Ended soon
আমার আত্মীয়-স্বজন; পাড়া-প্রতিবেশী যারা কৃষিজীবী- তাদের অনেকেই এখন জানতে চান ধানের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা। প্রতিবছর কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখার পর থেকে ফোন করতে থাকেন আলুর বাজারদর কেমন থাকবে। সবজির বীজ বপনের সময় হলেই জানতে চান কোন সবজি আবাদ করলে বিক্রি করতে পারবেন। আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। কারণ উত্তর আমার জানা নেই। এ বছরের বোরো মৌসুমের কথাই যদি বলি, তা হলে এখন পর্যন্ত ধানের মূল্য কৃষকের উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। আমাদের মনে থাকার কথা- প্রায় দুই দশক আগে আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম বলেছিল, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও এক যুগ আগে (২০০৭-০৮ সাল) সেনা সরকারের আমলে হঠাৎ করে ২০ টাকা কেজির চাল গিয়ে দাঁড়াল ৫০ টাকা কেজিতে। তখন অনেক বিশিষ্টজন বলতে শুরু করলেন, আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে। চালের উৎপাদন ঠিকই আছে। আমরা ভাত খাচ্ছি বেশি। তাই চালের চাহিদা ও দাম বেড়ে গেছে। তখন কতিপয় অতিউৎসাহী চালের পরিবর্তে আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে শুরু করলেন আলুমেলা। আমার অভিজ্ঞতা হলো, বাজারমূল্য বেড়ে গেলে এই বিশিষ্টজনরা বলেন, উৎপাদন কমের কথা আর বাজারমূল্য কমে গেলে বলেন বাম্পার ফলনের কথা। এখন দেখছি, যোগ হয়েছে চিকন চাল তথ্য। আমার কৃষক ভাইয়েরা নাকি মোটা চাল উৎপাদন করেন। এ কারণে দাম পাচ্ছেন না। অন্যদিকে আমদানির জাহাজ সাগরে ভাসতেই থাকে। বোধহয় চিকন চালের জাহাজ। আহা! দেশের দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুটেরা, মুনাফাখোররা এখন দেশে উৎপাদিত মোটা চাল খেতে পারেন না। ফলে চিকন চাল আমদানি করতে হয়। লাল চিনি খেতে পারেন না। এ জন্য চিনিশিল্প ধ্বংস করে সাদা চিনি আমদানি করতে হয়। পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন না বলে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনাশ করে সিনথেটিক ব্যাগ তৈরি করতে হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) পড়াশোনার পর ২০ বছর ধরে কৃষি ও কৃষক নিয়ে কাজ করে এখনো মনে হয় আমার দেশের বৈচিত্র্যময় কৃষি এবং কৃষক সর্ম্পর্কে খুব কমই জানতে ও শিখতে পেরেছি। যারা সরকারের টাকায় বিদেশ ঘোরেন কিংবা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টাকায় বিদেশে কৃষি অনুষ্ঠান করে এ দেশে কৃষি বিপ্লবের গল্প বলেন, তাদের আমার কৃষক বন্ধু এবং কৃষি বিভাগে কর্মরত বৈজ্ঞানিক ও কৃষিবিদরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন- এর একটু বলছি।
কৃষি অনুষদের স্নাতকের শিক্ষার্থীকে ২০ বছর আগে যেসব বিষয় পড়তে হতো- এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষিতত্ত্ব (মাঠ ফসল, দানাদার ফসল, অর্থকরী ফসল, তৈল ফসল, বীজ ও আগাছা, সেচ ও নিকাশ), উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল ( সবজি, ফল, ফুল, ফসল), উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, উদ্ভিদ কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ কৌলিতত্ত্ব ও প্রজনন বিজ্ঞান, মৃত্তিকাবিজ্ঞান, ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান, কৃষি রসায়ন (সার ও কীটনাশক), কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা, কৃষি বনায়ন, পশু পালন, ফার্ম মেকানিক্স (কৃষি যন্ত্রপাতি), বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি, পরিবেশবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি এবং আরও বিষয়। আমি এও দেখেছি, পৃথিবীর যে কোনো দেশে উদ্ভাবিত কৃষিপ্রযুক্তি- যা আমার দেশে প্রয়োগযোগ্য, টেকসই ও লাগসই, তা আমাদের শিক্ষকরা শিক্ষা কারিকুলামে যুক্ত করেন প্রতিনিয়ত। এখানে আমি যে কয়টি পাঠ্যবিষয়ের কথা উল্লেখ করেছি, এসব বিষয়ে দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী অর্জনকারী আন্তর্জাতিক মানের অনেক বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে, যারা নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষি উন্নয়নে। গাছের পাতা রোগের কারণে হলুদ হলে তা দেখেন উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ, কীটপতঙ্গের আক্রমণে হলুদ হলে দেখেন উদ্ভিদ কীটতত্ত্ববিদ আর পুষ্টির অভাবে হলুদ হলে দেখেন মৃত্তিকাবিজ্ঞানী। ঠিক মানুষের জন্য যেমন রয়েছেন মেডিসিন, সার্জারি, কার্ডিওলজি, গাইনি প্রভৃতি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ- উদ্ভিদের বেলাতেও তেমনি। আমাদের দেশে রয়েছে কয়েক হাজার প্রজাতির ফসল, শত শত প্রজাতির কীটপতঙ্গ, রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, নেমাটোড- কত কী। এমনও বিশেষজ্ঞ আছেন- যিনি মাত্র একটি প্রজাতির ফসল নিয়ে গবেষণা করছেন সারাজীবন। এই গবেষকদের গবেষণা আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ ধান, সবজি ও ফল উৎপাদনে এই সফলতা; নতুন নতুন জাতের ফসল উৎপাদনে এত সফলতা।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রায় সব শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো না কোনো এক সময় একটা কথা শুনেছি, তা হলো ‘কৃষি সেক্টরে যারা চাকরি বা গবেষণা করবে- তারা চাকরিতে যোগ দিয়ে কখনো মনে করবে না তুমি কৃষকের চেয়ে বেশি জানো বা বোঝো। কৃষিকে বুঝতে হলে মাঠের কৃষি আর বইয়ের কৃষি সমন্বয় করতে হবে। কয়েক বছর মাঠে চাকরি করার পরই কৃষি শিক্ষার কিছুটা আয়ত্তে আসবে। আমাদের কৃষক বিশশ্বর যে কোনো দেশের কৃষকের তুলনায় অতিদ্রুত শিখে নেন নতুন ফসলের চাষাবাদ, ফসলের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি। আমাদের কৃষক দানাদার ফসলের রোগবালাই, পোকামাকড়, সেচ নিকাশ, সার ব্যবস্থাপনা, আগাছা ব্যবস্থাপনা যেমন বোঝেন; তেমনি বোঝেন শীতকালীন বা গ্রীষ্মকালীন ফসলের বেলাতেও। এক কথায়- কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নয়, দেশে উৎপাদিত সব ফসলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষক অনেক অভিজ্ঞ। এ বিষয়টি আমার কৃষিবিদ বন্ধু, সহকর্মী, অগ্রজ কৃষিবিদের আজও পুরোপুরি মেনে চলতে দেখি।
কথায় বলে, শূন্য কলসি বাজে বেশি। শহরে জন্ম নিয়েছেন, কোনোদিন কৃষকের মাঠে যাননি, চিকন চালের ভাত খেয়ে, শসা না খেয়ে কাজুবাদামের সালাদ খেয়ে টেলিভিশন আর গোলটেবিলে কৃষি বিপ্লবের কথা যখন বলেন, তখন আমার কৃষক বন্ধুরা আপনাদের দেখে অবজ্ঞার হাসি হাসে- জানেন কিনা জানি না। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাত করে নীতিনির্ধারক হয়েও কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য নিশ্চিত না করে যখন যা ইচ্ছা, তখন তা বলতে আপনাদের একটুও বাধে না। বিস্ময় জাগে- যখন দেখি কতিপয় ব্যক্তি কৃষির ছাত্র হয়ে কৃষি বিভাগে চাকরি করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক সুরে কথা বলেন।
মানণীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, একটি স্বাধীন কৃষি উন্নয়ন কমিশন গঠন করুন। ওই কমিশন দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক হিসাব রাখবে, মৌসুমভিত্তিক চাহিদা নিরুপণ করবে, অঞ্চলভিত্তিক মহাপরিকল্পনা তৈরী করবে (কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, প্রসেসিং শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বিদেশে বাজার সৃষ্টি, রপ্তানি ও আমদানির চাহিদা নিরুপণ), চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেটমুক্ত বাজারব্যবস্থা সৃষ্টি; উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা; কৃষি ভর্তুকির ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা তৈরি করবে- যাতে প্রান্তিক কৃষক বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারেন, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া চিকন চাল বা কোলেস্টেরল মুক্ত কৃষিপণ্য, এক কথায়- দেশে উৎপাদন হয় এমন কোনো কৃষিপণ্য কোনোভাবেই আমদানি করা যাবে না। আমার বিশ্বাস, মাত্র তিন বছর কৃষিপণ্যের উৎপাদন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা করতে পারলে এই অনিশ্চিত মূল্য থেকে উৎপাদনকারী ও ভোক্তা- সবাই রক্ষা পাবেন। এটি কঠিন কোনো বিষয়ও নয়। কেননা সরকার কৃষকদের পরিচয়পত্র প্রদান ও ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে স্বাধীন কৃষি কমিশনের বড় একটা কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করে রেখেছে। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ আর আমলার জন্য দেশের ৫৩ শতাংশ মানুষ নির্ভরশীল যে কৃষির ওপর, ওই কৃষিকে আর বঞ্চিত করা চলবে না।