আড়ত

আজমিনা তোরা
উদ‌্যোক্তা

সেপ্টে ২৫, ২০২১ | জীবন গড়ি

Ended soon

প্রতিটা মানুষ এক একটা গল্প। এক একটা জীবন নিয়ে গল্প লিখতে গেলে দিস্তা দিস্তা উপন্যাস হয়ে যাবে!

কিন্তু তাহলে প্রতিদিন কেন উপন্যাস হয়না? প্রতিদিন কেন একটা মাস্টার পিস লেখা হয় না?

সবই আসলে উপস্থাপন! উপস্থাপনের অভাবে প্রতিদিন আলোর মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার মাস্টার পিস আইডিয়া, যা হয়ত বদলে দিতে পারত এই ধূলির ধরাকে! বদলে দেয়ার গল্প বলতে আজ আসিনি। আজ এসেছি নিজের পণ্যকে উপস্থাপন করতে। ছোট্ট করে শুরু করা আমাদের উদ্যোগ আড়ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন পড়েছি বলে যে আজ ব্যবসা করি, ব্যাপারটা সেরকম না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাবা, চাচা, মামা, খালু, নানা, দাদা সব্বাইকেই দেখেছি ব্যবসা করতে। হয়তো সে থেকেই মনের মধ্যে ছিল ব্যাপারটা- এক দিন আমিও ব্যবসা করব। যদিও আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ, পরিবার নারী ব্যবসায়ীকে এখনও ঠিক মেনে নিতে পারেনি। ‘মেয়ে মানুষ’ ঘর সামলাবে। নিদেন পক্ষে সরকারী চাকুরি করতে পারে। কিন্তু ব্যবসা, উহু! এক্কেবারেই না! এই ছিল অবস্থা!

কিন্তু এরপরও ব্যবসায় নামলাম। শুরুটা খুবই ছোট আকারে, যাতে রাস্তাঘাটটা আগে ভালোমতো নিজে হাতে-কলমে চিনে নিতে পারি। কিন্তু কী নিয়ে ব্যবসা করব? এমন সময় হঠাৎ মাথায় এলো, আরে, আমি তো গত ২ বছর যাবৎ যা করে এসেছি তাকেই তো কাজে লাগানো যায়!

মূলত চাকরি সূত্রে কক্সবাজার থাকার ফলে বিভিন্ন সময়ে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু পরিজনকে শুঁটকি পাঠাতে হয়েছে। বারবার শুঁটকি কিনতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হলো ট্যুরিস্টরা যেসব শুঁটকি কিনেন, তার প্রায় সবই খারাপ মানের শুঁটকি।  আর দামেও অনেক বেশি।  স্থানীয় কিছু মানুষের সহযোগিতায় আমি মহেশখালীসহ আশেপাশের কয়েকটি দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করা শুঁটকি সরাসরি যদি আড়তদারের কাছ থেকে নিই তাহলে দাম অনেকাংশেই কমে যায়। যা শহরের দোকানগুলোর চেয়ে অনেক কম। সেই শুটকি যখন বাসায় আর বন্ধুদের কাছে পাঠালাম, তারা আরও চাইল। এরপরই মূলত ভাবলাম, কেবল বন্ধুদের না, আরও অনেকের কাছেই আমি এই শুঁটকি পৌছিয়ে দিতে পারি যদি আমার কাজটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেই। অর্থাৎ, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তৈরি করি। যেই ভাবনা, সেই কাজ। নাম ঠিক করে ফেলি ‘আড়ত’। নাম হিসেবে চাচ্ছিলাম এমন একটা সহজ শব্দ যা সবাই জানে, প্রতিদিন ব্যবহার করে আর যা একই সাথে ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট। আর যেহেতু কেবল শুঁটকিতেই আবদ্ধ থাকতে চাই না, তাই নামের মধ্যেও সেই সুযোগ থাকা চাই। ‘আড়ত’ নামটা এক্ষেত্রে মনে হয়েছে একেবারে লাগসই।

শুঁটকির পাশাপাশি আর কি করা যায় তা ভাবতে ভাবতেই আসে আচারের আইডিয়া। ৩/৪ বছর আগে যখন আমি প্রথম আচার বানাই, অতিরঞ্জন মনে হলেও সত্য, আমি নিজেই নিজের আচার খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম! পরে ব্যবসা শুরুর পর ভাবলাম, আচারকেও রাখি না কেন! দেখি তো কেমন চাহিদা!

ওমা! দেখা গেল, শুঁটকির চেয়ে বরং আচারের চাহিদাই বেড়ে গেল। এত এত অর্ডার আসল যে রাত দিন দুইজন মিলে আচার বানিয়েও শেষ করা যাচ্ছিল না।

আচারের মধ্যে চলছে সবচেয়ে বেশি রসুনের আচার। আর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিখ্যাত খাবার মচমচে বালাচাও। এই খাবারটা রেডি টু ইট। মানে বয়ামে একেবারে প্রস্তুত থাকে। গরম গরম ভাতের সাথে খেয়ে নেয়া যায়। এই খাবার ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ। চাকুরিজীবীদের জন্য খুবই সময়োপযোগী একটা খাবার। রান্না করার ঝামেলা নেই। ফ্রিজ ছাড়াই সংরক্ষণ করা যায় ৬ মাস পর্যন্ত। অবশ্য এত মজা যে ৬ মাস রাখতেই হবে না! এই দুটোর জন্যই প্রচুর পেয়াজ রসুন লাগে। রসুনের আচার দেখে মনে হয় বানানো অনেক সহজ। কিন্তু মাত্র ঘন্টাখানেক রসুন ছিলতে/কাটতে গেলে বোঝা যায় এ জিনিস কী! এর রস মরিচের চেয়েও বেশি জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে। আর হাতের চামড়া উঠে যায় দুই একদিন পরপর। এসব থেকে কিছুটা মুক্তির জন্য আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ পরে কাজ করি। এরপরও জ্বালাপোড়া করেই।

আড়ত এর বিভিন্ন পণ‌্য

আচার বানাতে যেয়ে পড়লাম মহা বিপদে। চাকুরি সূত্রে কক্সবাজার থাকি, এদিকে খাঁটি সরিষার তেল পাওয়া ভারী দায়! বোতলজাত কোন তেলেরই ঝাঁঝ নেই। অনেক ভেবে নিজের হোম টাউন বগুড়া থেকে নিজে বসে ভাঙিয়ে আনি সরিষার তেল। এরপর আড়তের কার্টে যুক্ত হয় ঘানি ভাঙা সরিষার তেল এবং ঘরে তৈরি সরের ঘি। সাথে আছে মিক্সড ড্রাই ফ্রুটস আর রোস্টেড কাজুবাদাম। স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের তাগিদে নিজেরা ঘরে বিভিন্ন প্রকার বাদাম খেতাম। আড়তের কাস্টমাররাও যাতে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারে তাই মিক্সড ড্রাই ফ্রুটস যুক্ত করা।

নতুনদের জন্য কিছু কথা: শুরুটা করাই আসলে মূখ্য বিষয়। শুরু করব করব করেও ৫ বছর সময় নিয়েছি। মাঝে একবার পার্টনারশিপে শুরু করি এবং প্রতারিত হই। এরপর সিদ্ধান্ত নেই বিজনেস করলে একাই করব। আমার মতে শুরুতে পার্টনারশিপে যাওয়াটা সমস্যা।

শুরুতে বিজিনেসে অনেক বাধা থাকে। শুরু করলেই ধীরে ধীরে সমাধান বেরিয়ে আসে। তাই শুরুটা করাটাই মূল বিষয়।গুছিয়ে নিয়ে কোন কাজ হয়না। শুরু করলেই নিজের ভুল গুলো ধরা দেয়, শোধরানো যায় দ্রুত। তাই যারা উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবছেন, জাস্ট শুরু করে দিন। পরের রাস্তাটা আপনা আপনিই বের হয়ে আসবে।

ইচ্ছা আছে, সরাসরি শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের গ্রিন টি, আর আমের সময়ে সরাসরি রাজশাহী – চাঁপাই থেকে আম সারা দেশে সরবরাহ করার। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথাবার্তাও এগিয়েছে অনেক দূর।

ধীরে ধীরে কলেবর বাড়ছে আড়তের। আমি বিশ্বাস করি, কাঙ্ক্ষিত মানসম্পন্ন পণ্য আড়ত ক্রমাগত সরবরাহ করে যেতে থাকলে, আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভাশিস অব্যহত থাকলে আড়ত ঠিক ততখানি বড় হবে, স্বপ্ন যতখানি বড় হয়।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন