Ended soon
দক্ষতা উন্নয়ন বা স্কিল ডেভেলপমেন্ট বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ব্যক্তি জীবনে সাফল্য আনতে হলে দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। দক্ষতা অর্জন ব্যতীত প্রকৃত সাফল্য র্অজন করা যায় না। এজন্য নব নব জ্ঞান ও কৌশলের সন্ধান এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি ও আধুনিক জ্ঞান-গবেষণার সন্ধানে নিরলস প্রচেষ্ট চালিয়ে যেতে হয়। দক্ষতা উন্নয়ন সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে দক্ষতা এবং প্রতিভা সর্ম্পকে পরিষ্কা ধারণা রাখা প্রয়োজন। ‘প্রতিভা’ এবং ‘দক্ষতা’ প্রায়ই কথোপকথন এবং উপলব্ধির মধ্যে Interchangeably ব্যবহৃত হয়। প্রতিভা একটি জন্মগত গুণ এবং কোনও ব্যক্তির কিছু করার বিশেষ ক্ষমতা বোঝায়। কিন্তু দক্ষতা শেখার মাধ্যমে ব্যক্তি অর্জন করে।
প্রতিভা প্রায়শই সীমিত সংখ্যক লোকের হাতে থাকে অন্যদিকে যে কোনও ব্যক্তি একটি বিশেষ দক্ষতা শিখতে পারবেন, যদি তার ক্ষমতা এবং সদিচ্ছা থাকে কোচিং কারও প্রতিভা অর্জনে সহায়ক হতে পারে তবে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। উপরোক্ত বিষয়গুলি চিহ্নিত করার পরে এটা বলা সহজ যে প্রতিভা দক্ষতার সাথে এক অর্থে পৃথক হয় যে দক্ষতা অর্জিত হয় আর প্রতভিা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়। দক্ষতার সাথে প্রতিভা একটি পরিশ্রুত ক্ষমতা হিসাবে বিবেচিত হয়। যদি কোনও ব্যক্তি তার প্রতিভাতে দক্ষতা অর্জন করে তবে সে তার জীবন লক্ষ্যগুলি সহজে এবং কার্যকরভাবে পূরণ করতে সক্ষম হবে।
দক্ষতার দুটি দিক আছে বা দক্ষতাকে প্রধান দুই ভাবে ভাগ করা যায় – হার্ড স্কিল এবং সফট স্কিলস। হার্ড স্কিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হার্ড স্কিল নিয়ে কাজ করি। সফট স্কিল নিয়ে কম কথা বলি না। কিন্তু সফলতার জন্য উভয় দক্ষতাই প্রয়োজন।
হার্ড স্কিল: হার্ড স্কিল কোন সুনির্দিষ্ট কাজের সাথে সম্পর্কিত। এটা সহজে পরিমাপযোগ্য। হার্ড স্কিলগুলি জ্ঞানভিত্তিক, যেমন- কোন বিষয়ের দক্ষতা, বৃত্তিমূলক দক্ষতা, পেশাগত দক্ষতা, কারিগরী দক্ষতা, ভাষার দক্ষতা, নকশাবিদ, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি। ব্যক্তির লক্ষ্যে অর্জনে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। যেমন- একজন সফল শিক্ষকের শিক্ষকতা সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। একজন লেখকের লেখার দক্ষতা এবং ভাষার উপর আধিপত্যে থাকে তেমনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের প্রোগ্রামিং-এর উপর জ্ঞান থাকতে হয়।
সফট স্কিল: সফট স্কিল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত যা পরিবর্তনযোগ্য। চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য এবং আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা যা অন্য ব্যক্তির সাথে একজন ব্যক্তির সম্পর্ককে চিহ্নিত করে। যেমন- যোগাযোগ, নেতৃত্ব, সময় ব্যবস্থাপনা, মানসিক চাপের ব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, অভিযোজনযোগ্যতা, প্রতিকূলতা পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলা এবং নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি।
কর্মীরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এবং একাগ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে কঠোর দক্ষতা অর্জন করে। সফল দক্ষতার সাথে কর্মীদের একটি নির্দিষ্ট কাজ সফলভাবে সম্পাদন করার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা। নিয়োগকর্তারা প্রায়শই নিয়োগের আগে প্রার্থীর কঠোর দক্ষতা পরীক্ষা করে বা মূল্যায়ন করে। কিন্তু অধিকাংশ সময় সফট স্কিলকে অবহেলা করা হয়ে থাকে। যেমন- একজন ভাল ঔপন্যাসিকের উপন্যাস লেখায় দক্ষতা থাকে কিন্তু প্রচারের দক্ষতা না থাকায় উপন্যাস বিক্রি নাও হতে পারে। ধরে নেয়া যাক, লেখকের লেখার দক্ষতা বেশ ভালো মানের কিন্তু তাঁর লেখার সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং, স্ব-বিপনন-এর প্রয়োজন আছে। লেখার ক্ষেত্রে ভালো দক্ষতা থাকলেই একটি ভালো মানের বই লিখে সফল হওয়া যায় না। কর্মক্ষেত্রে, সফট স্কিল হার্ড স্কিল-এর পরিপূরক হিসাবে বিবেচিত হয়, যা কোনও ব্যক্তির জ্ঞান এবং পেশাগত দক্ষতার উল্লেখ করে। সমাজবিজ্ঞানীরা কোনও ব্যক্তির মানসিক বুদ্ধিমান কোয়েন্টিয়েন্ট (আইকিউ)-এর বিপরীতে কোনও ব্যক্তির সংবেদনশীল বুদ্ধিমান কোয়েন্টিয়েন্ট (ইসকিউ) বর্ণনা করার জন্য সফট স্কিল ব্যবহার করে থাকেন।
একটি প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে, কর্মচারী যাদের হার্ড স্কিল এবং সফট স্কিল একটি ভাল সংমিশ্রণ রয়েছে তারা প্রায়শই তাদের পরিষেবার জন্য বৃহত্তর চাহিদা দেখতে পান। নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিয়োগকর্তারা হার্ড স্কিল এবং সফট স্কিল-এর ভারসাম্য খুঁজে দেখেন। উদাহরণস্বরূপ, নিয়োগকর্তারা যোগাযোগের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের মূল্য দেয়। সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করার সময়, সফট স্কিলসম্পন্ন শ্রমিকরা তাদের নির্দিষ্ট কাজ বিক্রয় বা বিপণনে না থাকলেও বাধ্যতামূলক উপস্থাপনা করতে পারেন। আরেকটি মূল্যবান গুন সফট স্কিল সম্পন্ন কর্মীরা সহকর্মীদের নতুন কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দক্ষতা থাকে। সফট দক্ষতা থাকলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা প্রায়শই সবচেয়ে কার্যকর হন।
দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশে কার্যক্রম: কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য দক্ষতা, জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে সকল দেশের শিক্ষা ও দক্ষতা উচ্চ মানের, সে সকল দেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেক বেশি কার্যকর। এটা বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশ সরকার দক্ষতা উন্নয়নে জন্য অনেক কাজ করছে। বিগত কয়েক বছরে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো শক্তিশালী করা হয়েছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) ও জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিল (এনএইচআরডিএফ) গঠিত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ) এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নানা ধরনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে সরকার-এনজিও-উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন একটি মঞ্চ ‘জেনারেশন আনলিমিটেড’ কাজ শুরু করেছে।
এনএসডিএ এ পর্যন্ত এগ্রো ফুড, সিরামিক্স, কন্সট্রাকশন, ফার্নিচার, ইনফরমাল সেক্টর, আইসিটি, লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, রেডিমেড গার্মেন্ট অ্যান্ড টেক্সটাইল, টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, ক্রিয়েটিভ মিডিয়া ও জুট সেক্টরে মোট ১৩টি শিল্প-দক্ষতা পরিষদ (আইএসসি) গঠন করেছে। ইতোমধ্যে শিল্প-দক্ষতা পরিষদগুলো শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী ১৯টি কর্ম ও পেশার আদর্শমান (কম্পিটেন্সি স্ট্যান্ডার্ডস, সিএস) এবং বেশকিছু প্রশিক্ষণ উপকরণ তৈরি করেছে।
এনএসডিএ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন নির্দেশিকা ও পাঠ্যক্রম তৈরি করছে। এ পর্যন্ত মোট ১৬টি প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এনএসডিএ কর্তৃক নিবন্ধিত হয়েছে; আরও অনেক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত করার পর্যায়ে আছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীনে সারা দেশে বর্তমানে মোট ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) কাজ করছে, নির্মাণাধীন রয়েছে আরও ৪০টি টিটিসি। এছাড়াও প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা প্রশিক্ষণের জন্য আরও টিটিসি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজ নির্মাণ, মোটর-ম্যাকানিক, গ্রাফিক ডিজাইন, সিভিল কন্সট্রাকশন, কনজুমার ইলেকট্রনিক্স, তৈরি পোশাক, ওয়েল্ডিং, প্লাস্টিক, ফুড অ্যান্ড ফুড প্রসেসিংসহ মোট ৫৫টি ক্যাটাগরিতে দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। দক্ষতা প্রশিক্ষণের মান ও প্রশিক্ষণ শেষে উপযুক্ত চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান ইত্যাদি বেশকটি দেশের সঙ্গে বিএমইটি অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি গৃহকর্মীসহ বিদেশগামী শ্রমিককে কর্মস্থলে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে।
দেশীয় শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যুব উন্নয়ন অধিদফতর, সমাজসেবা অধিদফতর, সরকারি-বেসরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ব্র্যাক, ইউসেফসহ বিভিন্ন এনজিও প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অর্থমন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রকল্প ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সেইপ)-এর কার্যক্রম শুরু করেছে এবং ২০২৪ সালের মধ্যে ৯টি অগ্রাধিকার খাতে ৮,৪১,৬৮০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। সেইপ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। অভিবাসী শ্রমিকদের মিড ও হাই-লেভেল ম্যানেজারিয়াল প্রশিক্ষণ এবং দেশের অভ্যন্তরে আপ-স্কিলিংয়ের ব্যবস্থা করা এ প্রকল্পের অন্যতম কাজ। সেইপ প্রকল্পের ওয়েভিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ লাভ করেছেন এবং প্রায় প্রত্যেকেই দেশের বাইরে উচ্চ বেতনে কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। সেইপ প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ অধিক জন বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, যার শতকরা ৭২ ভাগেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে অনার্স ও ডিগ্রি কলেজে যে ধরণের উচ্চশিক্ষা চলছে, তাতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন দেখিয়েছে, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। আমাদের দেশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাজের ক্ষেত্র হলো অনানুষ্ঠানিক খাত। আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ হয় বড়জোর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এখানে মোট কর্মশক্তির সঙ্গে প্রতিবছর ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ যোগ হচ্ছে। তাদের জন্য দেশে চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দক্ষতার ঘাটতি এবং কর্মসংস্থানের অভাব।
শিল্পকারখানার চাহিদা ও আমাদের জনশক্তির দক্ষতার মধ্যে ঘাটতি রয়েছে। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের কারণে এই দক্ষতার ঘাটতি আরও বাড়বে। কারণ ডিজিটাল বিভাজন এখনও একটি বাস্তব সমস্যা, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার লোকেরা প্রযুক্তির মুখোমুখি হলে প্রায়শই আতঙ্কিত হয় কারণ তারা জানে না এর সাথে কী করতে হবে। অনেকেই বলতে পারেন, এ জন্য চাকরির বাজার বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমাদের দেশের বেকারদের কি চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে? বাজার যে মানের কর্মী চায়, তাঁরা কি সেই মানের হবেন? এখন থেকেই আমাদের এই বিষয়ে কাজ শুরু করতে হবে।