব্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
যোগাযোগের আদি ভাষার আধুনিক রূপ
মানুষ সাধারণত যে শব্দ বা সংকেতের মাধ্যমে একজন অপর একজনের সঙ্গে ভাব বিনিময় ও যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে তাকেই মূলত ‘ভাষা’ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা Summer Institute of Linguistics সংক্ষেপে (SIL) এর এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়౼ বর্তমান পৃথিবীতে চলমান ভাষা রয়েছে প্রায় সাত হাজারেরও অধিক। ভাষার শুরুটা কীভাবে হয়েছে, এতগুলো ভাষার জন্ম কী করে হলো, ভাষার ক্রমবিকাশ কীভাবে ঘটেছে- এসব বিষয় নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মতের অন্ত নেই। নৃ-বিজ্ঞানীরা মনে করেন౼ ‘ভাষা এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যে মানুষ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে এর প্রকট ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় না। অনেকে মনে করেন, প্রাকৃতিক ধ্বনি ও নকশা থেকে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। চার্লস ডারউইন বলেছেন౼ ‘ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দের ইঙ্গিত, প্রাণীদের আওয়াজ ও মানুষের স্বভাবগত উচ্চারিত ধ্বনির অনুসরণ ও সংশোধন করে, আর এতে কোনো সন্দেহ নেই’। ভাষাতাত্ত্বিকগণের কারো কারো মতে౼ ‘মানুষের মনের ভাব, চিন্তা, আনন্দ, বেদনা, আবেগ প্রকাশের ধ্বনি থেকে ভাষার জন্ম’। সভ্যতার গোড়ার ইতিহাস থেকে শুরু করে মানুষের ইশারা, আকার, ইঙ্গিত, নির্বাক অঙ্গভঙ্গি, অস্ফুট ধ্বনি থেকে প্রাক-ভাষার জন্ম। আদি সমাজের মানুষগণ তাদের মনের ভাব পূর্ণরূপে প্রকাশের জন্য প্রাক-ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি চিত্র, রেখা, অঙ্কন ও নানা ধরণের আঁকিবুকির সাহায্য নিতেন। আদি ভাষার শুরুই হয়েছে রেখাচিত্রের মধ্য দিয়ে। আদিম মানুষের জীবনধারণ কৌশল, খাদ্যসংগ্রহ প্রক্রিয়া, শিকার পদ্ধতি, জীবনের বিশেষ ঘটনা, বীরত্ব কাহিনী প্রভৃতি বিষয় তারা মাটিতে, পাথরগাত্রে, গাছের গুড়িতে, গুহার দেয়ালে, পর্বতগাত্রে বিভিন্ন রেখাচিত্রের সাহায্যে ছবি এঁকে রাখতেন। এসব ছবি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশের প্রক্রিয়া হলো চিত্রলিপি (Pictogram)। চিত্রলিপির পরে উদ্ভব ঘটতে দেখা যায় ভাবলিপির (Ideogram)। এটি চিত্রলিপিরই পরিপূরক, এক্ষেত্রে চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি অনেক সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপিত হতো। এ পর্যায়ে বস্তু বা পশু-প্রাণির ছবি না এঁকে কয়েকটি রেখার সাহায্যে উদ্দিষ্ট বস্তু বা জন্তুকে বোঝাতে সংক্ষেপধারা চর্চিত হতে লাগল। ভাবলিপির চিত্র অনেকটাই প্রতীকী। বস্তু নয়, তার ভাবকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল এই লিপিতে। এর পরের ধাপে চিত্রপ্রতীক লিপির (Hierograph) আগমন ঘটে। চিত্রপ্রতীক লিপিতে অঙ্কিত চিহ্নগুলি ঐ বস্তু বা ভাবের নামবাচক শব্দ বা ধ্বনিগুচ্ছের দ্যোতক হয়ে উঠল। এই সংক্ষিপ্ত ও সাংকেতিক চিহ্নগুলো ক্রমেই বিবর্তনের মাধ্যমে ধ্বনি প্রতীক হয়ে উঠল। বিষয় লিপিতে এর পরের স্তরের নাম শব্দলিপি। শব্দলিপির চিহ্নগুলো ক্রমে ক্রমে আরো সহজ ও হ্রাস করে তৈরি হলো ধ্বনিলিপি। এগুলো পুরো একটা শব্দের প্রতীক না হয়ে ঐ শব্দের আদি অক্ষরকে বোঝাতে লাগলো, সৃষ্টি হলো অক্ষর বা দললিপির (Syllabic Script)। অক্ষর বা দললিপির বিবর্তনের মাধ্যমে আরো সূক্ষ্ম ও বিশিষ্ট কিছু চিহ্নে রূপান্তরিত হয়। এই পর্যায়ে এক একটি চিহ্ন পূর্ণ কোনো দল বা অক্ষরের প্রতীক না হয়ে- একক ধ্বনিতে উন্নীত হলো। একক ধ্বনির লিখিত রূপই বর্ণ। তাই এই লিপিকে বর্ণলিপি (Alphabebic Script) বলা হয়। প্রারম্ভিক কালের এই চার প্রকার লিপি ছাড়াও আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য লিপি রয়েছে যেগুলো পরবর্তীকালে লিপি বিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছেন। যেমন౼ প্রাচীন মেসোপটেমিয় বা সুমেরীয় অঞ্চলের কিউনিফর্ম লিপি, হায়ারোগ্লিপিক লিপি। নগর সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিসরীয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। প্রথম দিকে তারা ছবি একে মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতি চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফিক লিপি (Hieroglyphic Script) নামে পরিচিত ছিল। হায়ারোগ্লিফ শব্দের অর্থ পবিত্র খোদাইকৃত লিপি। মিসরে এসে গ্রিকরা এই লিপির সঙ্গে পরিচিত হয়। ভাষাবিদের মতে, ফারাও রাজা মেনেসের রাজত্বকালে আনুমানিক ৩২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এই লিপির সূচনা হয়। হায়ারোগ্লিফে লেখার পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট জটিল। ফলে এটা আসলে সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে ওঠেনি। এ লিখন পদ্ধতিতে ভিন্ন ধরণের প্রায় ২০০০ প্রতীক ছিল। আসলে অঙ্কিত মানুষ বা পশু-পাখির মুখ যেদিকে ফেরানো থাকত, সেদিকটা সে লাইনের শুরু বলে ধরে নেওয়া হতো। একই প্রতীক দিয়ে হায়ারোগ্লিফে তিন ধরণের ভাব প্রকাশ করা যেত। প্রতীকে যে প্রাণী বা বস্তুর ছবি থাকত, অনেক সময় হয়তো সরাসরি সেটাই বোঝাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জটিল ও কারুকার্যময় এই লিপি বিবর্তিত হতে থাকে। তাতে প্রতীকগুলো সরল আর সহজে লেখার উপযোগী হয়। তখন সেটি নতুন এক লিখন পদ্ধতিতে পরিণত হয়। সে চিত্র বিবর্তিত হয়ে বর্ণমালায় রূপ নিলেও এখন আবার সে চিত্রই ভাষা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি সব সেবাকেই সহজ করে দিচ্ছে। হাল আমলে মানুষের ভাব প্রকাশও সহজ থেকে সহজতর হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ই-মেইল, এসএমএস বা নিউমিডিয়ার অন্যান্য মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নানাধরনের ইমোজি ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজকাল ভাবপ্রকাশে একটা বাক্য বা কয়েকটি শব্দ লেখার সময় মানুষের হাতে নেই! পৃথিবী গতিময়, সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে মানুষ আরও গতিময় হচ্ছে; খুঁজে নিচ্ছে সোজা, সহজ ও সংক্ষিপ্ত রাস্তা। তাই লেখালেখিতে লম্বা সময় ব্যয় করার পরিবর্তে ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে নানান ধরণের ইমোজি ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই ইমোজি আমাদের হয়তো সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছে! কিন্তু অপ্রিয় বাস্তবসত্য হচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে আবেগ প্রকাশের চিন্তাশক্তিকে। এই সংক্ষিপ্ত রাস্তা অবলম্বনকারী মানসিকতার প্রভাবে বতর্মান সময়ে তৈরি হচ্ছে একটি ‘ইমোজি প্রজন্ম’! যারা যাপিতজীবনে যান্ত্রিক এক রোবোটিক আবেগে স্নাত, অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক আবেগ অনুপস্থিত! তবে এর বিপরীতে ইতিবাচক চিত্রও রয়েছে౼ বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ইমোজির ব্যবহার দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রথাগত যোগাযোগের প্রচলিত পদ্ধতি অতিক্রম করে, ইমোজি সংস্কৃতি নতুন এক ধরণের সার্বজনীন ভাষা বিনির্মাণ করে চলেছে। নানান দেশের নানা ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা?’ রামনিধি গুপ্তের এই কবিতাংশ কেবল আমাদের নয়, বিশ্বের প্রতিটি মাতৃভাষাভাষী মানুষের কাছেই ধ্রুব সত্য! কিন্তু হাল আমলের প্রযুক্তির দাপটে পরিবর্তিত দুনিয়ায় ইমোজি সংস্কৃতি ভাষা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে, তৈরি করেছে নতুন একটি সংস্কৃতি বলয়। এখন স্বদেশী ভাষা ছাড়াও নেটিজেনরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন- কমন ইমোজির চিত্রভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে। ভাষা সবসময় গতিশীল। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি ভাষা প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত౼ ‘ভাষা কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। ভাষা মানুষের সৃজনশীল চেতনার সঙ্গে যুক্ত।’ তাই বলা যায়- ভাষার এই ডিজিটাল রূপান্তর সময় ও প্রয়োজনের হাত ধরেই প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে।
স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল মার্কেটিং, পেশাদার-অপেশাদার প্রায় সব জায়গাতেই ইমোজির ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনলাইন বা ডিজিটাল প্রযুক্তিরকালে ভাষামাধ্যমও ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। আদিকালের ভাষাহীন মানুষ যোগাযোগ করতো- রেখা, চিত্র বা ছবি এঁকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রাচীনকালের সেই রেখা, চিত্র বা ছবি ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে পুনরায় বহুল চর্চায় ফিরে এসেছে। ইন্টারনেটে দৈনন্দিন কথোপকথনে ইমোটিকন ও ইমোজি ব্যবহার না করার কথা বর্তমান প্রজন্ম চিন্তাও করতে পারবে না। ইমোজি হলো মানুষের অনুভূতি আর মুখভঙ্গির আদলে গড়া এক ধরণের ডিজিটাল আইকন। প্রযুক্তি ও সময়কে আত্মস্থ করে ভাষার এই নব রূপায়ন ঘটেছে। এটিকে গ্রহণ না করে, অস্বীকার বা খারিজ করে দেবার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বসংস্কৃতির অংশ হিসেবে হাল আমলের এই নয়া ট্রেন্ডকে আমাদের গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। অনেকে আবার ইমোজির সঠিক অর্থ না জেনেই ব্যবহার করে থাকে! এতে করে তৈরি হয় ভিন্ন বিপত্তি। আমাদের প্রত্যেকের ইমোটিকন বা ইমোজির সঠিক অর্থ জেনে ব্যবহার করা উচিত। ইমোজির ভুল ব্যবহারের কারণে আবেগের বিপরীত অর্থবোধক বার্তা চলে যেতে পারে। ভাষা আপন গতিতে নদীর ধারার মত পরিবর্তিত হয়। ভাষার ব্যাপারটাইত এমন; প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হবে, তবেই জীবিত থাকবে ভাষা। জীবিত ভাষা যোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। নতুন নতুন শব্দ ভাষাকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি নতুন নতুন ডিজিটাল আইকন, চিত্রভাষা, ইমোজি, ইমোটিকন সৃজনের মধ্য দিয়ে অনলাইনের যোগাযোগ ভাষাও সমৃদ্ধ হচ্ছে। যার মূখ্য উদ্দেশ্য হলো মনের ভাব প্রকাশ করা। গ্রহণ-বর্জনের সীমাবদ্ধতা থাকলে ভাষার উন্নতি হয় না। পরিবর্তন নিয়ে শক্ত অবস্থানে থাকলে ভাষাটা সেকেলেই থেকে যায়; একসময় ভাষার বিলুপ্তি ঘটে। এভাবে বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে ইতোমধ্যে ইমোজি, ইমোটিকন, ডিজিটাল আইকন বা চিত্রভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে চেতনে বা অবচেতনে এক নয়া-সংস্কৃতি চালু হয়েছে। বলা যেতে পারে౼ যা প্রকারান্তরে যোগাযোগের আদি ভাষার আধুনিক রূপ! সমকালীন তরুণ প্রজন্ম ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সম্মিলিত মিথস্ক্রিয়ায় ইমোটিকন ও ইমোজি সংস্কৃতি সমগ্রবিশ্বকে একটি কমন আবেগ-অনুভূতির ভাবস্নাত হওয়ার যোগাযোগ মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে।