Ended soon
দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন লাল গালিচা বিছানো। কাছ থেকে দেখলে মনে হবে শাপলার রাজ্য। লাল রঙের শাপলায় মোড়ানো পুরো বিল। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসে ডানা ঝাপটানোর শব্দ, পাখির কলকাকলি। মন ভালো করে দেওয়া প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়বে সাতলা বিলে।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নে এই বিলের অবস্থান। প্রতি বর্ষায় লাল শাপলা ফুলেরা রাজত্ব করে এই বিলে। প্রকৃতির এই অপরূপ সাজ দেখতে দেশের নানান প্রান্ত থেকে পর্যটক আর প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসেন এখানে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। আগস্ট থেকে অক্টোবর, এই তিন মাস সাতলার বিল লাল শাপলায় ভরপুর থাকে। এটাই সেখানে বেড়াতে যাওয়ার ভালো সময়। লাল শাপলায় ভরপুর সাতলার বিল দেখতে হলে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। তারপর যেতে হবে বিলে। বিলজুড়ে শাপলারা পাপড়ি মেলে সূর্যোদয়ের আগে। সূর্যের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হতে থাকে। সাধারণত সকাল ৯টার পরে গেলে খুব বেশি ফুটন্ত ফুল দেখা যায় না।
প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমিতে জন্ম নেওয়া লাল, নীল ও সাদা রঙের কোটি কোটি শাপলা একনজর দেখার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানান বয়সী হাজারো মানুষের ভিড় থাকে। পর্যটকদের আনাগোনায় দিন দিন মুখর হচ্ছে ‘শাপলার রাজ্য’ খ্যাত সাতলা। স্থানীয় পর্যটক গাইডদের মতে, প্রতিদিন গড়ে শতাধিক পর্যটক বিলে যান বেড়াতে। তবে শুক্র ও শনিবার সেই সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
এই বিলে ভ্রমণের জন্য রয়েছে ছোট আকারের নৌকা। সূর্যের উদয়ক্ষণে সূর্যরশ্মি পড়ামাত্রই যেন মন পাগল করা এক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয় সাতলা বিল। এখানে এলে মন কেড়ে নেওয়া দৃশ্য রেখে কারোরই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। সৌন্দর্য অবগাহনে আসা এক দর্শনার্থী জানান, ‘প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এতদূর ছুটে এসেছি। ফুল দেখে আমি মুগ্ধ।’
শুধু সৌন্দর্যই নয়, সুস্বাদু খাবার হিসেবেও শাপলার বেশ কদর। তাই তো গ্রামের সহজসরল মানুষেরা জীবনসংগ্রামে আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন শাপলাকেই। সকালের সূর্যের আলো ফোটার আগেই তাঁরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বিলে নেমে পড়েন শাপলা তোলার জন্য। পানির মধ্য থেকে শাপলাগুলো তুলে এনে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে শত শত পরিবার। প্রায় ২০০ বছর সাতলার বিলগুলোতে শাপলা জন্ম হচ্ছে। ওই এলাকার ৫০ ভাগ অধিবাসী শাপলা চাষ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত।
কীভাবে ঘুরবেন
সাতলার বিলে ঘুরে লাল শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অবশ্যই নৌকার প্রয়োজন হবে। আগে নৌকা খুব একটা পাওয়া না গেলেও বর্তমানে পর্যটকদের আধিক্যের কারণে এলাকার লোকজনই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আপনাকে নৌকায় ঘোরার ব্যবস্থা করে দেবেন। সামান্য পারিশ্রমিক নিয়েই তারা সাগ্রহে আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবে বিল। নৌকার আকৃতি ও জনসংখ্যা ভেদে ৩০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঘুরতে বেরোনোর সময় অবশ্যই সঙ্গে ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না। কারণ, এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি ফিরে দেখতে চাইলে ক্যামেরায় তোলা ছবির বিকল্প নেই। ঘুরতে ঘুরতে শাপলার পাতার ওপর দেখা মিলতে পারে ছোট-বড় সাপের। তবে ভয়ের কারণ নেই, আপনি আঘাত না করলে তারাও আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। তবে সাবধানে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।
কখন ঘুরবেন
শাপলার আসল সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। শাপলার প্রকৃত সৌন্দর্য ও ফুটন্ত অবস্থায় পেতে অবশ্যই এই সময়টাতে আপনাকে ঘুরতে হবে, কারণ সূর্যের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে শাপলা তার আপন সৌন্দর্যকে গুটিয়ে নেয়। তাই ফুটন্ত শাপলা পেতে হলে বিলের আশপাশে রাতযাপন করে অবশ্যই খুব ভোরে শাপলার বিলে যেতে হবে।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য খুব ভালো ব্যবস্থা নেই সাতলায়। তবে আরামদায়ক রাত্রিযাপনের জন্য স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে তাদের আশ্রয়ে থাকা যেতে পারে। এতে খুব সকালে শাপলার বিলে ভ্রমণ আপনার জন্য সহজতর হবে। পার্শ্ববর্তী হারতা বাজারে রাতে থাকার জন্য স্বল্পখরচের দুটি হোটেল আছে, তবে সেটা শহুরে লোকজনের জন্য খুব একটা আরামদায়ক হবে না। আরামদায়কভাবে থাকার জন্য অবশ্যই উজিরপুর, পার্শ্ববর্তী উপজেলা বাবুগঞ্জ বা বরিশাল সদরে যেতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি সাতলার স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন। এমনকি খাওয়া-দাওয়াও সারতে হবে এখানে। অবশ্যই বরিশালের ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তায় আপনি মুগ্ধ হবেন।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চযোগে পয়সারহাট বা বৈঠাকাটাগামী লঞ্চে হারতায় নেমে খুব সহজে সাতলায় আসতে পারেন। ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ২৫০-৩০০ এবং সিঙ্গেল কেবিন ১০০০-১২০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চে বরিশাল শহরে এসে সাতলা যেতে পারেন। নথুল্লাবাদ বাসস্টেশন থেকে ৩০ মিনিট পরপর সরাসরি সাতলার উদ্দেশে বাস ছাড়ে, যেখানে জনপ্রতি ভাড়া ৯০ টাকা। এ ছাড়া বরিশাল থেকে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার কিংবা থ্রি-হুইলার ভাড়া করেও যাওয়া যায়, এতে ৫০০ থেকে চার হাজার টাকার মতো বাহনভেদে যাওয়া-আসায় খরচ পড়বে। কেউ চাইলে ঢাকা-হুলারহাট-ভাণ্ডারিয়ার এমভি মহারাজ, ফারহান-১০, অগ্রদূত প্লাস, রাজদূত-৭ ইত্যাদি লঞ্চে (ডেকের ভাড়া ২৫০-৩০০ এবং সিঙ্গেল কেবিন ১০০০-১২০০) স্বরূপকাঠি নেমে স্থানীয় ট্রলারযোগে মিয়ারহাট থেকে বৈঠাকাটা-চৌমোহনা হয়ে সাতলা যেতে পারেন। ট্রলারে যাওয়ার জন্য যাতায়াত বাবদ ১৫০০-২৫০০ টাকা লাগবে। কেউ স্থলযোগে বাসে আসতে চাইলে হানিফ, সাকুরা, সোনারতরী বা বিআরটিসি বাসে সরাসরি বরিশাল এসে সাতলার বাসে যেতে পারেন। আর স্বরূপকাঠি পর্যন্ত বাসে আসার জন্য হানিফ, সোনারতরী বা সুগন্ধা পরিবহনে আসতে পারেন।