বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলো থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার কারণ এবং ঝরে পড়া রোধে আমাদের করণীয়

মোহাম্মদ নাঈম হাসান
উন্নয়নকর্মী ও গবেষক nayeem5847@gmail.com

Ended soon

বর্তমান বিশ্বে শিক্ষাকে বিনিয়োগ বলা হয়। যে কোনো অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে শিক্ষাই গতিশীল ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার মাধ্যমে একজন সুশিক্ষিত এবং দক্ষ কর্মী গঠিত হয়, যা দিয়ে একটি সমাজে বিভিন্ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মেয়েদের শিক্ষিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, সুশিক্ষিত মেয়েদের আয় ছেলেদের অপেক্ষা ভালো এবং তারা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং শিক্ষিত সমাজ তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে(1,2)।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিশুরা আগের চেয়ে অধিক হারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করলেও, তাদের মধ্যে মেয়ে শিশু বা ছাত্রীদের অর্ধেকই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারে না। বাংলাদেশের অনেক স্থানে এখনও অনেক পরিবার আছে, যাদের মেয়ে সদস্যরা জীবনের একটা পর্যায়ে স্কুলে ভর্তি হলেও প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই তাদের স্কুল ত্যাগ করতে হয়। আর এই চিত্রটি গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
অনেক গবেষণায় মেয়েদের স্কুলে উপস্থিতি এবং ঝরে পড়ার মধ্যে সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। এই সংখ্যাটি মাধ্যমিক স্তরে (১৩-১৬ বছর) সব চেয়ে বেশি(3)। যেখানে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আর্থিক, বৈবাহিক এবং সন্তান জন্মদানের ভূমিকার সাথে মিলিত হয়েছে লিঙ্গভিত্তিক সামাজব্যবস্থা, স্কুলের অনুকূল পরিবেশ, সমাজ দ্বারা নিরুৎসাহিত হওয়া ইত্যাদি। স্কুল থেকে স্কুল স্থানান্তরও মাধ্যমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়ার পিছনে একটি বড় কারণ। কিন্তু ঝরে পড়ার সব কারণগুলোকে একত্রিত করে তার উপর প্রভাব বিস্তারকারী সম্ভাব্য সকল কারণ চিহ্নিত করা এবং সব থেকে বেশি প্রভাব বিস্তারকারি কারণ সামনে নিয়ে আসার মতো গবেষণা বাংলাদেশে এখনও হয়নি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের একজন ছাত্র ২০১৯ সালে তার একটি গবেষণায় এসব বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করছেন। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার সকল কারণ তুলে ধরা এবং প্রধান কারণ চিহ্নিত করা। বিস্তারিত বলতে গেলে, এই গবেষণা থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রশ্নগুলো নিম্নরূপ:
• ঝরে পড়া কতটা সাধারণ/স্বাভাবিক?
• বিদ্যালয়ে উপস্থিতি এবং/অথবা ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা বেশি বা কম?
• কোন ধরণের মেয়েদের বিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি?

২০২০ সালে গবেষণাটির উপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা প্রবন্ধ জার্নাল এ প্রকাশিত হয়। এই গবেষণায়, বাইভ্যারিয়েট এবং মাল্টিপল লজিস্টিক রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিলো। এই অনুসন্ধানে বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (MICS) ২০১২ ডেটা নির্বাচন করা হয়েছিলো। এই গবেষণাটি ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মেয়েদের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল, কারণ এই সময়ে সাধারণত মেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকে ৷ ভালো মডেল নির্বাচন এবং ডাটা সেট ফিটিং করার জন্য স্টেপওয়াইজ পদ্ধতি (stepwise method) ব্যবহার করা হয়েছিল। সার্ভেটি করার সময়ে, ৪৮০০ জন মেয়ের মধ্যে ২৯.১% বিদ্যালয়ের বাইরে ছিল এবং ৭০.৯% বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল। মেয়েদের ঝরে পড়া (হ্যা/না) ডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবল (dependent Variable) এবং স্টেপওয়াইজ মাল্টিপল লজিস্টিক রিগ্রেশন মডেল থেকে প্রাপ্ত মেয়ের বৈবাহিক অবস্থা, এলাকা, বিভাগ, সম্পদের সূচক, ধর্ম, মা এবং বাবার জীবিকা এবং পারিবারিক শিক্ষা একটি মেয়ের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ এবং এই কারণগুলোই শুধুমাত্র ইন্ডিপেনডেন্ট ভেরিয়েবল (independent Variable) হিসেবে মডেলে বিবেচনা করা হয়।
সর্বমোট ৪৮০০ জন মেয়ের মধ্যে, যথাক্রমে ১৫ (৩৬.৪০%), ১৬ (৩৪.১০%), এবং ১৭ বছর বয়সী (২৯.৫০%) মেয়েরা যথাক্রমে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে, ৭.২০% বিদ্যালয়ের বাইরে ছিল এবং ২৯.২০% মেয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল। একইভাবে, ১৬ এবং ১৭ বছর বয়সী মেয়েদের বিদ্যালয়ের বাইরে থাকার হার ছিল যথাক্রমে ১০.৬০% এবং ১১.৩০%। স্টেপওয়াইজ মাল্টিপল লজিস্টিক রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, অবিবাহিত মেয়েদের তুলনায় বিবাহিত মেয়েরা উল্লেখযোগ্যহারে, প্রায় ১১ গুন [Odds Ratio (OR): 11.06; 95% Confidence Interval (CI): 9.05–13.56) বেশি বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে পারে। পরবর্তী যে কারণটি সব থেকে বেশি প্রভাবিত করে, তা হচ্ছে পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা । এই গবেষণাটি থেকে দেখা গেছে যে, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েদের তুলনায় অস্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরা উল্লেখযোগ্যহারে, প্রায় ৬ গুন [Odds Ratio (OR): 6.18; 95% Confidence Interval (CI): 4.52-8.31) বেশি বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে পারে।
বর্তমান গবেষণায় দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় যে, অনেক কারণেই উল্লেখযোগ্যহারে মেয়েদের ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়তে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলোর সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, এটিই প্রধান কারণ হিসাবে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনটি থেকে উল্লেখ করা যায় যে, বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের মেয়েদের ঝরে পড়ার জন্য একটি প্রধান কারণ । ঝরে পড়ার ঝুঁকি কমানোর জন্য এমন কৌশল হাতে নেয়া প্রয়োজন যা মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখতে সহায়তা করে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্কুলভিত্তিক কর্মসূচী বাড়ানো এবং সরকারের এ কর্মসূচীকে আরও বেগবান করা উচিত। এছাড়াও পাঠ্যক্রমকে আরও প্রাসঙ্গিক এবং উন্নত করা, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা হ্রাস করে শ্রেণিকক্ষের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, শিক্ষকদের দক্ষতার উন্নয়ন এবং শিক্ষার মান উন্নত করা ইত্যাদি বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন।
উক্ত গবেষণা সম্পর্কে বিষদভাবে জানতে আগ্রহী হলে নিচের লিংকটি থেকে দেখে নেয়ার অনুরোধ রইলো।
https://www.banglajol.info/index.php/JSR/article/view/41579?fbclid=IwAR16PZ130ob8jJkGYTZ3VzJ6S9uoSDAr1zYXM0MC0Nolss2WSsVDaxrx25g

References

  1. Hossain, M. A. & Tisdell, C. A. Closing the gender gap in Bangladesh: Inequality in education, employment and earnings. Int. J. Soc. Econ. 32, 439–453 (2005).
  2. Gender inequality in Bangladesh – Wikipedia. https://en.wikipedia.org/wiki/Gender_inequality_in_Bangladesh#cite_note-HDI-1.
  3. Prakash, R. et al. Correlates of school dropout and absenteeism among adolescent girls from marginalized community in north Karnataka, south India. J. Adolesc. 61, 64–76 (2017).
ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন