Ended soon
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ এই ৭টি জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলকে হাওরাঞ্চল বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৭৬২ সালের এপ্রিল মাসে ৮.৮ মাত্রা এক ভূমিকম্পে ডাউকি ফল্টের চ্যূতির কারণে মধুপুর গড় এবং হাওর এলাকার সৃষ্টি হয়। এরপর ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা নদী তার গতিপথ বদলায়। এসব কারণে এই বিস্তীর্ণ এলাকা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চাইতে ভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২৩০০ মি.মি. কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের হার অনেক বেশি। সিলেটে বছরে ৪০০০ মি.মি. এবং সুনামগঞ্জে ৫০০০ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের চাইতে প্রায় ১৫ গুণ ভারতীয় এলাকার বৃষ্টিপাতের পানি বয়ে যায় বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল, খাল-বিল-হাওরে। ভারতের মেঘালয় ও বরাক উপত্যকার বৃষ্টির পানি সবার আগে সুনামগঞ্জের হাওরের দিকে ধাবিত হয় এবং এসব এলাকা পূর্ণ করে তারপর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে।
হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ৭ জেলার মোট ৭০টি উপজেলার মধ্যে ৪৮ টি উপজেলা হাওর এলাকার মধ্যে অবস্থিত। এসব জেলার ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬১ হেক্টর নিয়ে হাওর এলাকা। জেলাগুলোর জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার।
বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার সমস্যা-সংকট যেন জীবনেরই অংশ। প্রায় প্রতিবছরই উজানের পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যা কবলিত হয়ে পরিবেশ ও জীবন-জীবিকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। হাওর অঞ্চলের কৃষিজমি বছরে ৬ মাস জলমগ্ন অবস্থায় থাকে। বাকি ৬ মাস একমাত্র ফসল বোরো ধানের উপরে নির্ভর করতে হয় কৃষিজীবী হাওরবাসীর। হঠাৎ আগাম বন্যায় বোরো আবাদ তলিয়ে গিয়ে, প্রধান নদী ও খালসমূহের পানি ধারণ ক্ষমতা কমে-শুকিয়ে পানি নিষ্কাশনের সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় বোরো চারা/বীজ রোপনেও দেরি হয়ে যায়। নদী-খালের নাব্যতা কমে যাওয়ায় সেচের সমস্যা মোটামুটি স্থায়ীরূপ নিয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৭৩ টি হাওর আছে। এতে যে পরিমান ফসল ও মাছ উৎপাদন হয় তা দিয়ে পুরো দেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের খাদ্য ও পুষ্টির যোগান হয়। কিন্তু আগাম বন্যার কারনে এ হাওর এলাকায় বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়। হাওর এলাকায় আগাম বন্যা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে গত ৫০ বছর ধরে নানা গবেষণা ও কাজ হয়েছে কিন্তু কাঙ্খিত কোনো ফলাফল আসছে না।
গত কয়েকদিন ধরে, হাওড়ের বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে ফসল নস্ট হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে। হাওরে হঠাৎ বন্যা একটা সাধারণ বিষয়। প্রায় প্রতি বছর এরকম হয়ে থাকে যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সাধারণ কৃষক ও জনগণ। আমাদের দেশের হাওরে পরিবেশ ব্যাবস্থা ও ভৌগলিক অবস্থানের সাথে দুনিয়ার কোন স্থানের তুলনা চলে না। এ হাওরে বর্ষা ও শুস্ক মৌসুমে দুই ধরনের বিপরীত অবস্থা বিরাজ করে। হাওরে বসবাসরত মানুষরা মুলত বোরো ধানের চাষ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। আর এই ফসল ঘরে তোলার মোক্ষম সময় হচ্ছে এপ্রিল এর শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের মাঝা মাঝি পর্যন্ত । কিন্ত দুর্ভাগ্যর বিষয় ঠিক এই সময়ে বা তারও আগে চেরাপুঞ্জি ও এর আশেপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাতের ফলে উপর থেকে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় ফসল। এর ফলে সম্বলহীন হয়ে পরে হাওরের মানুষ গুলো।
এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়, যার মধ্যে ডুবন্ত বাঁধ অন্যতম। হাওরের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্যে বড় কোনো অবকাঠামো করা যাবে না। এমন কিছু একটা করতে হবে যা কিনা আগাম বন্যা ঠেকিয়ে রাখতে পারে। এই ধারনা থেকে আসলো ডুবন্ত বাঁধ যা কিনা বর্ষার সময় ডুবে যাবে ও পানির প্রবাহ ঠিক রাখবে, শুস্ক মৌসুমে আবার জেগে উঠবে ও আগাম বন্যা ঠেকাবে। কিন্তু এখন আমরা কি দেখছি, বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকছে , এবং ফসলহানী ঠেকানো যাচ্ছে না। এসবের কারন উল্লেখ করতে গেলে অনেক বিষয় উঠে আসবে কিন্ত মুল কারন হিসাবে যা পাওয়া গেছে তা হোল বাঁধ গুলো টেকসই নয় অনেক ক্ষেত্রে তা পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে তৈরি করা হয় না। বেশরভাগ ক্ষেত্রে দুর্যোগ ঝুকি তে পড়ার পরে বাঁধ ঠেকিয়ে রাখার কাজ বেশি যা কিনা ভালো ফলাফল বইয়ে আনে না ।
জাইকা বাংলাদেশ অফিস ২০১৩-১৪ সালে হাওর মাস্টার প্ল্যান কে অনুসরন করে একটা গবেষণা করে বন্যা ব্যাবস্থাপনা ও জীবিকা উন্নয়ন এসব নিয়ে। এর উপর ভিত্তি একটা প্রকল্প তৈরি হয় যার নাম “হাওর ও অঞ্ছলের বন্যা ব্যাবস্থাপনা ও জিবনমান উন্নয়ন প্রকল্প” এবং এই প্রকল্প পানি ঊন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করা শুরু করে। এরপর ২০১৫ থেকে কাজ করা আরম্ভ হয়। এই প্রকল্পে ফসল রক্ষা বাঁধ মুল উদ্দেশ্য হলেও হাওরের জীবন মান ঊন্নয়ন অন্যতম লক্ষ্য ছিল । কাজের পরিধি অনেক ব্যাপক । বাঁধ নির্মাণ, খাল ও বিল খনন, ড্রেজিং, রাস্তা / ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ, কৃষি সম্প্রসারন, মৎস্য জীবিদের উন্নয়ন সহ আরও বেশ কয়েকটি কাজ ।
পাঁচটি জেলার ২৯ টি হাওর কে বিবেচনা করে প্রায় ২৫ টি ঊপজেলায় জাইকা কাজ শুরু করে । টেকসই ও পরিবেশ সহনশীল বাঁধ নির্মাণে প্রথম বছর পরিকল্পনা ও ডিটেইল ডিজাইন নিয়ে কাজ করা হয় । এর মাঝে কিছু পরীক্ষামুলক বাঁধ তইরি করা হয় , যা কিনা ২০১৭ র আগাম বন্যায় কিছুটা আক্রান্ত হয় । বিষয়টা অনুধাবন করে ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন এনে আবার কিছু বাঁধ তৈরি করা হয় , যার মধ্যে কয়েকটি আবার ২০২০ এর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় । এবার চিন্তা আরও বেড়ে গেলো । কারণ খুজে প্রাথমিক ভাবে যা পাওয়া গেলো তা হলো, হাওর মাস্টার প্ল্যান কিছুটা মিস গাইড করেছে। মাস্টার প্ল্যান এ বর্ণিত বাঁধের এলাকা গুলোতে অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেলো আসলে প্ল্যানের তথ্যে ঘাটতি আছে, অর্থাৎ যেখানে বাঁধের কথা বলা হয়েছে সেখানে বাঁধ ফিজিবল না, বা করলেও অনেক কিছু বিবেচনা করতে হবে।
শুরু হলো নুতন পরিকল্পনা। এক একটা হাওরের নুতন করে জরিপ করা হয় যাতে করে কোন জায়গায় দুর্বল , কেন দুর্বল, কি করলে সবল হবে তা নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা। বাঁধের কম্পেকশান ৮৫% এর উপরে নিয়ে যাবার জন্য রোড রোলার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতে করে পানি আসা ও যাওয়ার ব্যবস্থা গুলোকে টেকসই করা যায় । প্রায় ২০ বছর বা তারও বেশি রিটার্ন পিরিয়ড ধরে বাঁধের উচ্চতা নির্ধারণ , বাধের স্লপ কে যথাসম্ভব প্রসস্থ করা , নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা করা, যেসব জায়গায় ভেঙ্গে যায় সেটুকু মজবুত করণ , ভেতরে খাল গুলোর খনন, স্লাপ এর ক্ষয় কমানোর জন্য বিন্নি ঘাস ও বনায়নের জন্য ইত্যাদি সহ অনেক ধরনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছিল। সবশেষে স্থানীয় এলাকাবাসীদের নিয়ে বর্ষার পরেই নিয়মিত পরিচর্যা শুরু হয়।
গত কয়েকদিনের ছবি ও ভিডিও দেখা বুঝা গেলো জাইকার অর্থায়নে প্রায় ৩৫০ কিমি এর উপর বাধের কোথাও আক্রান্ত হয়নি , কয়েক হাজার হেক্টর জনির ধান অক্ষত আছে । আগাম বন্যার পানি মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যাবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন, এর মধ্যে ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। ফুটবে হাসি সবার মাঝে। বর্তমানে এই প্রকল্পে চেষ্টা করা হচ্ছে ধানের একটা জাত উদ্ভাবন করতে, যা কিনা ১০০/১১০ দিন বা তার ও কম সময়ে ঘরে তোলা যাবে। এতে করে আগাম বন্যার ভয় আর থাকবে না। পাশাপাশি আগাম বন্যার সতর্কবার্তা কিভাবে আরও আগে দেয়া যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে।
পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবিক জ্ঞান থেকে বলা যায় গতানুগতিক পদ্ধতিতে মাটি ফেলে হাওরের বাঁধ রক্ষা করা যাবেনা। প্রতিটি অবকাঠামোর পেছনে পর্যাপ্ত অর্থ ও সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং সবার উপরে গুণগত মান ঠিক রাখতে হবে।