Ended soon
শোলাকিয়া ইদগাহের বয়স
উল্লেখযোগ্য যে, যদিও ১৮২৮ সালে মাঠে প্রথম ঈদের বড় জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল তবে এ বিষয়ে মাঠের আরো প্রাচীন ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ঈদের বড় জামাত ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ হলেও মূলত নামাজ পড়ার জন্য মাঠের কিছু অংশ ব্যবহৃত হতো আরো প্রায় ৫০-১০০ বছর আগে থেকে। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ সাহেবে বংশধরদের মতে বর্তমান মাঠের কিছু আংশ ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ এর ৫০-১০০ বছর আগে থেকেই পাঞ্জাখানা নামাজের স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কিশোরগঞ্জ এর ভূমি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিলাদি বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যে, মোগল আমলে ‘ঈদগাহ পরগণা’ নামে একটি পরগণা ছিল। উক্ত পরগণার অধীন দুইটি মৌজা রয়েছে। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ১০৭ টি মৌজার মধ্যে ঈদগাহ পরগণার অধীন ২টি মৌজা থাকার বিষয়টি এটাই প্রমাণ করে যে মাঠটি মোগল আমলেই ছোট্ট পরিসরে হলেও নামাজের জন্য ব্যবহৃত হতো এবং রাস্তার পশে নামাজের স্থান হিসাবে কিছু জায়গা ব্যবহৃত হতো যা পরবর্তীতে ছোট মাঠ হিসাবে রুপান্তরিত হয়। মাঠের বয়স নিয়ে সৈয়দ সাহেবের পারিবারিক সূত্রের সাথে এ তথ্যের মিল রয়েছে। মাঠের দক্ষিণ দিক দিয়ে অবস্থিত পূর্ব-পশ্চিম ও শহরমুখী রাস্তাটি এ তথ্যকে সমর্থন করে কেননা এক সময় এ ধরণের রাস্তার পাশের খালি মাঠ নামাজের জন্য ব্যবহার করা হতো এবং বর্তমানেও দেশের অনেক স্থানে এ ধরণের খালি জায়গা বা মাঠে পঞ্জাখানার নামাজ পড়তে দেখা যায় যেখানে কোন সুনির্দিষ্ট ইমাম থাকে না বরং নামাজের পূর্ব মুহূর্তে সবার সম্মতিতে বা অনুরোধে বয়োজেষ্ঠ্যদের মধ্য থেকে একজন ইমামতি করে থাকেন।
শোলাকিয়া ইদগাহের প্রথম ইমাম
কথিত আছে যে, ঈদগাহ মাঠ স্থাপনের ঘোষণা দেওয়ার পর উক্ত মাঠে আসন্ন ঈদুল ফিতরের নামাজের ইমাম কে হবেন তা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। কেননা সৈয়দ সাহেব আসন্ন ঈদের জামাতের ইমামতি করার ক্ষেত্রে প্রথমেই অসম্মতি প্রকাশ করেন। কিন্তু জমিদার মহোদয় এবং অন্যান্য শিষ্য ও মুসল্লীদের বার বার অনুরোধের পর পরিশেষে সৈয়দসাহেব ইমামতিতে রাজী হন। কিন্তু তিনি সকলকে জানিয়ে দেন যে, তাহার ইমামতিতে আসন্ন ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হলে তিনি হজ্জব্রত পালন না করে আর বাড়ীতে ফেরত আসতে পারবেন না। কারণ হিসাবে সৈয়দ সাহেব তাহার পীরের ঐ রকম নির্দেশ আছে বলে জানান। সমুদয় মুসুল্লীগণ শাহ সুফী সৈয়দ সাহেবকে প্রথম ইমাম মনোনীত করলেন।
এবার কয়টার সময় নামাজ অনুষ্ঠিত হবে তা নির্ধারণ নিয়েও উপস্থিত সকলই সিদ্ধান্তহীনতায় পরেন। তখন উভয় জমিদার বিষয়টি নিয়ে সৈয়দ সাহেবের সাথে আলোচনা করেন। তখন সৈয়দ আহাম্মদ (র:) সাহেব এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান। কথিত আছে যে, “সৈয়দ সাহেব পূর্বেই ইলহামের মাধ্যমে জ্ঞাত হয়ে এই জামাতে ৩ (তিন) জন কামেল বুজুর্গ শ্বেতশুভ্র লেবাছ পড়ে নামাজে শরীক হবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং পরে দেখা গেল যে সাদা দাড়িযুক্ত তিন জন বুজুর্গ সুদর্শন লোক শে^তশুভ্র লেবাসে মাঠের তিনদিক থেকে এসে মাঠে উপস্থিত হন।” সৈয়দ সাহেব বিষয়টি বুঝতে পারার পর নামাজ শুরু করার ঘোষণা দেন। অতঃপর সৈয়দ সাহেবের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হল স্বপ্রতিষ্ঠিত মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ এবং উক্ত মাঠে ঈদের সর্ব প্রথম ঈদ জামাত। ঈদের জামাত শেষ হওয়ার পর সবাই চলে গেলেন যার যার বাড়ী। কিন্তু শাহ সুফী সৈয়দ আহাম্মদ সাহেব ৩ (তিন) দিন মাঠে অবস্থান করেন এবং চতুর্থ দিন পবিত্র হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে এই ঈদগাহ মাঠ থেকেই যাত্রা শুরু করলেন পবিত্র মক্কা শরীফের দিকে এবং সাথে নিলেন তদীয় ২ (দুই) পুত্র শাহ সুফী হযরত সৈয়দ আনছফ আলী এবং শাহ সুফী সৈয়দ আফছর আলী এবং কিছু মুরিদ। কিন্তু হজ্জ্বের ৩ (তিন) দিন আগে পীরে কামেল শাহ সুফী হযরত সৈয়দ আহম্মদ (রঃ) ইন্তেকাল করেন (মতান্তরে হজ্জ্বের ৩ দিন পর)। হজ্জ্ব পালন শেষে সুফী সাহেবের উল্লেখিত দুই ছেলে শোলাকিয়া নিজ বাড়ীতে ফিরে আসেন এবং তাহারা এখানে সংসারী হন ও দ্বীনের কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন তথা ইসলামের ঐশিবাণী প্রচারে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সৈয়দ আনছাফ আলী ও শাহ সুফী সৈয়দ আফছর আলী সাহেবে উভয়ই ইসলাম প্রচারে বেড় হয়ে যান এবং সংসার ত্যাগী হয়ে পথ অনুসরণ করেন। তবে আজ যারা শোলাকিয়া সাহেব বাড়ীতে অবস্থান করছেন তারা সুফী সাহেবের উক্ত দুই পুত্রের-ই বংশধর।
শোলাকিয়া ইদগাহের নামকরণ
কথিত আছে যে, সুফী সাহেব জামাত শেষে মোনাজাত করেন তাতে এক পর্যায়ে তিনি প্রার্থনা করেন যে, “হে খোদা এই ঈদগাহ্ মাঠে যেন ভবিষ্যতে সোলালাখ মুসুল্লীর সমাগম হয়।” এ ধরণের উক্তি প্রার্থনার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে জানা যায়। উক্তিটিতে ভবিষ্যতে উক্ত মাঠে মুসুল্লীদের প্রাচুর্য্য প্রকাশ করার জন্যই ‘সোয়ালাখ’ সংখ্যাটি ব্যবহার করা হয়েছে বলে সুফী সাহেবের বংশধরগণ ও স্থানীয় জনসাধারণগণ মনে করেন। আর এই সোয়ালাখ কথা থেকেই আজকের “শোলাকিয়া” গ্রামের নামাকরণ হয় এবং সংলগ্ন বর্তমান নরসুন্দা নদীর চর থেকে যে, গ্রামটি সৃষ্টি হয় তা ‘চরশোলাকিয়া’ নামাকরণ লাভ করে ইতিহাস স্থান পায়।
তবে “শোলাকিয়া” নামকরণের আরও দুটো তথ্য পাওয়া যায়। একটি হল সৈয়দ সাহেবের আধ্যাত্বিকতার খ্যাতির কারণে যে ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার জন্য ঐ বছর সোয়ালক্ষ মুসুল্লী উক্ত মাঠে জমায়েত হন এবং নামাজ আদায় করেন। এথেকেই সোয়ালক্ষ শব্দটি পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে শোলাকিয়া নামকরণ হয়। তবে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের দলিলে অত্র এলাকার নাম ‘সুলক্যা’ পাওয়া যায়।
অপর জনশ্রুতি হচ্ছে, জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে যে ভূমির রাজস্ব আদায় করতেন তার পরিমান কোন এক বছর রেকর্ড পরিমান সোয়ালাখ মুদ্রায় দাড়ায়। তবে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে সোয়ালক্ষ মুসুল্লী উক্ত মাঠে জমায়েত হন এবং নামাজ আদায় করেন। এ থেকেই সোয়ালক্ষ শব্দটি পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে শোলাকিয়া নামকরণ হয়-এই জনশ্রুতিটি বেশী গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়।
শোলাকিয়া ইদগাহের আয়তন
আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নত সৈয়দ সাহেবের নেক দোয়ার বরকতে দিন দিন শোলাকিয়া ইদগাহ মাঠে মুসুল্লীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সৈয়দ সাহেব কর্তৃক মাঠ প্রতিষ্ঠার পর এই মাঠ সম্প্রসারণে স্থানীয় অনেকেই জমি দান করেছেন। মাঠ পরিচালনা কমিটি কিছু জমি ক্রয় করেছেন। হয়বতনগর এর জমিদার সাহেব ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাঠ সংলগ্ন তাদের বেশ কিছু পরিমাণ নিজস্ব জমি দান করে তা ঈদগাহের জন্য “ওয়াকফ” করে দেন। বর্তমান মাঠের মোট আয়তন ৭.০০ একরেরও কিছু বেশী।
শোলাকিয়া মাঠ প্রতিষ্টালগ্ন থেকেই এই মাঠ ঐতিহাসিক। দিন দিন শোলাকিয়া ঈদ জামাতের মুসুল্লিদের আগমন ও জমায়েত বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসুল্লিদের সুযোগ-সুবিধার জন্য তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের নেতৃত্বে ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটি মাঠ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তাদের সার্বিক সহযোগিতা, অর্থানুকূল্যে, শোলাকিয়া সাহেব বাড়ী, হয়বৎনগর দেওয়ান বাড়ী এবং জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় শোলাকিয়া মাঠ সার্বিকভাবে বিকাশ লাভ করে। ফলে দায়িত্বের পরিধি জাতীয় পর্যায়ে পতিত হওযায় মাঠ পরিচালনার জন্য প্রশাসনের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করার প্রয়াজন দেখা দেয়। তাই তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের নেতৃত্বে ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠ পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সভাপতি সহ মোট ৫১ সদস্য বিশিষ্ট মাঠ পরিচালনা কমিটি মাঠ পচিালনা করছে
মুসলমানদের ঈদ ঐতিহ্য ও শোলাকিয়া ঈদগাহ
ঈদ মনেই আনন্দ, ঈদ মানেই উৎসব, আর শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ মানে এক বিশেষ অনুভূতি, এক বিশেষ আত্বতৃপ্তি। অনেক মানুষের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে পর পর তিনবার শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে পারলে এক হজ্জের সওয়াব পাওয়া যায়- এটা একটা বিশ^াস, মানসিক তৃপ্তি। তবে এটা ঠিক লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে কারো না কারো দোয়া কবুল হবে, আর তাহলে মাঠের সকল নামাজীরা এর সওয়ার পেয়ে যাবেন। আমিন! তাই যেন হয়। তাইতো দেখা যায় ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ধর্মপ্রাণ লাখো মানুষের এ সম্মিলনে অংশ নিতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা সহ প্রতিবেশী দেশ ভারত, মায়ানমার, পাকিস্থান, তথা সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসুলমানগণও ছুটে আসেন শোলাকিয়া ঈদগাহে ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ার জন্য। আর এ কারণে ঈদুল ফিতরের জামাতের সময় শোলাকিয়া পরিণত হয় ধর্মপ্রাণ মানুষের জনসমুদ্রে। বিশ্ব মুসলিম উম্মার শান্তি-সংহতি, জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধ কামনা করে এ জামাত অনুষ্ঠিত মোনাজাতের সময় ধর্মপ্রাণ মানুষের আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয় সমস্ত কিশোরগঞ্জ। গগন বিদারিত ধ্বনিতে আশপাশ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ঈদুল ফিতরের এ মহামিলন উৎসব উপলক্ষে কিশোরগঞ্জ শহরকে সাজিয়ে তোলা হয় অপরূপ সাজসজ্জায়। পৌরসভা, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে আলোকসজ্জার পাশাপাশি দেশ-বিদেশ থেকে আগত অতিথিদেরকে ঈদের পয়গাম জানিয়ে তৈরী করা হয় অসংখ্য বর্ণাঢ্য তোরণ। এছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে আগত এসব মুসুল্লিগনের তত্ত্বাবধান এমনকি সেবা দিতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ধর্ম পরায়ণ ও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি। তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ও মিডিয়ার বদৌলতে শোলাকিয়া ঈদগাহর ঈদে বড় জামাতের খবর ক্রমান্বয়ে সাড়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। শহরের বিভিন্ন হোটেল, রেষ্ট্রুরেন্ট, রাস্ত-ঘাট সকল স্থানে দেখা যায় মুসলিমদের এক অপূর্ব সমাহার। তাছাড়া শহরের মসজিদ, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনসহ আত্বীয়স্বজনদের বাড়ীতেও দুর থেকে আগত মুসল্লীবৃন্দরা আগে থেকেই এসে আশ্রয় নেন। তাছাড়া ঈদুল ফিতরের ঈদে মাঠ পরিচালনা কমিটির তত্ত¦াবধানে কিশোরগঞ্জ এর ব্যবসায়ী সমিতিও এসব মুসল্লীদের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
মুসলমানদের ঈদ, ঈদের নামাজ ও ঈদগাহের একটি ঐতিহ্যগত ভিত্তি রয়েছে। বিশিষ্ট ইতিহাস ঐতিহ্য লেখক ও সাহিত্যিক জনাব মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম এর লিখা ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ’ (সূত্র: মাসিক মাদ্রাসা,জানুয়ারী,২০০১১) শিরোনাম লেখায় তিনি এদেশে ঈদগাহ মাঠ সৃষ্টির একটি ইতিহাস ভিত্তিক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী এদেশে মুসলমানদের আগমনের সময় হিসেব করে বলতে গেলে বলা যায় যে, আমাদের ঈদ ঐতিহ্য ১৩০০ বছরের পুরনো। বিশে^ ৩য় বৃহত্তর মুসলিম জন অধ্যুষিত মানুষের দেশ হল বাংলাদেশ আর এই ঈদ এরই মধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় ও সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের সবচেয়ে মর্যাদার জাতীয় উসবের স্থান দখল করে নিয়েছে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু করেন ‘ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজী’ এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জীর বাংলা বিজয়ের ৬০০ বছর আগেই সাহাবীদের দ্বারা বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় এবং সেই সময়েই প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়। জনাব ইসলাম এর গবেষণা অনুযায়ী মোহাম্মদ বখতিয়ার কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর এদেশে অবাধ মুসলিম শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয় এবং প্রতিষ্ঠানিকভাবে ও রাষ্ট্রিয়ভাবে ঐ সময় থেকেই এদেশে ঈদ উৎসব পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়। ৬০২ হিজরীতে মোহাম্মদ বখতিয়ারের মৃত্যুর ৫৬ বছর পর ৬৫৮ হিজরী সনে জনাব কাজী মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর ‘তবকাত-ই-নাসিরী নামক গ্রন্থে ঈদ উৎসবের কথা উল্লেখ করেন। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন মাসউদ-শাহ-বিন ফিরোজ শাহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ঈদউল আজহা উপলক্ষে তাঁর বন্দী মুক্তিদানের কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, ঈদ উপলক্ষে আমাদের দেশেও বর্তমানে বন্দী মুক্তিদানের প্রথা চালু রয়েছে।
জনাব ইসামের গবেষণায় তিনি আরও উল্লেখ করেছেন মধ্য যুগের কবি মুকুন্দরাম তাঁর চন্ডিমঙ্গল কাব্যে মুসলমানদের বিষয়ে লিখেছেন-
অতএব, একথা বলতেই হয় রোজার শেষে ঈদ আনন্দ যে কি সেটা রোজাদারগণই বুঝেন আর সেই ঈদের নামাজ যদি হয় শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে তবেতো অনন্দটাই হবে অন্যরকম একথা বলার অত্যুক্তি রাখে না।
জনাব ইসলাম আরো লিখেছেন মধ্যযুগের আরেক কবি শেখ মুত্তালিব তাঁর ‘কিফায়াতুল মুসল্লিন’ নামক গ্রন্থে মুসলমানদের দু-ঈদের বিষয়েই অনেক কিছু উপস্থাপন করেছেন। স¤্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতিনিধি সুবেদার ইসলাম খাঁন চিশতির সেনাপতি মীর্জা নাথান রচিত (১৬১২-১৬২৪ খ্রি.) ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘বাহারিস্থান-ই-গায়বীত’ এ এদেশের রমজান মাস ও ঈদ উৎসব পালনের বিষয়ে তিনি অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকার মোগল প্রশাসক স¤্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজার সময়ে (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রি.) ঢাকায় ঈদগাহ মাঠ স্থাপন করা হয়। এর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠার প্রবনতা লক্ষ করা যায়। উল্লেখযোগ্য যে, ইংরেজ শাসন আমলে এদেশের মুসলমানদের ওপর যখন জুলুম-অত্যাচার বেড়ে যায়, এ সময়ে ইংরেজবা এবং দেশীয় ইংরেজ দালালেরা বাঙালীদের তথা এদেশে ঈদ উৎসব পালনে বাধা প্রদান করতে থাকে। দীর্ঘ ২০০ বছর এ অবস্থায় চলে এবং ১৯৪৭ সালে যখন পাকীস্থান সৃষ্টি হয় তখন থেকে মুসলিম সাংস্কৃতি সহ ঈদ উৎসব পালনে আবাও মুলমানেরা ঈদ আনন্দের আলাদা আমেজ অনুভব করতে শুরু করে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ঈদ আমেজ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে একটি ভিন্ন মাত্রার ও স্বাদের ঈদ আমেজ হিসাবে বাঙালী মুসলমানেরা অনুভব করতে থাকে। আর তাই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়ার আগ্রহও মানুষের মাঝে দিন দিন বাড়তে থাকে এবং নামাজ পড়ার জন্য নামে মানুষের ঢল। এমনকি প্রতি ঈদুল ফিতরের সময় ঈদের নামাজের দৃশ্য দেখতে আসা মাঠের দক্ষিণ দিক দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত নরসুন্দা নদীর আপর পারে অন্যান্য ধর্মের মানুয়ের ঢল ধর্মীয় সম্পৃতির কথাই মনে করিয়ে দেয়।