Ended soon
ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ভালোবাসা ও র্নিভেজাল একটি শব্দের নাম ফুল। বিয়ে, জন্মদিন সহ যে কোনো উপলক্ষ্যে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাতে ফুলের নিত্য ব্যবহার হয়। অতীতে ফুলের উৎপাদন ও ব্যবহার ছিল খুব সীমিত। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে এবং ফুলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশে ফুল চাষ
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুল উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে। সে সময়ে একজন ফুল অনুরাগী উদ্যোগী কৃষক জনাব শের আলী মাত্র ০.৮৩ ডেসিম্যাল জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫,০০০ কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত ১.৫০ লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। ফুল নিয়ে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। ফুল শিল্পের অধিক সম্প্রসারণের ফলে বর্তমানে ফুলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। যার ফলে বিয়ে থেকে শুরু করে অন্যান্য জাতীয় অনুষ্ঠান যেমন-মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবেসও ফুলে ব্যপক চাহিদা বেড়েছে।
ফুলের উৎপাদন এলাকা
ফুলের বহুবিধ ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন গত এক যুগে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে দেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩৫২০ হেক্টর জমিতে ফুলের উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬০০ হেক্টর (৭৪%) জমিতে ফুলের চাষ হয়। ২য় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ ৬৯০ হেক্টর (২০%) এবং ৩য় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ ১২১ হেক্টর (৩.৪৪%)। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর (০.২৯%)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মূল উৎপাদনের প্রায় ১৫০০০ হাজার কৃষক জড়িত। এদের মধ্যে খুলনা বিভাগে ১১২৫০ জন (৭৫%), ঢাকা বিভাগে ৩০০০ জন (২০%)। বাকি ৫% কৃষক রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে ফুল চাষে নিয়োজিত। সূত্র:কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)
ফুলের বিভিন্ন জাত ও উৎপাদন
বিভিন্ন জাতের ফুল উৎপাদনের হিসাবে দেখা যায়, সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় গ্লাডিওলাস ৯৯১৪ টন যার টাকার মূল্য মার্কেট শেয়ার ৩১%। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে গোলাপ ১১১৩২ টন (২৪%), রজনীগন্ধা ১০৮১৪ টন (১৭%), ম্যারিগোল্ড ১২৬২৪ টন (৮%) অন্যান্য ফুলের মার্কেট শেয়ার মোট ২০%। বার্ষিক হিসাবে ২০১৪-১৫ সালে ফুল উৎপাদন হয়েছে ৫৭,০০০ টন এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা হচ্ছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আয় হয় গ্লাডিওলাস থেকে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা।
ফুল শিল্পের বর্তমান অবস্থা
ফুল শিল্প বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সালের হিসাবে গড় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত আশানুরূপ। ফুল উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২০%, বিক্রীত মূল্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২৬%। এছাড়া, খুচরা বাজারে বিক্রয়ের গড় প্রবৃদ্ধি ২০%, তবে উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধি হার মাত্র ১৫% যা অপেক্ষাকৃত কম। ফুল শিল্পের বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- ফুল চাষ ধান ও শাকসবজির তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। ফুলের উৎপাদন ও বাজার সম্প্রসারণের অন্যতম প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- ফুলের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি, হেক্টরপ্রতি অধিক লাভ, ফুলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নতি, অন্যান্য জেলায় ফুলের চাষ বৃদ্ধির সুযোগ, শহরের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফুল ক্রয়ের ব্যাপক অভ্যাস ও উৎসাহ। অধিকাংশ ফুল ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্রি হয়। ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে পাইকারি ফুলবাজার রয়েছে। এখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা ফুল কিনে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েন। কেন্দ্রীয় ফুলবাজার নির্মাণের দাবি বহু আগে থেকেই করে আসছেন ফুল বিক্রেতারা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘বাজার অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের’মাধ্যমে ঢাকার গাবতলীতে একটি ফুলের পাইকারি বাজার নির্মাণ করা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ফুল শিল্পের চ্যালেঞ্জসমূহ
ফুল একটি পঁচনশীল জিনিসি, যার ফলে ফুলের ব্যাপারে মানুষ খুবই সচেতন। একটু ময়লা ও ধুলাবালু লাগলে সেই ফুল আর সাধারণ মানুষ কিনতে চায় না। সামান্য সূর্যের তাপেও ফুলের সৌন্দর্য হ্রাস হয়। এরফলে ফুল বিক্রির করে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন বিক্রেতারা। ফুল শিল্পের এসব সুযোগ ও সম্ভাবনার মধ্যেও ফুল শিল্প বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তা হচ্ছে ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর কৃষকদের জ্ঞানের অভাব, অতিরিক্ত মূলধন ব্যয়, বাংলাদেশে ফুলের বীজ ও চারার অপ্রাপ্যতা এবং এ ব্যাপারে ভারত থেকে আমদানি নির্ভরতা, গ্রিনহাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অপ্রাপ্যতা, ফুল চাষের জন্য বিশেষ কম্পাউন্ড সারের অভাব, ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে স্থায়ী পাইকারি ফুলের বাজারের অভাব, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উৎপাদন প্রযুক্তির অভাব, কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে ২০% ফুল বিনষ্ট হওয়া, ফুল নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাব ও একটি জাতীয় ফুলনীতি না থাকা। আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের গ্রেডিং, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। নেই ফুল পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত যানবাহন।
ফুল শিল্পের বিকাশে পদক্ষেপসমূহ
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর ব্যাপক প্রশিক্ষণের আয়োজন, ফুলের বীজ ও চারা আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফুলের স্থায়ী পাইকারি বাজার স্থাপন, পরিবহনকালে ফুল জাতে বিনষ্ট না হয় তার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু, যশোরে ফুলের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন, দক্ষিণাঞ্চলের ফুল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা কর্তৃক ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফুল সেক্টরে মহিলা উদ্যোক্তাদের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন। ইউএসএআইডির সহযোগিতায় গদখালীর পানিসারা গ্রামে একটি ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে কোল্ডস্টোরেজ সুবিধার মাধ্যমে ফুল ও ফুলের বীজ সংরক্ষণ করা যাবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে পানিসারা গ্রামে একটি অ্যাসেম্বল সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে ফুলচাষি ফুল বিক্রয় করতে পারবেন। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং ঢাকার সাভারে আরও তিনটি অ্যাসেম্বল সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে।
ফুল চাষে বিনিয়োগ নিরাপদ
ফুলের বাজার এখন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। ধান ও পাটের চেয়ে ফুলেই বেশি লাভ। এখন ফুলের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। গ্রামের সবাই জানে তার আগেই প্রচুর ফুল সরবরাহ করতে হবে। সঙ্গতকারণেই দামও বাড়বে। এ ধরনের আরও কিছু দিবস আছে যেগুলোতে ফুলের ব্যবহার দিন দিন বাড়বে। তাই ফুল চাষে বিনিয়োগ নিরাপদ। এসব বিষয় মাথায় রেখেই ফুল চাষ এবং নিত্যনতুন ফুলের জাত নিয়ে সরকারি-বেসরকারি গবেষণাও শুরু হয়েছে। আর এতসব উদ্যোগের কারণেই অন্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষেই চার পাঁচ গুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে গদখালীর ফুলের সুবাসও ছড়িয়ে পড়ছে দেশ দেশান্তরে।