Ended soon
যখন সারা দুনিয়া উন্নতির চরম শিখরে উঠাকে বিভিন্ন ভাবে উদযাপন করছে, যখন মানুষ মঙ্গলে নিজেদের আবাস গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে বিভোর, ঠিক তখন করোনা ভাইরাস পুরো দুনিয়াকে নাড়া দিয়ে গেল এবং মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও বুদ্ধিমত্তাকে একপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলা করার পাশাপাশি যে বিষয়টা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে সেটা হলো, সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা টিকিয়ে রাখা ও পরিস্থিতির সাথে পাল্লা দিয়ে টেকসই করা। করোনাকালীন সময়ের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা তথ্য উপাত্ত দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে যার মধ্যে সাধারণ মানুষের আয় ব্যয় নিয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে ২০২০ ও ২০২১, এই দুই বছরে সারা বিশ্বের ১১ কোটি থেকে ১৫ কোটি লোক নতুন করে গরিব হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে শুধু ২০২০ সালেই ৮ কোটি ৮০ লাখ থেকে সাড়ে ১১ কোটি লোক এমন বিপাকে পরবে। গত অক্টোবর, ২০২০ এ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আরেক সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গরিব লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র হার সাড়ে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। যারা দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করতে পারেন না, তাঁদের দরিদ্র হিসেবে ধরে বিশ্বব্যাংক।
করোনাকালে বাংলাদেশের দরিদ্র পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক গবেষণা আছে। সব প্রতিষ্ঠানই বলেছে, দারিদ্র বেড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলেছে, গত এপ্রিল থেকে জুলাই ২০২০ এর মধ্যে দারিদ্র হার ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। কমবেশি ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। এ ছাড়া আগে থেকেই সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনায় দারিদ্র হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত জুন, ২০২০ এ পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় এসেছে, দারিদ্র হার দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এরইমধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে গেছে। কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পরতে শুরু করেছে। হোটেল, রেস্তোরা, পরিবহন শ্রমিক, রিকশা চালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের কোন কাজ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় লকডাউনের কারণে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল, ২০২০ এই এক মাসে অর্থনীতিতে এক লাখ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। পিপিআরসি ও বিআইজিডি গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার প্রথম দিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন, ২০২০ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘ মেয়াদি ছুটি ও লকডাউনের প্রভাবে গত এপ্রিল, ২০২০ এ গরিব মানুষের আয় ৭৫ শতাংশ কমেছে। আর গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের আয় ৬৫ শতাংশ কমেছে।
দারিদ্র বেড়েছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর, করোনায় শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে। লাখ লাখ কর্মজীবী বেকার হয়ে গেছে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কি ধরণের প্রভাব পরেছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বর, ২০২০ একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চ, ২০২০ এ প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা। পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় বেকারত্ব ওই সময়ে দশ গুণ বেড়ে যায়। আড়াই শতাংশ বেকারত্ব হার পৌঁছে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থনীতি খুলতে শুরু করায় জুলাই, ২০২০ থেকে বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সেপ্টেম্বরে এসে বেকারত্বের হার আবার ৪ শতাংশে নেমে আসে। এত দ্রুত বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ করোনার প্রথম তিন-চার মাস যত বেকার হয়েছেন, তাদের অনেকেই এখনো কাজ পাননি। চাকরির বাজার এখনো আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত গত বছরে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পরেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মূলত- কৃষি, সেবা এবং শিল্প খাতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্পোখাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান এখন ১৪ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৮০ লাখ শিল্প উদ্যোগ আছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প। বাকি দুই শতাংশ শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাত।
দেশের জিডিপি যদি ৩২০ বিলিয়ন ডলার হয়, সেখানে শিল্পের অবদান ৩৫ শতাংশ, এবং যার ৯৫ শতাংশই বন্ধ ছিল মহামারীর শুরুর তিন মাসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী গার্মেন্টস রপ্তানি এবং রেমিটেন্স- এ দুটো মিলিয়ে বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান প্রায় ১৮ শতাংশ। গত ২০২০ এর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২০ এপ্রিল-জুন সময়ে ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে ৬৯ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার পোশাক বানানো হয়েছিল।
এবার দেখা যাক বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে , যদিও পুরো বিশ্ব জানে বাংলাদেশ এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও নিজেদের অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে ও মানুষ বিভিন্ন ভাবে সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে। এই করোনাকালীন সময়ে সরকারের একটা লক্ষ্য ছিল ২০২১ এ দেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা। বাস্তবে সেটা কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও সরকারি উদ্যোগ সমূহের সফলতা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কভিড-১৯ মহামারির মুখোমুখি হয়েছে, যা বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষকে হতদরিদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে।
বিভিন্ন সেক্টরে গতিশীলতা আনয়ন, সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার লক্ষ্যে সরকার বেসরকারি খাতে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এতে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে নগদ অর্থসহায়তা প্রদান করে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে অব্যাহত রেখেছে। যা অনেক উন্নত এবং উদীয়মান দেশকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশের ইতিবাচক অবস্থান নিশ্চিত করেছে। গত দুই বছর বন্যা ও নদীভাঙনের পাশাপাশি আম্পান ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের আঘাত করায় তারা আরও চরম দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার মধ্যে পৌঁছেছে। এই অস্বাভাবিক কোভিড-১৯, আম্পান এবং বন্যার মুখোমুখি হওয়ার পর উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে অত্যন্ত নগণ্য অতিরিক্ত সহায়তা পাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও নেতৃত্বের সঙ্গে সব ইতিবাচক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে একটি অনুকরণীয় স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, যা বাংলাদেশকে ‘জলবায়ু দুর্বলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শিক্ষক’ করে তুলেছে বলে জাতিসংঘের অষ্টম সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন অবহিত করেছেন।
সরকার দারিদ্র, বৈষম্য, ঝুঁকি এবং সব ধরনের দুর্বলতা মোকাবিলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল অনুমোদন করেছে। অবহেলিত মানুষ বিশেষ করে নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এসএসএনপির অধীনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং প্রবল ঝুঁকিগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। জীবনব্যাপী ঝুঁকি নিরসনের লক্ষ্যে আরও ভালো সমন্বয় এবং ভালো ফল পেতে সব প্রোগ্রাম সুসংহত করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষার অধীনে উল্লিখিত কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষাবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা, মাতৃভাতা, বিধবা, দুস্থ ও নিঃস্ব নারীদের জন্য ভাতা, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি এবং সুবিধাবঞ্চিত হিজড়াদের জন্য জীবনব্যাপী উন্নয়ন কর্মসূচি, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির মাধ্যমে হতদরিদ্র পরিবারের উন্নয়ন, চরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমানে ২৮.৭ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এই কর্মসূচি ৪০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের মধ্যে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে। সরকার বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কর্মকাণ্ডে বার্ষিক বাজেটের ১৫ শতাংশ ব্যয় করে, যা ২০৩০ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব সুবিধা গ্রহণ ছাড়াও লোকজন কর্মমুখী শিক্ষা অর্জন করে বিভিন্ন আয়বর্ধক উৎপাদনমূলক কাজে নিযুক্ত হচ্ছে।
সরকার বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচনের জন্য জাতীয় গৃহস্থালি তথ্য চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন কৌশলগুলো সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ ২০৩০ সালের এজেন্ডার লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সুসংহত হয়েছে। প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের জড়িত করার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট সম্পর্কিত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে।