জলমহাল ব্যবস্থাপনাঃ সরকারী উদ্যোগে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সফলতা-(র্পব -৩)

চৌধুরী আব্দুল হাই
উন্নয়নকর্মী ও লেখক

অক্টো ২৮, ২০২১ | প্রকৃতি ও প্রতিবেশ

Ended soon

বহুমূখী উন্নয়ন কর্মকান্ডের দ্বারা সুনামগঞ্জের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্রমোচনের লক্ষ্য অর্জনে International Fund For Agricultural Development (IFAD) এর অর্থায়নে সুনামগঞ্জ জেলায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এলজিইডির অধীনে একটি বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হয়েছে। প্রকল্পের নাম ছিল সুনামগঞ্জ কমিউনিটি ভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (Sunamgonj Community Based Resource Management Project বা SCBRMP)। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল জুন ২০০৪ হইতে জুন ২০১৪ইং পর্যন্ত। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের আওতায় সরকারী জলমহাল নীতিমালা মোতাবেক বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইসতেহারের “জাল যার জলা তার” নীতির আলোকে ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ৩০০টি জলমহাল সুনামগঞ্জের দরিদ্র মৎস্যজীবিদের মধ্যে ১০ (দশ) বছর করে দুই ধাপে ২০ (বিশ) বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদে হস্তান্তরের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ২৫০টি জলমহাল প্রকল্পের ৭১১৫ জন সুবিধাভোগীদের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং এর মাধ্যমে সরকারী জলমহালে দরিদ্র মৎসজীবিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়। হস্তান্তরিত জলমহালের মধ্যে ২৫০টি বিল খননের মাধ্যমে ভরাটকৃত জলমহাল পনুরুদ্ধার, হিজল করচ জলজ বৃক্ষ রোপণ ও মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনসহ ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ পূর্বক মৎস্য আবাসস্থল পুনরুদ্ধার করে বিল সমূহে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়। ফলশ্রুতিতে International Union for Conservation of Nature (IUCN) বিপন্নপ্রায় ও মহাবিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতিসমূহের মধ্যে প্রকল্পের পর্যবেক্ষনকৃত কয়েকটি বিলে মহাশোল, ঘোড়ামুখ, বাঘা আইড়, বাচা, দেশী সরপুঁটি, শিলং, রিটা, ঘাউড়া প্রভৃতি মৎস্য প্রজাতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে যা আন্তর্জাতিক সংস্থা WorldFish এর গবেষণায় উঠে এসেছে। মাছের যাতায়াত ও কৃষি কাজে সেচের সুবিধার জন্য মোট ৩৩ কিঃমিঃ খাল খননের মাধ্যমে জলমহালের সাথে নদী/হাওরের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে মাছের প্রজনন বৃদ্ধিসহ বিল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৯৫০০টি দরিদ্র মৎস্যজীবি পরিবারের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। দেখা গেছে যে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৎস্যজীবি সম্প্রদায় নিম্নলিখত সুফল পেয়েছেনঃ
i. তারা বিল ব্যবস্থাপনা করে লাভবান হয়েছেন। দেখা গেছে যে, মৎস্যজীবী সদস্যরা জনপ্রতি বছরে ২০০০ টাকা থেকে ৩০০০০ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ পেয়েছেন।
ii. এই ব্যবস্থাপনায় প্রকৃত মৎস্যজীবীরা বিল ব্যবহারে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কেননা, ইতোপূর্বে স্থানীয় প্রভাবশালী ওয়াটার লর্ড-গণ উক্ত জলমহালগুলো ভোগ দখল করতো। কিন্তু প্রকল্পের প্রচেষ্টায় গঠিত মৎস্যজীবি সংগঠনগুলো সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় উক্ত জলমহালগুলো প্রভাবশালীদের হাত থেকে মুক্ত করে তা এখন নিজেরা উপভোগ করছে।
iii. মৎস্যজীবীদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। মৎস্যজীবীরা সুষ্ঠ গণতন্ত্রের উপায়ে প্রতিবছর গোপন ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের উক্ত সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তনের পদ্ধতির কারণে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশ হওয়ায় উক্ত নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে।
iv. মৎস্যজীবীদের মধ্যে নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার ফলে স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্টানগুলোর নির্বাচনে তারা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও তাঁরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন।
v. নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ায় তাঁরা বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছেন এবং এর ফলে সামাজিকভাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর তাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত থাকছে।
vi. উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে জলমহাল ব্যবস্থাপনায় মহিলাদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা পুরুষদের পাশাপাশি সংগঠন পরিচালনা, মাছ বাছাই ও জলজবৃক্ষ সংরক্ষণে সরাসরি অংশগ্রহণ করে পুরুষদের সমান আয় করছেন।
vii. জলমহাল ব্যবস্থাপনার এ নতুন ধারণার বিকাশ ঘটায় ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় কমিউনিটি ভিত্তিক বিল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম একটি টেকসই ব্যবস্থাপনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সিবিআরএমপি প্রকল্পের মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় স্থানীয় দরিদ্র মৎস্যজীবিদেরকে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের জন্য জলমহাল হস্তান্তর প্রক্রিয়া সমাজ ভিত্তিক বিল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইফাদ ও সরকারের আই.এম.ই.ডি. ২০০৭ এবং ২০১১ সালে প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রকল্পটির কার্যক্রম অন্যান্য হাওর জেলায় বিস্তারের জন্য সুপারিশ প্রদান করে এবং প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে Sustainable Entity হিসেবে এ প্রকল্পের কার্যক্রম অন্যান্য হাওর-বাওর বেষ্টিত জেলায় চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে (তারিখ-২৪/০৫/২০০৭ইং)। তাঁরা আরও উল্লেখ করে যে, স্বল্প ব্যয়ে ও টেকসই প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দরিদ্র মহিলাদের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নে অত্র প্রকল্পে গৃহীত উদ্যোগটি দেশের হাওর-বাওর বেষ্টিত এলাকায় সম্প্রসারণ করা যেতে পারে (তারিখ-১২/০৭/২০১১ইং)। বর্তমানে তারই ধারাবাহিকতায় হাওর অঞ্চলের পাঁচটি জেলা নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে আরও দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে।

সমাজভিত্তিক জলমহাল ব্যবস্থাপনা কাজটি মূলত দরিদ্র মতস্যজীবীদের জীবনমান উন্নয়নমূলক কাজ, যা সরকারের দারিদ্র বিমোচন অঙ্গিকারের সাথে সম্পর্কিত। তাই দরিদ্র মৎস্যজীবিদের দারিদ্র সীমার বাহিরে নিয়ে আসার লক্ষ্যে জলমহাল ব্যবস্থাপনার কাজ সুষ্ঠুভাবে করা উচিত। প্রচলিত জলমহাল ব্যবস্থাপনার বাহিরে সরকারের আওতায় প্রকল্পভিত্তিক জলমহাল ব্যবস্থাপনার এটি একটি নব উদ্যোগ, যার সুফল ইতিমধ্যে প্রমাণিত। প্রকল্পের আওতায় মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র বা কার্ডধারী দরিদ্র এবং প্রকৃত মৎস্যজীবিদের নিয়ে জলমহালগুলো ব্যবস্থাপনা করা হয়। সেখানে প্রকল্প কর্তৃক বিল খনন/পুনঃখনন, জলজ বৃক্ষরোপণ ও অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়। ফলে মাছের উৎপাদন ও জীববৈচিত্র বৃদ্ধি পায়। এই সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিটি ভূমি মন্ত্রনালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং মৎস্য অধিদপ্তর এর সহযোগিতায়, সরকারের জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ ও মৎস্য সংরক্ষণ আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে জলমহালের Biodiversity রক্ষা করা এবং বিল সংলগ্ন প্রকৃত মৎসজীবিদের ঐক্যবদ্ধ করে হাওর অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা ও দারিদ্র বিমোচন করার একটি উৎকৃষ্ট উপায় হতে পারে।

সমাপ্ত

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন