আমি আমার শাশুড়ি কে ভালোবাসি না !

মনিরা সুলতানা পাপড়ি
সুইডেন প্রবাসী লেখিকা ও অনলাইন এক্টিভিষ্ট

এপ্রি ৩, ২০২২ | অধিকার ও সুশাসন

Ended soon

আমার সবচেয়ে বড় ফ্যান/এডমায়ারার হচ্ছেন আমার বিদূষী শাশুড়ি। অথচ আমার শাশুড়ি কে আমি আমার মায়ের মতো ভালোবাসি না। এমনকি তিনিও আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন না।

অথচ আমাদের মধ্যে চমৎকার একটা বন্ধুত্ব আছে, এমনই বন্ধুত্ব আছে যে ফোনে আমি তাকে রুপচর্চার টিপস দেই। আমার স্কার্ট তাকে পরিয়ে টুইনিং করি, ছবি তুলি। বেড়াতে এলে তাকে আমি ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যাই, তার খুব পছন্দ এটা। তার চুল কেটে দেই, ফেসিয়াল করে দেই। বেলকনিতে বসে চা খেতে খেতে শশুর আর হাজব্যান্ড নামক দুজন ভ্যাগাবন্ড লোকের নামে বিরাট ব্যাড মাউথিং করি!

আমার সব ব্লগ, ভিডিও, লাইভ আবৃত্তি একটাও তিনি মিস করেন না। আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। আর তিনি আমার চেয়ে শিক্ষিতা, মেধাবী। কি তার স্কিন এর গ্লো এই বয়সেও, এক ঢাল চুল এই সত্তর বছর বয়সেও। এতে আমার গর্ব হয়।

এই সম্পর্কটাই সুন্দর।

এর মানে এই না যে আমাদের মধ্যে কোন ইস্যু হয় নি। আমি বরাবরই স্ট্রেইট ফরোওয়ার্ড, তাই কখনো আঘাত আমিও করেছি। আবার সেই ষাটের দশকে বি.এ, বিএড করা আমার বিদূষী শাশুড়ি যে কখনো চাচী শাশুড়ি গোত্রীয় ঘসেটি বেগমদের কথায় আমাকে ভুল বোঝেননি তাও না। তবে আমরা সীমা অতিক্রম করিনি। না তিনি আমার সংসারে নাক গলিয়েছেন, না আমি দুদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে তার কাছ থেকে ঘরের চাবি দখল নিয়েছি। এ জায়গায় অবশ্য শাশুড়ির ছেলের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। মা ভুল করলে মাকে ফিডব্যাক দেয়া, বউ করলে বউ কে, এটা করতে পারলে সো ফার পার্শিয়াল্টির অভিযোগ কম ওঠে।

যারা বলে শাশুড়িকে মায়ের মতো ভাবো, বা বউকে মেয়ের মতো তারা অতি আবেগে বলে বা বাড়িয়ে বলে। অনেক ভালোবাসা সম্ভব কিন্তু মায়ের মতো বা সন্তানের মতো ভালোবাসা অন্তত বউ শাশুড়ির হয় না।

এটা একটা মিথ। আনরিয়েলিস্টিক রিলেশনশিপ গোল।
যার সবচেয়ে খারাপ দিক হোলো আশা ভঙ্গ হওয়া, কষ্ট পাওয়া। উভয়েরই।
কিন্তু কেন শাশুড়িকে মা বা পুত্রবধুকে মেয়েই হতে হবে?

কেন এই মিথ্যে হাওয়াই মিঠাইয়ের লোভ দেখানো? হয়তো সামাজপতিরা ভালো জানবেন। ধারণা করি পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় রাখতেই এমন প্রথা বা ভাবনার সৃষ্টি।

অথচ সম্পর্কে যদি আনরিয়েলিস্টিক ব্যপার, ফেইক ব্যপার না থাকে তবেই বরং সম্পর্ক সুন্দর আর সহজ থাকে। কারণ কারোর কাছে কারোর এক্সপেকটেশানস থাকে না। যা পায় একে অন্যের থেকে সেটাই বোনাস। নির্মল ভালো লাগা।
একটা মেয়ে আমাদের দেশের প্রথা অনুযায়ী শশুরবাড়ি যখন আসে, তখন সে একেবারে “এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” এর মতো একা, ভীত, নার্ভাস এবং হেল্পলেস ফিল করে। একে তো চেনা সম্পর্ক,চেনা উঠোন পেছনে ফেলে আসার শোক আর নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের দেখে আরো যেন নার্ভাস লাগে। তখন তাকে “ফিল এট হোম” যে করাতে পারে,সে হোলো শাশুড়ি। যে অভয় দিতে পারে, যে ছায়া দিতে পারে, সে হোলো শাশুড়ি। জানি ৯৯ ভাগ মেয়ের কপালেই এটা জোটেনা। অথচ শাশুড়ি যদি তার নিজের নতুন ঘরে পা দেয়ার অভিজ্ঞতা মনে করেন, তার অবশ্যই উচিৎ ছেলের বউ কে নিজে যা পাননি, সেটা দেয়া। কিন্তু কেন জানি আমরা নিজেদেরকে এটুকুন উদার করে উঠতে পারিনা, নিজের ভেতরের দানবের সাথে লড়াই করে ভেতরের ভালো মানুষটার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনা। নিজের মনের দানবের হাতে নিজেই বন্দী। সেই একই ইতিহাস আবার রিপিট হয়। তাই বউ শাশুড়ির যুদ্ধ থামেনা। শাশুড়িদের উচিত ছেলের বিয়ের পর ছেলে আর ছেলের বউকে তাদের জীবন উপভোগের সুযোগ দেয়া, নতুন জীবনের বন্ধনের সূত্রপাত হতে দেয়া। হয়তো কোন দিন শাশুড়িরা বুঝবেন।

আবার অপরদিকে ছেলের বউরা কখনো কি ভেবেছেন এমন করে? নিজের দুই বা তিন বছরের আদরের ছেলেকে এক নজর চোখের আড়াল করতে পারেন না। কত মায়া, কত আদর,কত উদ্বেগ। বাচ্চা এক লোকমা কম খেলে, শরীরটা একটু গরম হলে, পরে গিয়ে ব্যথা পেলে কলিজা চাপ দিয়ে আসে। এক নজর আড়াল হতে পারিনা আমরা।

অথচ ২৫- ৩০ বছর একটা সন্তানকে লালন পালন করে বড় করার পরে তার জীবনে যখন আরেকজন মানুষ আসে, যাকে সব কিছুতে সমান ভাগ দিতে হয়, তখন মায়ের জন্য রাখা সময়ে ভাগ বসেই। আগে যদি ছেলে অফিস শেষেই ঘরে ফিরতো,এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতো, আহ্লাদ করতো, এখন বউ কে নিয়ে বাইরে হ্যাং আউট করে,মুভি দেখতে যায়, শশুর বাড়ি গিয়ে থাকে। আগে মায়ের মুখ একটু কালো হলেই ছেলে এক গাদা প্রশ্ন করতো, এখন খেয়ালই করেনা। আসলে তার জীবনে আরেকটা প্রায়োরিটি এসেছে। সময়ে ভাগ বসেছে। ভুলচুক হয়েই যায়। হ্যা। ভুল হয়তো। কিন্তু তাতে যে মায়ের কি কষ্ট হয়, সেটা হয়তো নিজেকে ওই জায়গায় না রাখলে বোঝা সম্ভব না। এবং এই নতুন আচরণের সাথে মায়ের নিজেকে মানিয়ে নিতে যে কি যুদ্ধ করতে হয় নিজের মনের সাথে সে হয়তো ওই বয়সে না গেলে আমরা বুঝবোই না।

এই যে দুটো সম্পর্কের দু রকম টানাপোড়েন, এটা দূর হতে পারে যদি দুজন মানুষই একে অন্যের জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করে এবং ফেইক এক্সপেকটেশন না করে। আমার ননদকে আমার শাশুড়ি যা দেন বা যেভাবে ফিল করেন আমাকে কখনোই করতে পারবেন না। আমার মাকে আমি যেভাবে যত্ন নেই, কেয়ার করি তা শাশুড়ির জন্য করা সম্ভব না। আশা করাটাই ভুল। আর আশা ছাড়া যতটুকু পাওয়া হয় সেটাই সত্যি যত্ন, সত্যি আবেগ।

মাদার ইন ল, বা ডটার ইন ল মানে আইনের খাতিরে মা, আইনের খাতিরে মেয়ে। সেই আইন বা সামাজিক সম্পর্কটাকেই যদি আমরা সম্মান করি, একে অন্যের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করি, ছাড় দেই, অন্যের দুর্বল জায়গায় আঘাত না করি তাহলেই সম্পর্কটা মজবুত হয়।
বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়া,হোক নিজে করে বা কারোর হেল্প দিয়ে মানে আমি যদি সময় না পাই, তাদের জন্য কাজের মানুষ রেখে দেবার ক্ষমতা থাকলে সেটার ব্যবস্থা করে দেয়া। আর্থিক সাপোর্ট দেয়া। পেনশনের টাকা সবার জন্য যথেষ্ট না। সংগতি থাকলে আবেগ এবং ব্যক্তিগত ভালোলাগা,মন্দ লাগার বাইরে গিয়ে অন্তত দায়িত্বের জায়গাটা পালন করা, ছেলের বউ রা ভেবে দেখতে পারেন।

একদিন আপনিও শাশুড়ি হবেন, সেইম কষ্ট আপনিও পাবেন, সেই সময়ের প্রিপারেশন আছে তো?

আর শশুর শাশুড়িকে বলবো, আপনার সংসারে এসে বা না এসেও একটা মেয়ে আপনার মতোই আন্তরিকতায় আপনার ছেলের দেখাশোনা করে তাকে ভালোবাসে। তার ভালো চায়।

সে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। হতে পারেনা। মায়ের জায়গা মায়ের, বউয়ের জায়গা বউয়ের । কেউ কারোর অভাব পূরণ করতে পারেনা। কিন্তু বিয়ের পর তাদের নতুন জীবন উপভোগের সুযোগ দিন, প্রাইভেসি দিন, ছেলেকে আঁচলের বাইরে যেতে দিন। মানুষ হয়ে পাখির কাছে শিখুন- স্বাবলম্বী হলে বড় হলে, পাখিটাও আর বাচ্চাদের ঠোঁটে তুলে খাওয়ায় না, ডানায় করে ওড়ায় না, ধাক্কা দিয়ে ফেলে উড়তে শেখায়। ছেলেকে উড়তে দিন। আর বউ এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে নিজের ভূমিকাকে খাটো করবেন না।

আপনার ছেলের বউ যখন দেখবে, আপনি তাকে বোঝেন সেও আপনার যত্ন নেবে। আপনার ব্যবহার আপনার আয়না। যেমন করবেন আশা করা যায় তেমন ফেরত পাবেন। তাছাড়া যে নিজের এথিকস মেনে চলে, আরেকজন না মানলেও সে তার নিজের ব্যক্তিত্বের দায়রা থেকে বের হতে পারেনা। একদিন আপনার ক্ষমতা কমবে, বয়স বাড়বে, সক্ষম থেকে অক্ষম হবেন। সেই দিন গুলোর সঞ্চয় আছে তো?
সম্পর্কের উর্ধ্বে গিয়ে যদি মানবিক আচরণ করতে শিখি, নিজেকে অন্যের জুতোয় রেখে হাঁটতে শিখি সম্পর্ক গুলোর সহজ সুন্দর রসায়ন গুলো হয়তো বের করে আনা সম্ভব।

জানি ব্যতিক্রম আছে। তবে ট্রাই করে দেখতে পারেন, এতে অন্তত নিজের কাছে পরিস্কার থাকা যায়। আয়নায় নিজের সামনে নিজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়। ট্রাই করেছেন কখনো? It’s never too late!

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন