Ended soon
ডাচ ও ফরাসীদের পর ইংরেজরা কেপে পরবর্তী বসতি স্থাপনকারী। তবে প্রকৃতপক্ষে ডাচরা নয়, ইংরেজরা কেপে স্থায়ী বসতি স্থাপনের চিন্তা করে ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে। ব্রিটিশ শাসন দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি রাজনীতি ও সমাজকে পরিবর্তন করে। শীল্প-বিপ্লব উত্তর ব্রিটিশ অর্থনীতি ক্ষমতাধর হয়, যার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বাজার যুক্ত হয়। ব্রিটিশরাই কেপে দাস প্রথা বন্ধ করে মুক্ত শ্রমিক ব্যবস্থা এবং মুক্ত বাণিজ্য চালু করে। আদিবাসীদের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্ম চালুর জন্য মিশনারীদের আগমন ঘটায়।
১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে নতুন ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন ক্রাডক কর্তৃক ব্রিটিশ, ডাচ ও খৈ খৈ সেনাবাহিনী কর্নেল জন গ্রাহামের নেতৃত্বে ২০,০০০ জন জেলে জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা হয়। তাদের জমি ও গবাদি পশু দখল করে নেয়। এখানে সামরিক আউট পোস্ট স্থাপন করা হয়, যা এখন গ্রাহাম টাউন হিসাবে পরিচিত।
১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কেপে নতুন ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ৪০০০ জন ব্রিটিশ নাগরিক কেপে খামার প্রতিষ্ঠার জন্য আসে। তাদের কৃষি জমি ও গবাদি পশু দেয়া হয়। গ্রাহাম টাউন ধীরে ধীরে আইভরী, পশম, পশুর চামড়া, ছুরি, বোতাম ইত্যাদির ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়। এভাবে ব্রিটিশ ও নেটিভদের মধ্যে অনেকটা বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। ঔপনিবেশিকরা সেখানকার প্রথম পত্রিকা The Grahamtown Journal প্রকাশ করে। রোমান ডাচ আইনের পরিবর্তে ব্রিটিশ আইন প্রবতির্ত হয়। বর্তমান সাউথ আফ্রিকার আইন ব্রিটিশ আইনের আলোকেই প্রণীত। এই আইনে পৃথক ও স্বতন্ত্র জুডিশিয়ারী প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেন কেপ কলোনীতে অংশগ্রহণমূলক সরকার অনুমোদন করেন এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট সৃষ্টি করা হয়। এ সময় সকল ধর্মের পুরুষদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। ভোটার হওয়ার জন্য ২৫ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি বা বাৎসরিক ৫০ পাউন্ড মজুরী আয় করে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়েষ্ট মিনিষ্টার টাইপ পার্লামেন্টরী সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। দ্রুত বর্ধমান বাণিজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ব্রিটেন মার্কেন্টাইল ‘ল’ চালু করে।
কোম্পানী গার্ডেন, কেপ টাউন
কোম্পানী গার্ডেন, কেপটাউনের সবচেয়ে পুরাতন গার্ডেন। গার্ডেনটি মধ্য কেপ টাউনে অবস্থিত। ডাচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক ২৯ এপ্রিল, ১৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাগানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন বসতি স্থাপনকারীদের চলাচলকারী জাহাজে সবজী সরবারহ করার জন্য প্রধানত বাগানটি তৈরী করা হয়। প্রথমে সালাদ, বীনস, মূলা, গম, বাধাকপি, এসপারগাস ইত্যাদির বীজ বপন করে বাগান শুরু করা হয়। বাগানটিতে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে Catalogue of plant পাওয়া যেতো। ১৯২৯ সালে গোলাপ বাগান সৃষ্টি করা হয়। পরে কয়েকটি পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হয়। পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়। সেখানে বিশ্বযুদ্ধ ও ডেলভিল উড যুদ্ধের স্মারক গার্ডেনে রয়েছে। প্রবেশ পথের মুখে রাণী ভিক্টোরিয়ার ভাস্কর্য রয়েছে। কাছেই সেন্ট জর্জস ক্যাথেড্রাল। কাঠবিড়ালীসহ বহু প্রজাতীর পাখীদের বিচরণ বাগানে চোখে পড়ার মতন। বিরল বৃক্ষরাজিও এই গার্ডেনের সম্পদ। গিনকো বৃক্ষ, রাবার বৃক্ষ, সেফরন বৃক্ষ বাগানের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে।
মিশনারী/ধর্ম প্রচারকগণ
ব্রিটিশ মিশনারীরা ব্রিটেনের আদব কায়দা অনুযায়ী কালো মানুষদেরকে সভ্য করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কালো এবং মিশ্র শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। রবার্ট মোফাট নামে একজন ধর্ম প্রচারক নেটিভদেরকে লাঙল বাওয়া, সেচ এবং উন্নত কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। ধর্মপ্রচারকগণ নিরাপত্তা ও শিকারের জন্য অস্ত্র বহন করতেন। জুলু রাজা দিনগান ধর্ম প্রচারক ফ্রান্সিস ডয়েনকে অস্ত্র চালনা ও শিক্ষা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ডয়েন অস্ত্র দিতে রাজী না হলেও পড়াশুনা করাতে রাজী হয়। ডয়েন রাজাকে পড়াতে গিয়ে দেখতে পায় যে, জুলু রাজা ঘুমাচ্ছেন, তাকে জাগানোর কেউ নেই।
দাসদের জীবন গাঁথা
Katie নামে ৯৬ বছর বয়সি একজন দাস তার জীবন ও পরবিার সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেন ১৯১০ সালে। তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিম কেপের কালাবাসের মি. মস্টার্টের ফার্মে। তার পিতা ছিলেন মালাগাসী এবং মা ছিলেন কেপের বাসিন্দা। ফার্মের মালিক মি.মস্টার্ট তাদের সম্পত্তি, গবাদি পশু, ঘোড়া এবং দাস ভাগ করে দেয়। কেটিকে একজন পুত্র দেয়া হয় এবং তার মাকে অন্য আরেকটি পুত্র। কেটি অশ্রু ফেলে বিদায় নেয়ার পর তার মার সাথে এই জীবনে দেখা হয়নি। কেটি প্রথমে কৃষি কাজ করেন মাঠে। পরে তার খামার মালিকের শিশুদের দেখার জন্য নার্সের কাজ করেন। রাতে তিনি মালিকের বাসায় মেজেতে ঘুমাতেন। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত দাসদের মধ্যে আইনানুগ বিবাহ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। কেটির একজন পার্টনার ছিল জ্যাকভ। জ্যাকভ অন্য একটি ফার্মে কাজ করতো। তারা একত্রে বসবাস করতো এবং তাদের সন্তান ছিল। এটি একটি মাত্র উদাহরণ। এ রকম অজস্র বঞ্চনার কাহিনী রয়েছে। এভাবেই পরিবার, সম্পদ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দাসদের জীবন পরিচালিত হতো।
বু-কাপ (Bo Kaap)
২১ সেপ্টেম্বর আমরা বু-কাপ এলাকা দেখতে যাই। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে অনেকেই কেপ টাউনের বু-কাপ এলাকায় বসবাস শুরু করে। এর মধ্যে মুসলিম অভিবাসীরাও ছিলো। তারা কেপ মালয় হিসাবে মূলত পরিচিত। অধিকাংশের শিকড় ছিলো মালয়েশিয়া। বর্তমানে বু-কাপ কেপ টাউনের সিটি সেন্টার। দাসদের ভাষা বিলুপ্ত হলেও আফ্রিকানস ভাষায় দাসদের ব্যবহৃত বহু শব্দ স্থায়ী রয়েছে যেমন:- Piesang = কলা, Blatjiag = চাটনী, Baadjie = জ্যাকেট। যদিও আফ্রিকানস ভাষাকে দাসদের ব্যবহৃত ভাষা বলা হয়। দাস প্রথা তিনটি পর্যায়ে বিলুপ্তি হয়। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা দাস ব্যবসা বন্ধ করে। ফলে নতুন কোন দাসকে আমদানী করা হয়নি কেপে। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে দাসপ্রথা অবলুপ্ত করা হয়। দাসরা মুক্ত কিন্তু তারা তাদের পূর্ব খামার মালিকদের কাছে ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করতে হয়। তখন থেকে সকল মানুষ কালো বা সাদা সকলের কাছে সমান বিবেচিত হবে নির্ধারণ করা হয়। যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ আছে এমন পুরুষ ভোটার হিসাবে বিবেচিত হয়। তখনও সকল পুরুষ বা নারীরা ভোটার হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
রোভেন আইল্যান্ড
কেপ টাউনের প্রায় ৯ কি.মি. পশ্চিম টেবল বে-তে রোভেন আইল্যান্ড অবস্থিত। ডাচ শব্দ সীল থেকে রোভেনিল্যান্ড যার অর্থ সীল আইল্যান্ড। দ্বীপের আয়তন = ৫.১৮ বর্গ কি.মি., দৈর্ঘ = ৩.৩ কি.মি., প্রস্থ = ১.৯ কি.মি.। ইহা সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত জেলখানা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। বহু রাজনৈতিক বন্দীকে এখানে আটক রাখা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা এখানে কারারুদ্ধ ছিলেন ১৮ বছর। প্রায় ৪০০ বছর ধরে রোভেন আইল্যান্ডকে শ্বেতকায় শাসকরা নির্বাসনকেন্দ্র, বিদ্রোহীদের জন্য জেলখানা, অসুস্থদের হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার করে। ১৯৯১ সালে UNESCO এই দ্বীপকে World Heritage Site হিসাবে ঘোষণা করে।
এই দ্বীপে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। রোভেন আইল্যান্ডে একটি বাতিঘর রয়েছে জাহাজ চলাচলের আলোক নির্দেশ দেয়ার জন্য। লেপরোসী রোগীদের জন্য বাসস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয় দ্বীপটি।
এই রোভেন আইল্যান্ডে বহু সামুদ্রিক পাখির আবাস কেন্দ্র এবং প্রায় ৮৫০০ পেংগুইনের আবাসস্থল যা পৃথিবীর বৃহত্তম পেংগুইন আবাস।
পোর্ট এলিজাবেথ
১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর পোর্ট এলিজাবেথ। বর্তমানে ইহা বহুমুখী কার্গো পোর্ট। পর্তুগীজ অভীযাত্রী বার্থোলিমো ডায়াস এবং পরবর্তীতে ভাস্কো দা-গামার সময়ে এই উপকূল অতিক্রম কালে তারা দেখেছেন যে এই এলাকাটি মিষ্টি পানির অবতরন কেন্দ্র। প্রথমে ব্রিটিশরা স্থানটি পোতাশ্রয় (Harbour) হিসাবে ব্যবহার করে, পরবর্তীতে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বন্দর হিসাবে ঘোষণা করে। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে একজন হারবার মাস্টার এবং কাষ্টম কালেক্টর নিয়োগ করা হয়।
পোর্টটির কন্টেইনার টার্মিনালে তিনটি বার্থ রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ৯২৫ মি.। ২২ হেক্টর গোডাউন এলাকা। গেনটি ক্রেন ও ষ্ট্রেডল ক্যারিয়ার দ্বারা কন্টেইনার পোর্ট পরিচালিত হয়। বাল্ক টার্মিনাল ১১৭০ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ৬ টি বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাছাড়া টাগ, ফিশারী এবং ট্রলার জেটি রয়েছে যা যথাক্রমে ১২০ মি., ১৬৫ মি. এবং ১৩৬ মি. দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট। পোর্টের সাথে পর্যাপ্ত রেল এবং সড়ক যোগাযোগ সমগ্র দেশের সাথে রয়েছে। পোর্ট এলিজাবেথ এর প্রবেশ চ্যানেলের গভীরতা ১৪.৫মি. চার্ট ডেটাম, প্রস্থ ৩১০ মিটার চার্ট ডেটাম। পোর্টের তিনটি টাগ বোট রয়েছে, যার মধ্যে দুইটি আধুনিক ৭০ টন বোলার্ড পুল। পাইলট সার্ভিসের জন্য আলাদা বোট রয়েছে।
এখনো কেপ টাউনের সাদাদের এলাকা, কালোদের এলাকা, মিশ্র ও এশিয়ানদের বসবাসের এলাকা ভিন্ন ভিন্ন। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতি এখনো শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীই প্রধানত: নিয়ন্ত্রণ করে। এরকম কিছু এলাকা আমরা দেখতে যাই।
২০১৬ সালে পোর্টটি কার্গো হ্যান্ডেল করে ১১.২২ মিলিয়ন টন(কন্টেইনার সহ)। কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে ২০১৬ সালে ১,৫২,৪৫৬ টিউস। ২০১৬ সালে এই বন্দর ১০৮৫ টি জাহাজ হ্যান্ডেল করে।
পোর্টের কন্টেইনার টার্মিনাল, কার টার্মিনাল, ফ্রুট টার্মিনাল, ম্যাঙ্গানীজ টার্মিনাল রয়েছে, যার অতিরিক্ত হ্যান্ডেল ক্ষমতা ৩,৭৫,৫০০ টিউস। দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্টসমূহ পরিচালনা করে Transsnet National Ports Authority । পোর্টটি বন্দর কার্যক্রমের বাহিরে একটি অন্যতম ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ এর স্থান।
ডারবান পোর্ট
দক্ষিণ গোলার্ধের ৪র্থ বৃহৎ বন্দর ডারবান। ২১ কি.মি. প্রশস্ত, ৫৮ টি বার্থ, ২০টি টার্মিনাল অপারেটর নিয়ে উন্নত একটি বন্দর। বছরে ত্রিশ মিলিয়ন টিউস কার্গো হ্যান্ডেল করে থাকে। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় শিপিং টার্মিনাল যা ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। বছরে ৪৫০০ বাণিজ্যিক জাহাজ বন্দরে নোঙর করে।
ডারবানে প্যাসেনজার টার্মিনাল রয়েছে, যেখান থেকে ক্রুজশীপ পরিচালিত হয়। ৬০,০০০ গাড়ী ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বিশ্বমানের কার টার্মিনাল রয়েছে। ডারবান দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু নাত্তাল প্রদেশের রাজধানী।
বাল্ক কাঁচামাল, মূলধনী মালামাল, যন্ত্রাংশ, সাজ সরঞ্জাম ডারবান পোর্ট দিয়ে আমদানী করা হয়। রপ্তানী পণ্যের মধ্যে রয়েছে মিনারেল, চিনি, খাদ্য, কয়লা, তেল ইত্যাদি। ডারবানে অপরিশোধিত তেল পরিশোধ করে জোহান্সবার্গে পাইপের মাধ্যমে পাঠানো হয়। ডারবান পোর্ট ৭৪.৭ মিলিয়ন টন কার্গো হ্যান্ডেল করে। যার মধ্যে ৪২.৬ মি. টন আমদানীকৃত পণ্য, ২৩.৫মি. টন রপ্তানী পণ্য এবং ৮.৬ মি. টন ট্রান্সশিপমেন্ট।
দক্ষিণ আফ্রিকার ৬০% কন্টেইনার ডারবান পোর্ট হ্যান্ডেল করেন। ডারবান বন্দর এলাকা ১.৮ হাজার হেক্টর ভূমি দ্বারা গঠিত। ৩৩৫ মি. এবং ৭০০মি. দুটো ব্রেক ওয়াটার দ্বারা বন্দরের চ্যানেলটি পরিচালিত। ডারবান বন্দরের সাথে ৩০২ কি.মি.রেলওয়ে ট্রাক রয়েছে। ৪.৮ কি.মি.প্রবেশ পথে ট্যাগ সহায়তা এবং পাইলটেজ সার্ভিস দেয়া হয়। তাছাড়া ডারবান পোর্টে আউটার এ্যাংকারেজ সুবিধা আছে। তাছাড়াও ক্রুজ জাহাজ পরিচালনার জন্য আলাদা টার্মিনাল রয়েছে। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় অভিবাসীদের আইনী সহয়তা দেয়ার জন্য ডারবানে আসেন। এখানে এ্যটর্নী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ডারবান বন্দরের প্রধান সড়কটির নাম মহাত্মা গান্ধী সড়ক। ডারবানে ভারতীয়দের যথেষ্ঠ প্রধান্য রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পায়নে। প্রচুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস করেন এবং ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করেন।
কেপ টাউন পোর্ট-
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন নগরের নিকটেই টেবল বে কেপ টাউন বন্দর অবস্থিত। বিশ্বের ব্যস্ততম বাণিজ্য রুটের মধ্যে হওয়ায় কেপ টাউন পোর্ট ব্যস্ততম বন্দর। তাজা ফলমূল এই বন্দর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হয়। কেপ টাউন দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম কন্টেইনার বন্দর, ডারবান বন্দরের পরেই। মৎস্য আহরণ এই বন্দরের অন্যতম প্রধান কর্মকান্ড। ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে কেপ টাউন পোর্ট একটি প্রধান কেন্দ্র। লজিষ্টিক ও জাহাজ মেরামতও এখানে গুরুত্বপূর্ন ব্যবসা। ক্রুজ শিপ এই বন্দর থেকে পরিচালনা করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ ভালো হওয়ায় ক্রুজ শিপ খুবই জনপ্রিয়।
বন্দর ২৪ ঘন্টা ৭ দিন খোলা থাকে। বন্দর চ্যানেলের গভীরতা ১৫.৪ মি.সি ডি, ১৮০ মি.প্রসস্থ। সকল জাহাজের জন্য পাইলট সার্ভিস বাধ্যতামূলক। ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কার্যকর রয়েছে,ট্যাগ সার্ভিস বিদ্যমান।
বন্দর ২০১৬ সালে শুধুমাত্র কার্গো হ্যান্ডেল করে ৪.২২৬ মি টন, কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে ১২.৫ মি. টন। মোট জাহাজ বার্থের সংখ্যা ৩৪টি। কন্টেইনার টার্মিনালের রয়েছে ৬টি গভীর বার্থ। কেপ বন্দরে ব্যাংকারিং সুযোগ রয়েছে।
লায়ন হেড
কেপ টাউনে টেবিল পর্বত এবং সিগন্যাল হিলের মধ্যে লায়ন হেড একটা মস্ত বড় পর্বত। লায়ন হেডের চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৬৯ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ইহা টেবিল মাউন্টেইন জাতীয় পার্কের অংশ। চূড়ার উপরের অংশ সমতল পাথর ও বালি দ্বারা গঠিত এবং নিম্নের অংশ কেপ গ্রানাইট ও শিলা দ্বারা গঠিত। লায়ন হেডে রয়েছে বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ ফিনবস। লায়ন হেডে পায়ে হেটে উঠতে ৯০ মিনিট সময় লাগে। দুটি রুট দিয়ে লায়ন হেডে উঠা যায়। কেপ টাউন শহরের যে কোন প্রান্ত হতেই চির উন্নত মম শীর লায়ন হেড দেখা যায়। লায়ন হেডের চূড়া থেকে কেপ শহর ও সমুদ্র দেখতে হৃদয়কে দোলা দেয়, পর্যটকদের জন্য এক বড় আকর্ষণ।
সিগনাল হিল
কেপ টাউনে লায়ন হেড এবং টেবিল মাউন্টেটেইনের পরে সিগনাল হিল অবস্থিত। ইহার উপারিভাগ সমতাল। পূর্বে ইহাকে লায়ন ফ্ল্যাঙ্ক বলা হত। সর্বোচ্চ চূড়া ৩৫০ মি., ১১৫০ ফুট। লায়ন হেড ও সিগনাল হিল একত্রে দেখতে লায়ন Sphinx । এখানে সিগনাল ব্যবহৃত হয় আবহাওয়ার বার্তা দেয়ার ক্ষেত্রে। তাছাড়া সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজকে নোঙর করার ও চলাচলের বার্তা দেয়া হয় এখান থেকে। এর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার নেভী এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যোর্তির বিজ্ঞানের অবজারভেটরী হিসাবে ইহা পরিচালনা করা হয়। সিগনাল হিল পৃথিবীর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ভাবে সংকটাপন্ন। এখানে Shale Renosterveld উদ্ভিদ পাওয়া যায়। সিগনাল হিলে ইসলাম প্রচারক শেখ ইউসুফের কারামত অবস্থিত। কারামত শব্দটির অর্থ মাজার। ইহা একটি মালয় শব্দ। শেখ ইউসুফকে দক্ষিণ আফ্রিকার ইসলাম প্রচারের পিতা হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানকার মুসলমানরা এই মাজার জিয়ারত করে থাকেন।
টেবল মাউন্টেইন
টেবল মাউন্টেইন কেপ টাউনের খুবই আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। অনেক পর্যটক পায়ে হেটে কিংবা ক্যাবল কারে করে এই টেবল মাউন্টেইনে বেড়াতে আসে। ইহা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,০৮৫ মিটার উচুতে অবস্থিত। ধরে নেয়া হয় যে ইহা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পর্বত। পর্বতের শিলা ৬০০ মিলিয়ন বছরের পুরাতন। পর্বতের গোড়ায় শিলা এবং পশ্চিম দিকে কেপ গ্রানইট। এই পর্বত হিমালয়ের চেয়ে ছয়গুন পুরাতন। টেবল মাউন্টেইন দক্ষিণ আফ্রিকার আইকন, যা ছবি তোলার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা। টেবল মাউন্টেইনের এর জীব বৈচিত্র খুবই সমৃদ্ধ। অজস্র কিং প্রোটিয়া প্রস্ফুটিত হয়ে এই স্থানকে মনোরম করে তুলেছে। Silver Tree প্রাকৃতিক ভাবে এই পর্বত গাত্রে গজায়ে অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে এই পর্বতকে। দিসা ইউনিফ্লোরা যা টেবল মাউন্টেইন এর জলপ্রপাতের নীচের দিকে গজায়। তাছাড়াও ২,২৮৫ ধরণের উদ্ভিদ প্রজাতি এখানে রয়েছে। ইহা World Heritage Site হিসাবে স্বীকৃত। টেবল মাউন্টেইন এর উদ্ভিদ জগৎ সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষিত। একটি রৌদ্র করোজ্বল বিকালে আমরা ব্যয় করি এই মনোরম পর্যটন কেন্দ্রটি দেখতে।
গ্রীন মার্কেট স্কয়ার
পুরাতন কেপ টাউনের কেন্দ্রে ঐতিহাসিক স্থান হচ্ছে গ্রীন সুপার স্কয়ার। উক্ত স্কয়ারটি ১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত। পূর্বে ইহা দাস মার্কেট ও ভেজিটেবল মার্কেট ছিলো। বর্তমানে সুভেনির, কুটির শিল্প, পাথর, চামড়াশিল্পসহ বহু ধরণের পণ্য সামগ্রীর বিক্রয় কেন্দ্র। মার্কেট এলাকাটিতে পায়ে হেটে শপিং করতে হয়। ডাচ উপনিবেশের সময় দাস বিক্রি হতো এই মার্কেটে। আমরা এই মার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখি এবং বিভিন্ন আফ্রিকান সিমবল সম্বলিত সুভেনির ক্রয় করি। দাম তুলনামূলক অনেক সস্তা।
ট্রাফালগার ফুলের মার্কেট
কেপ টাউনে সস্তায় তাজা ফুল বিক্রি হয় ট্রাফালগার ফুলের মার্কেটে। বহু ধরণের ফুলের সংগ্রহ রয়েছে এই মার্কেটে। বিবাহ, অন্তেষ্টিক্রিয়া, কর্পোরেট উৎসব, ভালোবাসা দিবস, মা দিবস তাছাড়াও বহু উৎসবে এই মার্কেট থেকে ফুল বিক্রি করা হয়ে থাকে। মার্কেটটি একশত বছরের পুরাতন। কেপ মালয় ঐতিহ্যের জন্য সকলের কাছেই মার্কেটটি পরিচিত। এই মার্কেটের দোতলায় মূলত মালয় অভিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম ব্যবসা করে। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই ফুলের মার্কেটে ব্যবসা চলেছে। ফাদওয়া সাসমান নামে এক নারী জানান, তিনি চতুর্থ প্রজন্ম এই ফুল ব্যবসার সাথে জড়িত। গোলাপ, প্রোটিয়া, আফ্রিকান ডেইজি, সূর্যমুখীসহ বিভিন্ন বর্ণ, রঙ, গোত্রের ফুল এই বাজারকে সমৃদ্ধ করেছে। বিচিত্র এই ফুল দেখে দেখে অনেকটা সময় আমরা এখানে ব্যয় করি।
রেডিসন ব্লু ওয়াটার ফ্রন্ট হোটেল,কেপ টাউন
পাঁচ তারকা রেডিসন ব্লু ওয়াটার ফ্রন্ট হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। হোটেলটি সুন্দর, সুযোগ সুবিধাও চমৎকার। তবে যে ঘটনা বিদেশে কোনদিন ঘটেনি তা ঘটে গেল। ক্যাশ ডলার হোটেল স্যুটে রেখে গিয়েছিলাম। স্যুটে (Suite) ফিরে এসে দেখি অর্ধেক ডলার নেই, বাকীটা রয়েছে। আমাদের দুজনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে গেল। হোটেল রিসিপশনে অভিযোগ দিয়েও কোন লাভ হলো না। দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণের পূর্বে অনেকেই সতর্ক করেছিলেন। চলাচলে কোথাও যদিও কোন অসুবিধা হয়নি। তবে এই অভাবনীয় চুরির শিকার হতে হয়েছে।
তথ্য সূত্র:
1) A short history of South Africa by Gail Nattrass, Jonathan Ball Publishers, 2017, Cape Town.
2) Lost Communities, Living Memories Remembering Forced Removals in Cape Town. Edited by Sean Field, Centre for Popular Memory, University oF Cape Town, 2018.