জলমহাল ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ও উত্তরণের উপায় (পর্ব-২)

চৌধুরী আব্দুল হাই
উন্নয়নকর্মী ও লেখক

অক্টো ১০, ২০২১ | প্রকৃতি ও প্রতিবেশ

Ended soon

চলমান জলমহাল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম:
হাওর অঞ্চলের হাওর, বিল, খাল, নদী, নালা ইত্যাদি উম্মুক্ত শ্রেণীভূক্ত জলাশয়। এ জলাশয়গুলোতে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জলাশয়ের পাশ্ববর্তী গ্রামের জেলেদের জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা ও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে জলমহালগুলো ইজারা প্রদান করা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ সকল জলমহাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী জলমহালের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মৎস্যজীবীদের দ্বারা গঠিত সমবায় সমিতিকে ইজারা প্রদান করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সমিতি প্রভাবশালীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির দরিদ্র মৎস্যজীবীগণ এই সব জলমহালে মাছ আহরণ বা এর কোন প্রকার অংশীদার হতে পারে না। হাওরের অধিকাংশ বিল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে ইজারদারগণ সম্পূর্ণভাবে বিল শুকিয়ে মাছ আহরণ করে থাকে। ফলে পর্যাপ্ত ‘মা’ মাছ না থাকায় হাওরে দিন দিন মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বিলের ইজারাদারগণ বিলের নির্ধারিত সীমানার বাইরে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবীগণ মাছ আহরণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়াও মৌসুমী মৎস্য আহরণকারীগণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবৈধ সরঞ্জাম ব্যবহার করে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ আহরণ করে থাকে। হাওর ও নদীতে যত্রতত্র বাঁধ ও রাস্তাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ফলে মাছের চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বিল ভরাট হওয়ার কারণে কৃষকগণ বিলের জায়গা ফসলী জমিতে রুপান্তরিত করে ফেলেছে এবং কৃষিজমিতে সেচ কাজে বিলের পানি ব্যবহার করার ফলে অধিকাংশ বিল শুকিয়ে যায়। ফলে মাছের আবাসস্থল চরমভাবে ধ্বংস হচ্ছে। হাওর ও নদীতে ব্যাপকহারে ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচলের ফলে উচ্ছিষ্ট তেল ও মবিল পানিতে পড়ে এবং কৃষকগণ তাদের ফসলে অধিক পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানির গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে। হাওর অঞ্চলে জ্বালানী সংকট থাকায় হাওরের জলজ বন কেটে হাওরবাসী জ্বালানী সংগ্রহ করে থাকেন। ফলে মাছের আশ্রয়স্থলের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়। সর্বোপরি হাওর অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অধিক হওয়ার কারণে মৎস্য আহরণের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় মৎস্য সম্পদ মারাত্বক হুমকির মুখে পড়েছে। উম্মুক্ত জলাশয় তথা হাওর অঞ্চলের হাওর, বিল, খাল, নদী-নালায় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রকৃত মৎস্য জীবীদের জীবিকায়ণে উল্লেখিত কারণে জন্য বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এ সকল সমস্যা সমাধানে সরকার ও জনসাধারণের নিম্নলিখিত যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন:
১. সরকারি জলমহাল নীতি-২০০৯ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জলমহালে প্রবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২. নদী শ্রেণীভূক্ত জলমহালসমূহ ইজারার আওতামুক্ত রাখা প্রয়োজন, কারণ নদী তুলনামূলকভাবে গভীর ও খরস্রোতা হওয়ার কারণে সেচ দিয়ে সম্পূর্ণ মাছ ধরা যায় না। এই নদীগুলো ইজারা প্রদান না করে সম্পূর্ণভাবে উম্মুক্ত রেখে শুধুমাত্র বর্শি দিয়ে মাছ আহরণ করার সুযোগ রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নদীগুলো অভয়াশ্রম হিসাবে কাজ করবে, কারণ নদীগুলোর পাড় বর্ষা মৌসুমে ভেসে গিয়ে হাওরের সাথে মিশে যায়- যা হাওরের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
৩. অবৈধ সরঞ্জাম ব্যবহার করে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ আহরণ রোধকল্পে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মৎস্য আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
৪. হাওর ও নদীতে যত্রতত্র বাঁধ, রাস্তাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে মাছের চলাচলের বাঁধাসৃষ্টি হবে -এ ধরণের অবকাঠামো নির্মাণ হতে বিরত থাকতে হবে।
৫. বিলের জমিতে ফসল উৎপাদন ও বিলের পানি সেচ কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
৬. ভরাটকৃত বিল, খাল ও নদী খননের আওতায় আনতে হবে ও মৎস্য সংরক্ষণে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করতে হবে।
৭. নদী ও হাওরে ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
৮. জলাশয়ে জলজ বৃক্ষ রোপণ করতে হবে এবং জলজ বন কেটে জ্বালানী সংগ্রহ বদ্ধ করতে হবে।
৯. সর্বোপরি মৎস্য আহরণের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য মৎস্যজীবিদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।

জলাশয় ইজারা সংক্রান্ত বিষয়:
স্থানীয় পর্যায়ে জলমহাল ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে সাধারণত জলমহালের ভালো ব্যবস্থাপনার দিকে নজর না দিয়ে অধিক দরদাতা সমবায় সমিতিকে জলমহালের ইজারা প্রদান করা হয়। ফলে ইজারদারগণ অধিক ইজারা প্রদান করার ফলে অধীক পরিমাণ মাছ আহরণ করার দিকে মনোযোগ বেশি দিয়ে থাকে। যদি একজন ইজারাদার নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মাছ আহরণ করে, ‘মা মাছ’ সংরক্ষণ ও জলমহালটির সঠিক ব্যবস্থাপনা করে থাকেন তাহলেও তার মেয়াদ শেষে জলমহালটির ইজারা গ্রহণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। তাই জলাশয় ইজারা সংক্রান্ত বিষয়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে:
১. জলমহালটির পূর্ববতী ইজারাদার যদি জলমহাল নীতিমালা অনুয়ায়ী জলমহালটি ব্যবস্থাপনা করে থাকেন তাহলে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি বিবেচনা না করে তাদেরকে পুনরায় ইজারার মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রদান করা যেতে পারে।
২. সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে হস্তান্তরিত জলমহাল সমূহে বিগত তিন বছরের গড় ইজারামূল্যের উপর ৫% বৃদ্ধি করে ইজারা নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে, বিগত তিন বছরের গড় ইজারামূল্যের উপর নির্ধারণ না করে বিগত তিন মেয়াদের গড় ইজারা মূল্যকে বিবেচনায় এনে রাজস্ব নির্ধারণ করলে সুফলভোগীগণ উপকৃত হবেন, কারণ সাধারণত বিগত তিন বছরের ইজারামূল্যের গড় একই হয়ে থাকে।
৩. হাওরে বর্তমানে অধিকাংশ বিল ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ইজারাদারগণ বিলে দীর্ঘ মেয়াদে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে অধিক ইজারামূল্য প্রদানে গোপনে গোপনে এক ধরণের নোংড়া প্রতিযোগীতায় নামে এবং ইজারামূল্য অস্বাভাকিভাবে বেড়ে যায়।
৪.পরবর্তীতে ঐ বিল ইজারা নেওয়ার জন্য অন্য কোন পক্ষের আগ্রহ থাকে না। সে সুযোগে তারা খাস কালেকশনের মাধ্যমে নামমাত্র ইজারামূল্যে বিলটি ভোগ করতে থাকে। কিন্তু সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বিলের ইজারামূল্য নির্ধারণে খাস আদায়ের ইজারার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় না।
৫. সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে হস্তান্তরিত জলমহালসমূহ সাধারণত প্রকল্পের মেয়াদকালীন সময়ের জন্য দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ সাধারণত ৫-৬ বছর মেয়াদী হয়ে থাকে। সমঝোতা স্মারকের দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জলাশয়টি প্রকল্পের সুফলভোগীদের নিকট হস্তান্তর ও বিলের উন্নয়নমূলক কাজ সমাপ্ত করতে প্রায় ৩-৪ বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। ফলে প্রকল্পের মেয়াদকালীন সময়ের মধ্যে সুফলভোগীগণ বিল থেকে প্রকৃত সুফল পাওয়ার আগেই বিলটি পুনরায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টেন্ডারের মাধ্যমে হাত বদল হয়ে যায়।

মামলা মোকাদ্দমা:
জলমহাল নিয়ে বিরোধ ও মামলা মোকদ্দমা খুব সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, কারণ হাওর অঞ্চলে যিনি একটি বিলের ইজারাদার বা মালিক তাঁর অবস্থান সামাজিকভাবে অনেক উঁচুতে থাকে বলে মনে করা হয়। ফলে প্রভাবশালী বিলের মালিকগণ মনে করেন, “বিলে মানুষের মাথা রেখে দিব কিন্তু মাছের মাথা ছাড়ব না”। তাই যে কোন উপায়ে বিলের দখল ধরে রাখার জন্য মামলা মোকাদ্দমাসহ বিভিন্ন প্রকার বিরোধ তারা পরিকল্পিতভাবেই সৃষ্টি করে। সাধারণত একটি বিলের ইজারাদারের মালিকানা পরিবর্তন হলে মামলা মোকদ্দমার উদ্ভব হয়। কারণ পূর্ববর্তী ইজারাদার যেকোন একটি কারণ দেখিয়ে মামলা করে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এ স্থগিতাদেশের সুযোগ নিয়ে তিনি বছরের পর বছর বিলটি ভোগ করতে থাকেন, কারণ বিলের মামলায় সরকার পক্ষ বা সরকারপক্ষের আইনজীবীগণের খুব বেশি তৎপরতা দেখা যায় না। সমঝোতা স্মারকের জলমহালে সাধারণত দখল গ্রহণ ও বিলের উন্নয়ন কাজ পরিচালনার সময় মামলা মোকাদ্দমা হয়ে থাকে। বিলের জায়গা কৃষকগণ ফসলী জমিতে রুপান্তর করে ফসল উৎপাদন করে থাকে। বিল খনন ও বৃক্ষরোপণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সময় বিলের সম্পূর্ণ জায়গা প্রয়োজন হয়। বিলের এই জায়গার দখল নিতে গেলে পার্শ্ববর্তী কৃষকের বাঁধার সম্মুখিন হতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা মোকাদ্দমা মোকাবেলা করে উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করতে হয়। ফলে প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিলের সামগ্রিক উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।

সীমানা সংক্রান্ত:
জলমহালের কাছাকাছি বা মধ্যবর্তীতে ব্যক্তি মালিকানার ডুবন্ত ভূমিতে গর্ত করে কিংবা গর্ত না করেও মাছ আটক করে বিরোধ সৃষ্টি করা হয় প্রতিনিয়ত। বর্ষাকালে পানিতে একাকার থাকা অবস্থায় জলমহালের সীমানা চিহ্নিত না থাকার কারণে জলমহালের ইজারাদার ও মৎস্য ভিত্তিক জীবিকা নির্বাহকারীদের মধ্যে দেখা দেয় প্রচন্ড বিরোধ। জলমহালের নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত ভাসান পানিতে মৎস্য ভিত্তিক জীবিকা নির্বাহকারীদের মাছ ধরার অধিকার বাধা প্রাপ্ত নয়। তারা ভাসান পানিতে সবসময় ও পানি কমলে জলমহালের সীমানার বাহিরেও মাছ ধরতে পারে। তবুও বিরোধ লেগেই থাকে। মাঝে মাঝে এই বিরোধ এত তীব্র হয় যে, লোকক্ষয় না হলে আর থামে না। জলমহালের বা বিলের এই সমস্যা নিরসন হতে পারে বিলের সীমানা পরিমাপ করে সীমানা নির্দিষ্ঠ করতে প্রয়োজনীয় স্থানে স্থায়ী পিলার স্থাপন করার মাধ্যমে।

বর্ষাকালে জলমহালের স্ফীতি নিয়ে বিরাজমান সমস্যা নির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে সমাধান করা দরকার। বিল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, রেকর্ডপত্রে বা কাগজপত্রে এবং এলাকার মানুষের মুখে মুখে প্রত্যেকটি বিলের একটি নাম, একটি পরিমাণ এবং একটি নির্দিষ্ট সীমা রেখা রয়েছে। কোন কোনটির রয়েছে উত্তম মৎস্য প্রজনন বা মৎস্য উৎপাদনের সুনাম ও ঐতিহ্য। ১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইন আমলে আসার পর প্রত্যেকটি বিল সরকারী মালিকানার জনসম্পদে পরিণত হয়। সরকারী রেকর্ডপত্রে বা কাগজপত্রে বিলগুলোর আয়তন ও সীমারেখা সুনির্দিষ্ট থাকলেও বাস্তবে এই মূল্যবান জনসম্পদ বা ভূসম্পদ সুচিহ্নিত নয়। সরকারী মূল্যবান সম্পদ সুরক্ষায় এটি একটি বিরাট ঘাটতি বলা যায়। জলমহাল বা বিল ব্যবস্থাপনার জন্য যদি পৃথক কর্তৃপক্ষ থাকতো, তাহলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মত জলমহালের ভূমি পৃথকভাবে চিহ্নিত ও সংরক্ষণ অনেক সহজ হতো। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতাভুক্ত সকল ভূমি পিলার দ্বারা চিহ্নিত ও সবার কাছে পরিচিত। সীমারেখা সুচিহ্নিতকরণের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বিল নিষ্কন্টক ও নিরাপদ করা যায়। মূলতঃ এ দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ আরো অনেক জরুরী ও জটিল কাজ কর্মের জন্য এদিকে যথার্থ মনোযোগ প্রদান করতে পারছেন না। তাছাড়া ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নীতিমালাজনিত কারণে ইজারার মাধ্যমে বিলগুলো প্রতিনিয়ত হাত বদল হয় বলে সীমা সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের হাতে থাকে না। প্রচলিত লীজ বা ইজারাচুক্তির ১নং শর্তেই বলা আছে ‘‘লীজ গ্রহিতা জলমহালের পরিসীমানা বজায় রাখিবেন ও সংরক্ষণ করিবেন। কেওই যাতে এই জলমহালে অনুপ্রবেশ বা বেদখল না করে তাহা লীজ গ্রহিতা নিশ্চিত করিবেন’’। সরকারী মালিকানার জলমহালের সীমানা নির্ধারণ ও পিলার দ্বারা পৃথকীকরণ সম্পূর্ণ সরকারী কাজ। আগেই বলা হয়েছে সরকারের রাজস্ব বিভাগ বিলের সীমানা র্নিধারণ ও সীমানাকে স্থায়ীভাবে পৃথক করে রাখার কাজটাকে ততটা গুরুত্ব দিতে পারছেন না নানা কারণে। পাশপাশি ইজারা চুক্তির শর্তমতে জলমহালের বা বিলের অভ্যন্তরে অনধিকার প্রবেশ ও বে-আইনী দখল রোধের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ইজারাদারদেরই ওপর। ব্যক্তি পর্যায়ের ইজারাদার পিলার স্থাপন করে বিলের সীমানা সংরক্ষণে বাড়তি পুজি বিনিয়োগ করবে না, এটা অতি স্বাভাবিক কথা। এ কারণে ব্যক্তি পর্যায় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এরকম দাবীও আসেনি কোনদিন। জনস্বার্থে বিল উন্নয়ন ও বিল ব্যবহারে সমাজ ভিত্তিক সুদূর প্রসারী উন্নয়ন ভাবনায় পিলার দ্বারা বিলের সীমানা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী। ২০ একরের ছোট বিলের ইজারা চুক্তি হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে এবং ২০ একরের বড় জলমহাল ইজারার চুক্তি হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর সাথে। মূলতঃ বিলের সীমানা রেকর্ড ভিত্তিক মাপ-ঝোক করণের প্রয়োজনীয় জনশক্তি ও দক্ষশক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। সীমানা নির্ধারণে পিয়ন, চেইনম্যান, সার্ভেয়ার, ইউনিয়ন উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, স্থল বিশেষে সহকারী কমিশনার(ভূমি)-কেও সরেজমিনে উপস্থিত থাকতে হয়। মাঠে সরবরাহ করতে হয় প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র, এমন কি ভূমি আইন ও জমিজমার হিসাব নিকাশের বইপত্র । মাঠ পর্যায়ের এই কঠিন কাজটি সম্পন্নকরণে সহজে কেওই উৎসাহ বোধ করেন না। তবে কোন কোন সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরকারী স্বার্থে স্থায়ী একাজটিতে অনেক বেশী মনোযোগ বর্ষণ করেন এবং সম্ভাব্য সবকিছুই করে থাকেন। এই মাপঝোক ও সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজকে Demarcation বলা হয়। Demarcation ইংরেজী শব্দ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে গ্রামীন জনসাধারণ এই শব্দের সাথে অধিক পরিচিত। আইন অভিধান অনুযায়ী Demarcation হলো জমির সীমানা নির্দেশ ও চিহ্নিতকরণ। জমির সীমানা নির্দেশ বলতে কোন জমির প্রত্যেক দিকের অবস্থা বা সীমানার বর্ণনা করতে কোন একটি নির্দিষ্ট জমি চিহ্নিতকরাকে বুঝায়। জমির চৌহদ্দী হিসেবেও একে আখ্যায়িত করা যায়। Demarcation কাজে সরকারী কর্তৃপক্ষের লোক অর্থাৎ সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সার্ভেয়ার, চেইনম্যান, পিয়ন এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মচারী কর্মকর্তা, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও গণ্যমান্য লোকজন এবং সুবিধাভোগী সংগঠনের লোকজন আবশ্যক হয়। তৈরিকৃত পিলার আগেই কিংবা মাপঝোকের দিন যথাস্থানে নিয়ে অংশগ্রহণকারী সকলের সম্মুখে তা স্থাপন করে এই দৃশ্য ভিডিও চিত্রে ধারণ করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সকল অংশগ্রহণকারীদের যথাসময়ে যথাস্থানে একত্রিত করে সম্পূর্ণ আইনানুগ পন্থায় এই Demarcation কাজটি ক্রমে ক্রমে শেষ করে নিতে পারলে সরকারী সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে যাবে সন্দেহ নেই। তবে মসজিদের নামে, মাদ্রাসার নামে, মক্তবের নামে, স্কুলের নামে অনেক স্থানে অনেক ভূ-সম্পত্তি ও বিলের যথেচ্ছ ও বেহিসাবী ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতাবস্থায়, সরকারী ভূমি দখলে রেখে উপস্বত্ব মসজিদের নামে ভোগ করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় সমর্থন কতটুকু আছে বা না আছে তাও জানার প্রয়োজন আছে এই সম্পদ রক্ষা ও উদ্ধারের প্রয়োজনে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিল সন্নিকটে বা বিলের মধ্যভাগে অবস্থানকৃত ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত ভূমির মালিকরা বিলের সীমানা নির্ধারণে পিলার স্থাপনে বেশ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। বিল তীরবর্তী অনেক ভূমির মালিক আছেন যারা বিলের ভূমি সংযুক্ত করে নিজের জমির পরিমাণ বাড়িয়ে রেখেছেন। এইসব জোরদখলকারীরা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে গোটা প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে দিতে চায়। এই ক্ষেত্রে সনাতনী প্রক্রিয়ায় আইনগত প্রতিকারের চেয়ে কৌশল খাটিয়ে হলেও আইনের প্রয়োগ দ্রুত কার্যকর করা অত্যাবশ্যক।
(চলবে…)

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন