সুশাসন বনাম সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ

ড. সৈয়দ আলী আজহার
চেয়ারপার্সন, AIRD Ltd.

অক্টো ১০, ২০২১ | অধিকার ও সুশাসন

Ended soon

এক কথায় বলতে গেলে ‘সুশাসন’ হলো একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। ‘সুশাসন’ হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে, সুষ্ঠভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র শাসন। অন্যকথায় সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বুঝায়। সুশাসন হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল ও ন্যায়সংগত ব্যবস্থা যা আইনের শাসনকে নিশ্চিত করে। সুশাসনকে সরকারের উচ্চতর দক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় (সূত্র, তাং ২১/৪/২১ খ্রি.)। তবে এই সুশাসনের সাথে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গায় একটি নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। মূলত: ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বব্যাংকের ব্যর্থতার ফলে ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সুশাসনের ধারণাটি উদ্ভব হয়। এটি বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন নামে পরিচিত। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বব্যাংক সুশাসনকে উন্নয়নের এজেন্ডাভুক্ত করে। এতে সরকার ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় ও উভয়েই লাভবান হয় বলে সুশাসনকে সরকার ও জনগণের ‘Win Win Game’ বলা হয়।

অন্যদিকে মূল্যবোধ হল মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ড। অন্যভাবে বলতে গেলে মূল্যবোধ হল কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাস। আর যে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে তাই হল মূল্যবোধ শিক্ষা। মূল্যবোধ হল সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটি মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি। একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে এটি ভূমিকা পালন করে। ফ্রাঙ্কেল এর মতে, ”মূল্যবোধ হল আবেগি ও আদর্শগত ঐক্যের ধারণ”।

মূল্যবোধ শিক্ষা ব্যক্তির মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। আর এভাবে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সাধন করে এটি সুশাসনের পথকে প্রশস্ত করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটায়। তাই মূল্যবোধ শিক্ষা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় সব ধরণের অবক্ষয় থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে পারে্। মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে বয়সের সাথে আদর্শিক ধর্মীয় বা পবিত্র বিষয়গুলো জাগ্রত হয়। তাই এটি ব্যক্তিজীবনের গাইডলাইন হিসেবে ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধ গঠনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে যে বিষয়গুলো কাজ করে সেগুলো হল-পরিবার, বিদ্যালয়, সম্প্রদায়, খেলার সাথি, সমাজ ও প্রথা। অন্যদিকে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বো‌ধ, পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকার শৈথিল্য, ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য্, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর অধিক নির্ভরশীলতা প্রভৃতি মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নিয়ামক। স্থান, কাল ও জাতিভেদে মূল্যবোধের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আবার একই সমাজে বিভিন্ন প্রকার মূল্যবোধ পরিলক্ষিত হয়। যেমন: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, বাহ্যিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, .সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ, বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধ, পেশাগত মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ (সূত্র, তাং ০১ অক্টোবর,২০২১)।

এখন প্রশ্ন হলো আমরা কোন জায়গায় আছি? আমাদের সমাজ কোন পথে এগুচ্ছে? যেহেতু অনেক পরিবারের সমষ্টি নিয়ে সমাজ ও অসংখ্য সমাজের সমষ্টিই একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি, তাই পরিবার ও সমাজের মূল্যবোধ রাষ্ট্রের সুশাসনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এর সাথে যোগ হয় রাজনৈতিক শিষ্টাচার। শিশুকাল থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত সমাজে বেশ কিছু পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির প্রচলন দেখেছি । পাঠকবৃন্দরাও দেখেছেন। মা-বাবা, দাদা-দাদী এবং পরিবার ও নিজ বাড়ীতে নিজেদের পারিবারিক গোষ্ঠী ও গ্রামের অন্যান্য বাড়ীতে পরিবারের সকল সদস্যদের নিজের চেয়ে বয়সে বড় সম্পর্কভেদে ঈদের দিন নামাজের পর ঘরে ঘরে গিয়ে পা ছুঁয়ে ছালাম করতে দেখেছি ও নিজেও করেছি। ঈদের দিন ঘরে ঘরে সেমাই, ফিরনি, পিঠা বা ঘরে তৈরি নাস্তা বাড়ীর সকল ঘরে বিতরণ ছিল সামাজিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক রীতি-নীতির একটি অংশ। একই ভাবে সকল পরীক্ষার আগে মুরব্বীদের সালাম করতে দেখেছি। পরিবার, নিজ বাড়ী ও গ্রামের মুরব্বীদের সামনে বিড়ি সিগারেট খাওয়াতো দুরের কথা চা পান বা পান খাওয়াকেও গ্রামের ছেলেরা বা মেয়েরা বেয়াদবী মনে করতো। আর তাঁদের সামনে চেয়ারে বসা? প্রশ্নই আসে না, ভূল করেও ছেলে-মেয়েরা মুরব্বীদের সামনে চেয়ারে বসতো না। এ ধরণের শিষ্টাচার ভয়ে নয়, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য অন্তর থেকে করা হতো। ছোটদের যথেষ্ঠ আদর ও স্নেহ করা হতো। বড় ভাইয়ের স্ত্রীরা মায়ের সম্মান পেতেন, তাঁরাও ছোটদের স্নেহ করতেন। রোজার মাসে মসজিদের মুসল্লীরা সকলে মিলে কলাগাছের পাতায় ইফতার খাওয়া, সে কি অনুভূতি-সে কি ভূলা যায়! শীতকালে গ্রামীন মেলায় গিয়ে বিন্নি ধানের খৈ আর অন্যান্য খাবার, ছোটদের জন্য সাজসজ্জা আর খেলার জিনিসপত্র কিনে আনার রীতি পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কুতির একটি অংশ ছিল যা পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতো। মাগরিবের নামাজের পর ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ায় বসানো পিতা-মাতার নিত্য-নৈমিত্তিক দায়িত্ব ছিল। সংসদ সদস্য, পৌড়সভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কমিশনার পদে নির্বাচনের জন্য সমাজের সম্মানীত, সৎ, নির্লোভ ব্যক্তিদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক অনুরোধ করে বা অনেকটা জোড় করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করানো হতো। রাজনৈতিক হানাহানি, মারামারি একেবারেই হতো না তা নয়, তবে এটি ছিল নিছক দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পরিবার ও সমাজে অপরাধ কমই হতো, আর হলেও গ্রামের “মাতব্বর বা দরবারী বা পরদানী” যা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো তাঁদের দরবার-সালিশের সিদ্ধান্তই সমাজের সকলেই মেনে চলতেন। শিক্ষক, আইনজীবী, ঠিকাদার- সাধারণ সমাজে এরা ছিলেন সম্মানীয় ব্যক্তি। সে সময় সমাজে একটি প্রবাদ ছিল, “মায়ে বানায় ভূত, মাস্টারে বানায় পুত”। শিক্ষকের বেত্রাঘাত না খেলে ছেলেরা মানুষ হবে না – এটি ছিল সমাজের ধারণা। গাছে ফল হলে প্রথম আহরিত ফল বাড়ীর সকলের ঘরে ঘরে বিতরণ না করে খাওয়া হতো না। কৃষি জমি চাষে সকল পারা-প্রতিবেশী ও আত্বীয়স্বজনেরা সকলে মিলে সকলের জমি চাষ করে দিতেন, যা আমার এলাকায় “খেশকামলা” নামে পারিচিত ছিল। ঘুষখোর- দুর্নীতিবাজ সে সময়েও ছিল, তবে সমাজ এদেরকে খুবই ঘৃণার চোখে দেখতো। সকল ধর্মেরে লোকদের মধ্যে এটি সুদৃঢ় সাসাজিক বন্ধন ছিল। আরো এমন অনেক কিছু রয়েছে যেগুলোর সাথে এখন মিল খুজে পাওয়া দুরুহ ব্যপার। তবে সে সময় পরিবার ও সমাজে এ ধরণের রীতি-নীতির প্রচলন ছিল বলেই হয়তো সমাজ ও রাষ্ট্রেও সুশাসন ছিল।

সময় অনেক পাল্টেছে, রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, আইনজীবিরা আদালতে দাড়িয়ে অপরাধীর পক্ষে যুক্তি দেন, দেশের মাস্তান-চাঁদাবাজরা ঠিকাদারী পেশাকে অপবিত্র করতে কুন্ঠাবোধ করেন না, নারী স্বাধীনতার আড়ালে অনেকে অনেক বিতর্কিত বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছে, পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদেরকে আষ্টে-পিষ্টে আকড়ে ধরেছে, পরিবারে স্ব স্ব সার্থের কারণে অহরহ দ্বন্দ হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিবারিক মূল্যবোধের অনেক অবক্ষয় হয়ে গেছে, ধর্মীয় মূল্যবোধ অবহেলিত বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আর্থিক দুর্নীতি আমাদের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। ছেলের বিয়ের আগে কনে পক্ষ আজ-কাল খোজ নেন বরের ”অবৈধ তথা উপরি উপার্জন” কি পরিমাণ, বাবা পরিচয় দেন মাস্তান ও চাঁদাবাজ ছেলের নাম ধরে এই বলে যে, “আমি অমুকের বাবা!”, আজ মা-বাবার স্থান হয় বৃদ্বাশ্রমে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, নমিনেশন বাণিজ্য হয় নির্লজ্জের মত, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, শিক্ষকরা রাজনীতিতে নেমে দলের লেজুরবৃত্তি করেন, আবার কোন কোন শিক্ষক পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহ করলেও তাঁদের হাত কাপে না, কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্থাতকোত্তর এমন কি পিএইচডি ডিগ্রীর সার্টিফিকেটও এদেশে টাকার বিনিময়ে বিক্রী হয় এবং অনেকে নৈতিক স্খলন ঘটিয়ে নির্লজ্জ ও বেহায়ার মত এ অবৈধ ডিগ্রী প্রদর্শন করেন যা অন্যরা বুঝতেও পারেন না, ছাত্ররা সিগারেট ধরিয়ে শিক্ষকের সামনে দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে হেটে চলে যান, নেশাগ্রস্থ ছেলে-মেয়ে রাত কয়টায় বাসায় ফিরে আসে মা-বাবা খোজও রাখেন না, রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই অপরাধীদের নিজবাসাতেই নিরাপদ আশ্রয় দেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অনেক জনপ্রতিনিধী ও অসৎ কর্মকর্তরা মিলে জনগণের অর্থ আত্বসাতের প্রতিযোগিতায় নামেন, গ্রামের দরবারীরা টাকার বিনিময়ে দরবার করেন, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি ধর্মীয় উপাসনার স্থান মসজিদ ও মন্দিরেও দুর্নীতি হচ্ছে–আমরা আর কত নীচে নামবো! দরিদ্রের ওপর আইনের প্রয়োগ হয়, ধনীর অধিকাংশই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন, সমাজ পরিচালিত হয় রাজনৈতিক টাউট দ্বারা, অনেক সংসদ সদস্য আইন মানেন না, অনেকে ইয়াবা ব্যবসার গড ফাদার হন, মানব পাচার করেন….আরো কত কি যে দেখতে হবে তা বলে শেষ করা যাবে না। তাহলে সুশাসন কোথায়? সুশাসন আসবে কি ভাবে? পাঠকবৃন্দের অনেকে বিষয়গুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে তাঁরা যুক্তি দিয়ে বিষয় গুলোকে নিজের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্ঠা করবেন, তবে যে যাই বলুন না কেন! বাস্তবতাকে কেউই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন আমরা কোথায় আছি!

হ্যাঁ, তবে আমাদের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আমরা আশাবাদী। আমি মনে করি এখানে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা অপরিসীম; সর্বপ্রথম দায়িত্ব পরিবারের। পারিবারিক দায়িত্ববোধ, শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, সততা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুস্থ্য সংস্কৃতি চর্চায় অভ্যস্থকরণ তথা একটি সুশৃঙ্খল জীবন ধারায় যদি পরিবার ধাবিত হয়, তবেই সমাজে সুশাসন ফিরে আসতে পারে। পরিবারের সদস্যদের বিঞ্গানের আবিস্কারকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে হবে-নেতিবাচক বিষয়গুলোকে পরিহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা ও অভিবাবকদের দায়িত্ব অনেক। পারিবারিক অনুশাসন এখানে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। আর প্রতিটি পরিবারে সুশাসন পরিলক্ষিত হলে তা সমাজে প্রতিফলিত হবে এবং তা বৃহত্তর পরিসরে দেশ ও রাষ্ট্রে প্রতিফলন ঘটবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কেননা, লক্ষ-কোটি পরিবার নিয়েইতো রাষ্ট্র। এভাবেই সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা জোড় করে বা শুধু মাত্র আইন প্রয়াগ করে করা সম্ভব নয়। আর এ দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়; সর্বাগ্রে পরিবারের; তার পর সমাজ ও রাষ্ট্রের।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন