Ended soon
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান নীতি পর্যালোচনা
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। আমাদের প্রধান পরিচয় ’মাছে ভাতে বাঙালী’। ভাত ও মাছের যোগান আসে ভূমি হতে। ভাতের যোগান দেয় স্থলভূমি, আর মাছের যোগান দেয় জলভূমি। উভয় শ্রেণীর ভূমিই প্রকৃতির দান। যা নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবহৃত হয় মানুষের দ্বারা। উভয় শ্রেণীর ভূমিই জলাভূমি (Wetland) নামে পরিচিত। আবার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে হাওর নামে আলাদা বৈশিষ্টে্যর ভূমি রয়েছে। এই হাওরের স্থলভাগবেষ্টিত অপেক্ষাকৃত বড়/ছোট ও গভীর আকৃতির জলাধারকে একনামে জলমহাল বলা হয়। গুণগতভাবে জলমহাল আবার দুই প্রকার। বদ্ধ জলমহাল এবং উন্মুক্ত জলমহাল। ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক সুবিধার জন্য, পরিমাণ বা আয়তনগতভাবে প্রায় আড়াই দশক আগে জলমহালকে দুই শ্রেণীর জলমহালে ভাগ করা হয়। এক শ্রেণী অনুর্ধ্ব ২০ একর, অপর শ্রেণী ২০ একর উর্ধ্ব জলমহাল। বাংলাদেশে ২০ একরের উর্ধ্বে জলমহাল আছে ৩১১৩টি, আর ২০ একরের নীচে জলমহাল আছে ২৩১৬২টি। গ্রামীণ জনসাধারণের নিকট জলমহাল এর চেয়ে বিল নামই অধিক পরিচিত।
১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইন আমলে আসার পর সকল জলমহালে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজাস্বত্ব আইনের ফাঁকফোকর ও ১৯৫৬ সনের পাকিস্থানের সংবিধানের পথ ধরে জলমহাল ব্যক্তি মালকানায় রক্ষার যথেষ্ট চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মুনীর এর ঐতিহাসিক রায়ে ফিসারী বা জলমহালের মালিকানা ব্যক্তি পর্যায়ে রাখার কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। এই ঐতিহাসিক রায়ের সূত্র ধরে ১৯৬০ সালে ইংরেজীর ১২নং অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইনে সংশোধনী এনে ২০ (২ক) ধারা সৃষ্টি করে রুমান (ii) উপ ধারায় ফিসারী বা জলমহালের সংজ্ঞা ধার্য করে বলা হয়েছে Any Fishery other than a tank constructed solely by process of excavation অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে খনন করা পুকুর ছাড়া যে কোন মৎস্য খামারই সরকারী মালিকানার জলমহাল বলে গণ্য হবে। ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য খামার সংরক্ষণ করতে হলে তা কেবল পুকুর আকৃতি দিয়ে সম্ভব। অন্যথায় নয়। ১৯৩৯ সালের পুকুর উন্নয়ন আইনের ২(৭) ধারায় পুকুরের সংজ্ঞা ধার্য্য করা হয়েছে এরূপ ”Tank” means a reservoir or place which has been used as a reservoir for the storage of water whether formed by excavation or by the construction of one or more embankments or place where water naturally accumulates and includes any part of a tank and the banks there of except such portions of the banks as homestead garden of archard lands. সহজে বুঝা যায়, পাড় ও পানির ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট স্থির পানি সংরক্ষণকৃত, খননকৃত গর্তই পুকুর। যে গর্তের পানি বর্ষা কালের পানির সাথে একাকার হয় না তাই পুকুর এবং কেবল পুকুর আকারের মৎস্য খামারই ব্যক্তি মালিকানায় রাখা যায়। বিল ও বিলের মালিকানা বিষয়ক বিদ্যমান আইনে এইটুকু পাওয়া যায় যে, বিলের মাঝখানেও বর্ষাকালে অডুবন্ত পারবিশিষ্ট খন্দক বা পুকুর ব্যতীত মৎস্যচাষের অন্য কিছু থাকলে তা হবে সরকারী মালিকানার জলমহাল। গ্রামীণ জনপদে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকা এই মহামূল্যবান সম্পদের নাম বিল বা জলমহাল। আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশে ২০ একরের উর্ধ্বে জলমহাল আছে ৩১১৩টি, আর বিশ একরের নীচে জলমহাল আছে ২৩১৬২টি। সমগ্র দেশের মধ্যে সিলেট বিভাগে বিলের পরিমাণ বেশী। প্রায় ৪১৪১টি ছোট বড় বিল আছে বৃহত্তর সিলেটে। তন্মধ্যে কেবল সুনামগঞ্জ জেলাতেই রয়েছে ১৬৪১টি। নদী ভাঙন, গতিপথ পরিবর্তন, লোপকাটিং অনাবিষ্কৃত বিলসহ নিয়তই আরও অনেক বিল আবিষ্কার হচ্ছে। নব আবিষ্কৃত বিলকে প্রশাসনিক ভাষায় নবসৃষ্ট বিল বলা হয়। এ সকল বিলের মালিক সরকার।
সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় মূলত: বিলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। যুগোপযোগী সংস্কার ও উন্নয়নের প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নিকট জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ৩(ক) ধারা জনকল্যাণমূখী পরিকল্পনার মাধ্যমে জলমহাল সমূহ হস্তান্তর করা হয়। সরকারী জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা গত ২৩/০৬/২০০৯ ইং তারিখে চূড়ান্ত হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে জলমহাল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের জন্য উক্ত নীতিমালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রচলিত টেন্ডার প্রক্রিয়ার সাথে সাথে ’সমঝোতা স্মারক’ এবং জলমহাল কমিটি কর্তৃক আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে জলমহাল বন্দোবস্ত দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধুমাত্র প্রকৃত মৎস্যজীবী ও সংশ্লিষ্ট জলমহালের নিকটবর্তী গ্রামের মৎস্যজীবী সংগঠন জলমহাল পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। ২০ একরের উপরে জলমহালের ক্ষেত্রে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট জেলা জলমহাল কমিটি ও ২০ একরের নীচের জলমহালের ক্ষেত্রে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা জলমহাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা কমিটিতে উপদেষ্টা হিসাবে মাননীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা কমিটিতে ১ম উপদেষ্টা হিসাবে মাননীয় সংসদ সদস্য ও ২য় উপদেষ্টা হিসাবে উপজেলা চেয়ারম্যান দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। বন্দোবস্ত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মৎস্যজীবী সংগঠনকে অবশ্যই সমবায় বিভাগ থেকে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে। কোন সমিতিই ২টির বেশী জলমহাল নিতে পারবে না। তবে প্রকল্পভুক্ত জলমহালসমূহ সমঝোতা স্মারক ও প্রকল্প নীতিমালা মোতাবেক পরিচালিত হবে। প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সংজ্ঞা মোতাবেক প্রকৃত মৎস্যজীবী চিহ্নিত করবেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এবং অনুমোদন করবেন উপজেলা জলমহাল কমিটি। চিহ্নিত মৎস্যজীবী ছাড়া অন্য কেউ জলমহাল ব্যবস্থাপনায় জড়িত থাকতে পারবেনা। উপজেলা ও জেলা কমিটি প্রতিবছর ৩০শে চৈত্রের মধ্যে জলমহাল সরেজমিনে পরিদর্শন পূর্বক ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। বর্ষা মৌসুমে বন্দোবস্ত প্রাপ্ত জলমহালের সীমানার মধ্যেই পাহাড়া ও মৎস্য আহরণ করতে হবে। মৎস্য অধিদপ্তর ’মা’ মাছ রক্ষার জন্য কিছু সংখ্যক জলমহাল ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করবে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জলমহালের ভৌত ও জৈবিক গুণাগুন সম্পর্কে জরিপ পরিচালনা করা যাবে। তথাপিও জলমহাল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের জন্য জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর কিছু সংশোধনী প্রয়োজন। যেমন:
(১) জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ৩(ক) ধারা মোতাবেক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরিত জলমহালগুলি সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে এবং প্রকল্প নীতিমালার আলোকে ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা রয়েছে। বিষয়টি পরীক্ষা করে ১০+১০বছর মেয়াদী উল্লেখ করা উচিত।
(২) সরকারী জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর অনুচ্ছেদ ৪ এর (খ) অনুযায়ী জলমহালের ইজারা মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বিগত ৩ বছরের ইজারামূল্যের গড় এর স্থলে বিগত ৩ মেয়াদের ইজারামূল্যের গড় বিবেচনায় নিতে হবে। ৩ বছরের গড় ইজারা হিসাব করলে তা মূলত অপরিবর্তিতই থাকে। কিন্তু বিগত ৩ মেয়াদের ইজারামূল্য হিসাব করলে তা যৌক্তিক পর্যায়ে আসে এবং তা দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
(৩) সরকারী জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর অনুচ্ছেদ ৪ এর (খ) অনুযায়ী কোন জলমহাল ইজারামূল্য না পাওয়া গেলে তা নির্ধারণের জন্য জেলা প্রশাসককে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু অস্বাভাবিক উচ্চ ইজারামূল্য কিংবা ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে যে সকল জলমহাল মৎস্যজীবীদের কাঙ্ক্ষিত জীবনমান উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখবে না, এমন ক্ষেত্রে কোন নির্দেশনা নেই। ফলে অনেক জলমহাল বছরের পর বছর অবিক্রিত থাকে। উক্ত সমস্যার সমাধানের ক্ষমতাও জেলা প্রশাসককে প্রদান করা উচিত।
(৪) জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ৬(১) ধারা মোতাবেক জেলা/উপজেলা জলমহাল কমিটিতে বিভিন্ন দপ্তরের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় এলজিইডি জলমহালের ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে সরাসরি জড়িত বিধায় নির্বাহী প্রকৌশলী/উপজেলা প্রকৌশলীকে জেলা/উপজেলা জলমহাল কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত করা প্রয়োজন।
(৫) জলমহাল নীতিমালার ৫(৪) ও ৬/৩(ক) ধারা মোতাবেক একটি সমিতি ২০ একরের উপরে ২টি, এবং ২০ একরের নিচে ২টি জলমহাল পাবে বলা হয়েছে। আবার উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় ১টি জলমহাল পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এক বছরে ২০ একরের উপরে ২টি, ২০ একরের নিচে ২টি পাবে না। প্রতি বছর (২+২+১)= ৫টি জলমহাল পাবে, সে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না। এই বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।
(৬) জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালার ৬(২৬) নং ধারা মোতাবেক বর্ষা মৌসুমে যখন ইজারাকৃত জলাশয় সংলগ্ন প্লাবনভূমির সাথে প্লাবিত হয়ে একক জলাশয়ে রুপ নেয়, তখন ইজারাদারের মৎস্য আহরণ অধিকার কেবল ইজারাকৃত জলাশয়ের সীমানার ভিতর সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে জলমহালের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে না বলা হয়েছে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে সকল জলমহাল ভাসমান পানির ভিতরে থাকায় জলমহালের মাছ তখন এর বাহিরেও যেতে পারে আবার ভেতরেও আসতে পারে। তখন জলমহালের আয়তনের চেয়ে অতিরিক্ত ভাষান পানির এলাকায় মাছ শিকার না করার জন্য, অবৈধ শিকারীদের বাধা দেয়ার এখতিয়ার জেলেদের থাকা উচিৎ। তা না হলে, মৎস্য শূন্য হয়ে যাবে এই হাওর অঞ্চল।
(৭) সহব্যবস্থাপনা/সমাজভিত্তিক সহব্যবস্থাপনাকে এই নীতিমালায় অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন।
(চলবে…)