ইউক্রেন সংকট: পটভূমি এবং প্রেক্ষাপট

হা‌বিবুর রা‌শেদ পলাশ
সুই‌ডেন প্রবাসী লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

মার্চ ১, ২০২২ | সমসাময়িক

Ended soon

`GO *** YOURSELF’ — অশ্লীল গালমন্দের মত শোনাচ্ছে না? আমাদের নিজস্ব কালচারাল অরিয়েন্টেশনের নিরিখে তিন শব্দের এই অশ্লীল গালিটি সকাল বেলাই আমার চোখগুলোকে আর্দ্র করে দিয়েছিল। Snake Island এ রাশান ন্যাভাল কমান্ডারের আত্মসমর্পণের আহ্বানের জবাবে লড়তে লড়তে মরে যাওয়া ১৩ জন ইউক্রেনিয়ান বীর সৈনিকের একজনের মুখ থেকে শোনা গিয়েছিল বাক্যটি। আমার কাছে এই মূহুর্তে পৃথীবির মধুরতম এবং মহানতম দেশাত্ববোধক সঙ্গীতের প্রথম লাইন এটিই। এই সঙ্গীতের বাকি লাইনগুলো লেখা হয়েছে রক্ত আর ১৩টি অমূল্য প্রাণ দিয়ে। আহা, দেশের জন্য জীবনকে নির্দ্বিধায় অস্বীকার করার স্পর্ধা মেশানো কি সাহসী উচ্চারণ! এই বাক্যে চোখ না ভিজলে আমি তো পাষাণ! এর বাংলা অনুবাদ জানেন তো? আমার অনুবাদটা এরকম – ’মাগো, বেঁচে থাকতে তোমার গায়ে একটা আঁচরও লাগতে দিব না। আর তোমাকে রক্ষার আগেই যদি মরে যাই, ক্ষমা করে দিও মা’। I salute you heroes… আজকের লেখার মূল বিষয় ওই ১৩ জন বীর সৈনিক নয় বরং নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানের উপর ভরসা করে ইউক্রেনে রাশিয়ার অন্যায্য আগ্রাসন এবং এর পটভূমির একটা Critical analysis করার চেষ্টা করতে চাই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে, এই ১৩ জন রিয়েল লাইফ সুপার-হিরো কে বাদ দিয়ে কোন কিছুই শুরু করা সম্ভব না, উচিতও নয়।

আমাদের দেশের কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর মধ্যে গত কিছুদিন থেকেই রাশান ডিক্টেটর পুতিন এর গুণকীর্তন আর ইউক্রেনে তার কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার একটা চেষ্টা আমি লক্ষ্য করছি। এই কাজে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই কিছু রাশান পপুলার টকিং পয়েন্ট বা প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করছেন। দেখুন, ভিন্নমত বা নির্দিষ্ট কোন দিকে আপনার সহানুভূতি থাকতেই পারে। তর্কের স্বাধীনতাও সবার আছে। কিন্তু তর্কের খাতিরে বা জানার অভাবে কেউ যদি বেসিক ফ্যাক্ট বদলে দেয়, তাহলে সেটা আর তর্ক থাকে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করার অথবা মতামত দেয়ার স্বাধীনতা সবার আছে। কারো সবকিছুই জানতে হবে এমন কোন কথাও নেই। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা বিষয় মেইন্টেইন করার চেষ্টা করি – যা জানি না, তা নিয়ে লিখি না, মতামতও দিই না। যদি জানার বাইরের বিষয়ে মতামত দিতে মন খুব আনচান করে, তাহলে আগে জেনে নিই, তারপর সিদ্ধান্ত নিই যে এ বিষয়ে আমার মহামূল্যবান মতামত প্রদানের আসলেই কোন প্রয়োজন আছে কিনা! আন্তর্জাতিক সম্পর্কের খুবই মনোযোগী একজন ছাত্র হিসেবে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সম্প্রতি আমি খুবই Disturbed. ছাত্র বলতে আমি আমার একাডেমিক ব্যকগ্রাউন্ডের কথা বলছি না। এই বিষয়টায় আমার প্রচন্ড আগ্রহ থাকায়, এ নিয়ে আমি নিয়মিত পড়ি, জানার চেষ্টা করি এবং Critically চিন্তা করার চেষ্টা করি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এইসব আবোলতাবোল পোষ্টগুলো যে প্রচন্ড বিরক্তি উৎপাদন করে, এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে– নেক্সট জেনারেশনের বড় একটা অংশ এতে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। আজকের এই লেখার মূল অনুপ্রেরণা এই নতুন প্রজন্ম, যাদের কাছ থেকে ট্রলড হওয়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়েও লিখতে বসলাম! বয়স ৪০ এর কোঠায় তো, তাই পংখীরাজ ঘোড়ার যে বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই সে বিষয়টা বাচ্চাদের বলে যাওয়ার একটা তাড়না সবসময়ই অনুভব করি!

রাশিয়া এবং ইউক্রেনের বর্তমান সংঘাতের সরূপ বুঝতে হলে আমাদের অল্পক্ষণের জন্য হলেও অতীতে ফিরতে হবে। সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল কে, যা Left Bank নামে পরিচিত ছিল, রাশান সাম্রাজ্য দখলপূর্বক তার অধীনে নিয়ে আসে। আর ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চল (Right Bank) ছিল পোল্যান্ডের শাসনাধীন। প্রায় ১০০ বছর পর ১৭৯৩ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলও (Right Bank) দখল করে নেয়। এর পরবর্তী বছরগুলোতে রাশান সাম্রাজ্য ইউক্রেনিয়ানদের জন্য রুশিফিকেশন (Russification) নামক একটি নীতি গ্রহণ করে, যা অনুযায়ী বহু বছরের জন্য ইউক্রেনিয়ান ভাষা চর্চা এবং অধ্যয়ন নিষিদ্ধ করা হয় এবং ইউক্রেনিয়ানদের জোরপূর্বক রাশিয়ান অর্থোডক্স বিশ্বাসে ধর্মান্তরিত করা হয় (পাকিস্তানীরাও ফেইল, কি বলেন?)। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় প্রায় ১০০ বছর বেশী রুশ শাসনাধীন ছিল। ফলে পূর্বাঞ্চলীয় ইউক্রেনিয়ানদের মধ্যে রাশান ভাষা সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশী ছিল। এর কিছুটা প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ইউক্রেনও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু পাঁচ বছরের গৃহ যুদ্ধের পর ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউক্রেনকে একীভূত করে ফেললে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৪ সালে আপাত অগুরুত্বপূর্ণ একটি হস্তান্তরের ঘটনা ঘটে। জেনারেল সেক্রেটারী নিকিতা ক্রুশ্চেভ রুশ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত স্বায়ত্বশাসিত ক্রিমিয়া অঞ্চল কে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেন। নির্দিষ্ট কারণ অজানা, তবে ধারণা করা হয় ইউক্রেনিয়ান বুর‍্যোক্রেটদের খুশি করে নিজের ক্ষমতা সংহত করতেই ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়া হস্তান্তর করেন। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ মনে করা হয় ইউক্রেনে রুশ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই তিনি এটা করেন। কারণ যাই হোক, যেহেতু হস্তান্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরেই ঘটেছিল, তা নিয়ে তখন কেউ খুব একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ঠিক ৬০ বছর পর ঐ হস্তান্তরের ঘটনাটিই ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাধীন সার্বভৌম ইউক্রেনের সাথে সংঘাতে জড়ানোর অজুহাত তৈরি করে দেয়। এই বিষয়ে একটু পর আসছি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্বাধীনতার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ৯৩.৩% ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন। এখানে ছোট্ট একটা নোট রাখতে পারেন – এমনকি রুশ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ক্রিমিয়া অঞ্চলের ৫৪.১৯% ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন! কাজেই সম্প্রতি ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার আগে পুতিন সাহেব তার ভাষণে যে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার জনগণকে দুই দেহ এক প্রাণ বলেছেন, তা নির্জলা মিথ্যাচার ভিন্ন আর কিছুই না!

যাইহোক এবার আসা যাক সাম্প্রতিক সংঘাতের শুরুতে। ২০১৪ সালে এক স্বতস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইউনোকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এ অবস্থার সুগোগ নিয়ে পুতিন হুট করেই সেই ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। পরবর্তীতে একটি সাজানো গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত করে নেয়া হয়। এটা সত্যি যে পশ্চিমা দুনিয়া তখন পুতিনের এই পদক্ষেপ আগে থেকে আন্দাজ করতে পারেনি। কাজেই অর্থনৈতিক অবরোধসহ অন্যান্য অবরোধ ছিল বিলম্বিত। রাশিয়াকে বিরত রাখার কোন অগ্রীম কূটনৈতিক পদক্ষেপও সেক্ষেত্রে নেয়া যায় নি। একই সাথে পুতিন পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দিতে থাকে। ফলশ্রুতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দুটি এলাকাকে স্বাধীন ঘোষণা করে People’s Republic of Donetsk এবং People’s Republic of Luhansk নামে নামকরণ করে। এমনকি ওই দুই অঞ্চলে ছদ্দবেশী রাশান সেনাদের অনুপ্রবেশও ঘটানো হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ইউক্রেনিয়ান সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে এযাবৎ ১৪০০০ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। আসুন একটা হাইপোথিটিকাল সিনারিও কল্পনা করা যাক। তাহলে ইউক্রেনিয়ানদের মনের অবস্থা বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন বাংলাদেশে ইন্ডিয়াপন্থী এক্স সরকার ক্ষমতায় । গণঅভ্যুত্থানে ঐ সরকারের পতন ঘটলে ইন্ডিয়া সেইন্ট মার্টিন আইল্যান্ড দখল করে নিল। সেই সাথে যশোর আর সাতক্ষীরার কিছু মানুষকে মদদ দিয়ে আর অস্ত্র দিয়ে ঐ দুই জেলাকে স্বাধীন দেশ ঘোষণা করিয়ে দিল। নাম হল – ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ যশোর আর পিপলস রিপাবলিক অফ সাতক্ষীরা। কেমন লাগে ভাবতে? ইউক্রেনের মানুষদের ব্যথাটা টের পাওয়া যায়?

২০২১ সালের শেষে এসে রাশিয়া হঠাৎ করেই ইউক্রেন সীমান্ত বরাবর ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। অন্যদিকে পুতুল রাষ্ট্র বেলারুশের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ার ঘোষণা দেয়। বেলারুশের সাথে ইউক্রেনের স্থল সীমান্ত থাকায়, আক্ষরিক অর্থেই ইউক্রেন তিনদিক থেকে রাশিয়ান সেনা দ্বারা ঘেরাও হয়ে যায়। একইসাথে পুতিন সরকার ন্যাটো এবং আমেরিকার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায় যা তাদের ভাষায় রাশিয়ার সিকিউরিটি গ্যারান্টি। প্রধান দাবীগুলোর মধ্যে ছিল ন্যাটোর সম্প্রসারণ বন্ধ ঘোষণা এবং ন্যাটো ট্রুপ ডেপ্লয়ম্যান্ট ১৯৯১ সালের আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপ থেকে ন্যাটোর সেনা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা। এটা ছিল পুতিনের ইউক্রেন দখলের প্রথম পদক্ষেপ। কারণ অতি চতুর পুতিন ভাল করেই জানত ন্যাটো তার এই মামা বাড়ির আবদার কোন অবস্থাতেই মেনে নিবে না। পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য ন্যাটো মেম্বারদের কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া আর লাটভিয়া নামে যে তিনটি বাল্টিক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আছে তাদের জন্য হলেও ন্যাটোর পক্ষে পূর্ব ইউরোপ ত্যাগ করা সম্ভব নয়। এদের সাথে রাশিয়ার সরাসরি সীমান্ত থাকায়, ন্যাটোর ফোর্স প্রত্যাহারের মানে হচ্ছে এই তিনটি দেশকে আক্ষরিক অর্থেই বাল্টিক সাগরে চুবিয়ে মেরে ফেলা! বিশেষ করে ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলো যখন ঘর পোড়া গরু! বিশ্বাস করুন পুতিন দুঃস্বপ্নেও এটা চায়নি যে ন্যাটো তার দাবী মেনে নিক। স্বভাবতই, রাশিয়ার লিখিত প্রস্তাব লিখিতভাবেই প্রত্যাখ্যান করা হল। আর পুতিনের প্রথম গুলি – বুলস আই!

রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশ চলতেই থাকে একই সাথে পাল্লা দিয়ে চলে পুতিনকে নিবৃত্ত করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। পুতিনের একই কথা – পশ্চিমারা হিস্টিরিয়ায় ভুগছে, ইউক্রেনে আক্রমণ করার কোন পরিকল্পনাই আমাদের নেই। সৈন্যরা ব্যারাকে থেকে থেকে ক্লান্ত, তাই একটু বাতাস খেতে বেরিয়েছে! রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণকে বিলম্বিত করার জন্য পশ্চিমারা অভিনব কৌশল নেয় – তাদের ইন্টিলিজেন্স এর নির্বাচিত অংশ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে থাকে। যেখানে বলা হয় কিভাবে রাশিয়া ভুয়া পরিস্থিতি তৈরী করে ইউক্রেন আক্রমণের অযুহাত তৈরী করবে। পুতিন এবার একটু কোণঠাসা। কিন্তু অন্যদিকে শুরু হয় দুই তথাকথিত রিপাবলিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ। পুতিনের আশা ইউক্রেন জবাব দিলেই মোক্ষম অযুহাত হাতে পাওয়া যাবে। কিন্তু ইউক্রেন জবাব দেয়ার বোকামো করে না। তখন বলা হয় ইউক্রেন ঐ দুই রিপাবলিকে বড় ধরণের আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। সতর্কতা হিসেবে ওখান থেকে সিভিলিয়ানদের সরণার্থী হিসেবে রাশিয়ায় সরিয়ে নেয়া হয়। এর মধ্যেই দুএকটি ভিডিও প্রকাশ করা হয় যেখানে দেখা যায় ইউক্রেনিয়ান সন্ত্রাসীরা(!) দনেস্ক আর লুসাঙ্কে নাশকতা চালাচ্ছে! কিন্তু ভিডিওর মেটাডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে দিনের ভিডিও বলে দাবী করা হচ্ছে তারচেয়ে বেশ কিছুদিন আগে ভিডিওগুলো তৈরি করা! সবশেষে ছিল পুতিনের মাস্টার-স্ট্রোক। People’s Republic of Donetsk এবং People’s Republic of Luhansk কে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরদিন ঐ দুই রাষ্ট্র থেকে ইউক্রেন আর্মির হামলার আশঙ্কায় পুতিনের কাছে নিরাপত্তা প্রদানের আবেদন করা হয়। মহানুভব পুতিন সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে People’s Republic of Donetsk এবং People’s Republic of Luhansk (যেগুলো কিনা ইউক্রেনের অংশ) এ সেনা প্রেরণ করে। পুতিনের ভাষায় তারা পিস-কিপারের ভূমিকা পালন করবে (পুতিন নিশ্চয়ই পিস-কিপার বলতে বুঝিয়ে ছিল যে তারা ইউক্রেন কে পিস পিস করে নিজেদের ব্যাগে পুরবে/কিপ করবে!)। ঠিক ওই রাতেই পিস-কিপাররা হয়ে গেল স্ট্রাইকিং ফোর্স! পুতিন ঘোষণা করল দুই রিপাবলিকের জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ান সেনারা স্পেশাল অপারেশন শুরু করবে। লক্ষ্য? To demilitarize and to denazify Ukrain! Denazification? পুতিনের মত একজন ডিটেক্টর ইউক্রেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দেয়াকে Denazification বলছে? আহা! হিটলার শুনলেও লজ্জা পাবে! আর নাজীদের হাতে হলোকাস্টে নিহত মানুষগুলো লজ্জায় আবার আত্মহত্যা করতে চাইবে।

এটাতো জানাই যে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের যে কারণ মুখে বলছে তা তার মনের কথা না। আচ্ছা বলুনতো অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা কতটুকু ছিল? উত্তর হচ্ছে প্রায় শূন্য। জ্বী, ন্যাটোর ওপেন ডোর পলিসির মানেই সোজা ঢুকে পড়া না! আমন্ত্রণ লাগবে, গেটে দারোয়ানও আছে। বাস্তবতা হচ্ছে ন্যাটোতে যোগ দেয়া অতিব কঠিন ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। একটি মেম্বার স্টেটের আপত্তি নতুন কারো ন্যাটোতে অন্তর্ভূক্তি থামিয়ে দিতে পারে। জার্মানী আর ফ্রান্স কখনোই ইউক্রেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির সমর্থক ছিল না। এই খবর পুতিনের অজানা নয়। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে ন্যাটো কি রাশিয়ার জন্য হুমকি? Theoretically, yes. But practically, no. ন্যাটো এবং রাশিয়ার সরাসরি মিলিটারি কনফ্লিক্ট সম্ভব না। দুই পক্ষই এক্ষেত্রে সতর্ক। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে এই সম্ভাবনায় আমেরিকা ইউক্রেনে প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত তার প্রত্যেকটা সৈন্যকে আগেই প্রত্যাহার করেছে। যেন বিন্দুমাত্র প্রভোকেশনের সুযোগ না থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি অনেকেই ন্যাটোকে এই বলে দোষারোপ করছে যে ন্যাটো কেন সেনা পাঠিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে না, রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে না। Really? ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধ হচ্ছে, এর মানে বোঝেন তো? Apocalypse. Doomsday. End of the world! সোজা বাংলায় সব শেষ! ভাইরে ইন্টারন্যাশনাল পলিটিকসে অনেক কিছুই চলে, কিন্তু ছেলেমানুষি চলে না। ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য কোন থ্রেট না। কেন না, তা দেখতেই তো পাচ্ছেন। Article-5 অনুযায়ী ন্যাটো শুধু তার কোন মেম্বার স্টেট আক্রান্ত হলে সমন্বিত সুরক্ষায় যাবে। ইউক্রেন ন্যাটোর মেম্বার না। যদি কোনদিন হয়, তাহলে কি হবে? কিচ্ছু হবে না। স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। এটাকে বলে Big Powers’ Game. এই খেলার নিয়ম অলিখিত, কিন্তু কেউ সেই নিয়ম ভাঙে না! এইবেলা বলে রাখি, আমি ন্যাটোর তাবেদারি করতে বসিনি। ন্যাটো সাধুপুরুষদের জোট না! আমি শুধু ইউক্রেন-রাশিয়ার বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটটা ক্রিটিকালি দেখার চেষ্টা করছি।

আরেকটা কথা খুব চলছে যে ন্যাটো কথা দিয়েছিল সে পূর্ব ইউরোপে আর সম্প্রসারণে যাবে না। এটা ভুল তথ্য। ন্যাটোর Article-10 এ open door policy-র কথা বলা আছে। Article-10 ন্যাটোর ফাউন্ডিং ট্রিটিতে ছিল। নতুন করে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। রাশিয়া কিংবা ন্যাটোর মধ্যে এমন কোন চুক্তি কিংবা মৌখিক আলোচনাও হয়নি। সাবেক সোভিয়েত নেতা Mikhail Gorbachev একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন “The topic of ‘NATO expansion’ was not discussed at all, and it wasn’t brought up in those years. I say this with full responsibility. Not a single Eastern European country raised the issue, not even after the Warsaw Pact ceased to exist in 1991. Western leaders didn’t bring it up, either.” এত কথার মানে হচ্ছে রাশিয়ার দেয়া কোন যুক্তিই আসলে ইউক্রেনের উপর বর্বরোচিত হামলাকে জাস্টিফাই করে না।

রাশিয়ার জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, কার্যকর গণতন্ত্র নেই, বিরোধী কন্ঠকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। পুতিন এমনকি নিজের প্রতিপক্ষকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টাও করেছে অতীতে। বর্তমান রাশিয়া তার একক নির্দেশে চলে। যে ক্ষমতা প্রতাপশালী সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিষ্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারিদেরও ছিল না। তাঁদেরও পলিট ব্যুরোর কাছে জবাবদিহি করতে হত। পুতিন এটাও জানে তেল-গ্যাস বন্ধের ভয় দেখিয়ে খুব একটা লাভ নেই। এটা দুধারি তলোয়ার। জেনে রাখা ভাল, রাশিয়ার জিডিপির ৬০ শতাংশ আসে ন্যাচারাল রিসোর্স এক্সপোর্ট থেকে। ৬০ শতাংশ! পুতিন ইতোমধ্যেই আজীবন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা পাকা করেছে। বাড়ির পাশেই ইউক্রেনের মত পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক একটা দেশ সে চাইবে কেন? পুতিন জানে বসন্ত আরবে হানা দিতে পারলে রাশিয়াতেও পারে। কনকনে দীর্ঘস্থায়ী শীতকাল তার অনেক পছন্দ। পুতিনের শীত নিশ্চিতের অভিযানে তাই ইউক্রেন জ্বলছে!

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন