দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ির রেণু শিকারের মহাযজ্ঞ : প্রতিকার ও করণীয়
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD) লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া)। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ির রেণু শিকারের মহাযজ্ঞ : প্রতিকার ও করণীয়। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন জনাব মোঃ মহসিন, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, বরগুনা এবং জনাব জিয়াদ মাহমুদ, স্টাফ রিপোর্টার এখন টেলিভিশন। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ০৩/০৭/২০২৫ তারিখ রাত ০৮:০০ টা থেকে ৯.০০ মিনিট।
মাসুদ সিদ্দিক: এই যে অবৈধ কর্মকাণ্ড যেমন, চিংড়ির রেণু শিকার বা যেকোনো মাছের অবৈধ শিকার যেটা চলছে, সেটি নিয়ে মৎস্য আইন কী বলে? জনাব মহসিন?
মোঃ মহসিন: আমাদের মৎস্য আইনটি অনেক পুরনো ১৯৫০ সালের “প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট”। এরপর ১৯৮৫ সালে একটি সংশোধনী আনা হয়। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে: “No person shall catch, carry, or possess any fish or shrimp larvae in the estuarine and coastal waters of Bangladesh.”
আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কেউই স্টুয়ারি বা কোস্টাল এরিয়ায় চিংড়ির রেণু বা যেকোনো মাছের পোনা ধরতে পারবে না। যদি কেউ এই আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে তার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে দুই বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড। এখানে কোনো দ্ব্যর্থ নেই আইন একেবারে স্পষ্ট।
মাসুদ সিদ্দিক: আইন তো স্পষ্ট বলা আছে, কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ কি সঠিকভাবে হয়? যদি হতো, তাহলে তো অবৈধ শিকার বন্ধ হয়ে যেত।
মোঃ মহসিন: হ্যাঁ, প্রয়োগে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। বাস্তবে আমি যখন বাস্তবায়নে যাই, তখন দেখি আমাদের এখানে প্রায় ৩৫৮ কিলোমিটার নদী এলাকা রয়েছে, আর জোয়ারের সময় এই এলাকা দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ আমাদের মোট জনবল মাত্র ১২ জন। এত অল্প লজিস্টিকস ও জনবল নিয়ে কাজ করা কঠিন।
সাধারণত যেসব এলাকায় সহজে যাওয়া যায়, সেখানে যাই এবং দেখি সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্ডার-১৮ শিশু এবং মহিলারা জড়িত। তারা মাছ ধরে, বাছাই করে। এভাবে অনেক সময় আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।
আমরা প্রতি মাসে জেলা ও উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এই বিষয়টি তুলি বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে যখন রেণুগুলোর প্রাচুর্য থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ, সাধারণ পুলিশ সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয় সচেতন থাকার জন্য।
আমরা দেখেছি, এই কাজটি মূলত খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট থেকে শুরু হয়ে পিরোজপুর হয়ে চলে যায়। আমরা রুটে নজরদারি করি। যেমন পিরোজপুরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে এলার্ট করি যাতে পথে নজরদারি রাখা যায়। ইতোমধ্যে প্রায় ১২ লাখ রেণু উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করেছি।
মাসুদ সিদ্দিক: জিয়াদ মাহমুদ আপনি সরাসরি মাঠে গিয়েছেন। আপনার অভিজ্ঞতা ও ফাইন্ডিংস কী?
জিয়াদ মাহমুদ: আমরা মাঠে গিয়ে দেখি নদীর পাড়ে অনেক শিশু ও নারী রয়েছেন, যারা বাছাইয়ের কাজ করেন। অনেক সময় দেখা যায়, যেসব জেলে কাজ করেন, তারা নিজেরা খুব বেশি অংশগ্রহণ করেন না। যারা জেলেদের সহকারী, কিংবা কৃষিকাজের বিকল্প না পেয়ে এই কাজ করেন, তারাই নদীতে নামে। তারা বলে “গদি বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আর নামব না, কিন্তু গদি তো বন্ধ হয় না। গদি আমাদের টাকা দেয়, বিনিময়ে আমরা রেণু দিয়ে দেই।” তাদের ধারণা এই রেণু ধরা নিষিদ্ধ, তবে তারা জানে না এতে মাছের ক্ষতি হয়। অনেক সময় তারা ছোট মাছ ফেলে দেয়। কারণ, অতিক্ষুদ্র ফাঁসের জালে মাছের লার্ভা মরে যায়। এই অবৈধ শিকারে প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যক্তিরা জড়িত। ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি গদি তৈরি করেন, এরপর আরও কয়েকটি গদি তৈরি হয়। তারা দাদন দেন, অর্থাৎ আগাম টাকা দিয়ে রেণু সংগ্রহ করেন। এদের মধ্যে আবার ভ্রাম্যমাণ পাইকার আছে, যারা দৌড়ে দৌড়ে বিভিন্ন গদি থেকে সংগ্রহ করে। একেকজন দুই-তিন লাখ রেণু সংগ্রহ করে, তারপর সেটি মূল বাজারে বিক্রি করে। এই সিন্ডিকেটটি খুব বিস্তৃত নয়, তবে বরগুনা ও আশেপাশের কিছু পয়েন্টে সক্রিয়।
মাসুদ সিদ্দিক: জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মহোদয়, আপনি বলেছিলেন চিংড়িগুলো অবমুক্ত করা হয়। এই অবমুক্তকরণ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? এতে কি তারা বেঁচে থাকতে পারে?
মোঃ মহসিন: হ্যাঁ, বেঁচে থাকতে পারে। কারণ, তারা যখন চিংড়ির রেণুগুলো ধরে, সেগুলোর বেশিরভাগই স্টোরিং বা পরিবহনের সময় পিরোজপুর হয়ে বরিশাল, তারপর বাগেরহাট-সাতক্ষীরার মতো দূরবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এতদূর যাত্রার পরেও যদি তারা সেখানে অবমুক্ত হয়ে বেঁচে যেতে পারে, তাহলে নদীতে অবমুক্ত করলে তো অবশ্যই সারভাইভ করতে পারবে।
আমরা এগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় নদীতে অবমুক্ত করি। স্থানান্তরের সময় যেখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, তার থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরের অংশে অবমুক্ত করি যাতে পরিবেশের পার্থক্য কম হয়। তবে যদি খুব দূরে নেওয়া হয়, তাহলে সারভাইভ করার সম্ভাবনা কমে যায়।
মাসুদ সিদ্দিক: সিন্ডিকেট সম্পর্কে জনাব জিয়াদ, আপনি একটু বলুন।
জিয়াদ মাহমুদ: আসলে সিন্ডিকেটের মূল কেন্দ্র হলো যেখান থেকে এই রেণুগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়। মৎস্য কর্মকর্তা সাহেব বলেছেন সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনায় এগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়। ওখানেই মূল মোকাম, বড় আরৎগুলো রয়েছে। এই পাইকাররাই বিভিন্ন গদি (লোকাল কালেকশন পয়েন্ট) থেকে সংগ্রহ করে। গদিগুলো সাধারণত ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে প্রভাবশালী কিছু লোক দ্বারা পরিচালিত হয়। এরা স্থানীয় মানুষদের রেণু ধরায় উৎসাহিত করে এবং আর্থিকভাবে দাদন বা অগ্রিম দিয়ে জড়িত রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তারা অভিযানে গেলে তাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। স্থানীয় কিছু লোক বা বাহিনী কর্মকর্তাদের উপর মৌখিক আক্রমণ করে, গালিগালাজ করে যাতে তারা ভয় পেয়ে সরে আসে। আমরা পাথরঘাটা, বরগুনার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন গেলে দেখি মোটরসাইকেলের দুই পাশে ঝুলি বা কৌটোয় করে রেণুগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে ট্রাকে করে নেওয়া হতো, এখন বাইক ব্যবহার করা হয় যাতে সহজে নজর এড়িয়ে যাওয়া যায়। এই সিন্ডিকেট একাধিক স্তরে কাজ করে গ্রামের হকার বা সংগ্রাহক থেকে শুরু করে পাইকার, আরৎদার, পরিবহনকারী সবাই এতে জড়িত। পুরো একটা চেইন কাজ করছে।
মাসুদ সিদ্দিক: তারা কি এটা নিয়ে ভাবছে যে, হ্যাচারি বা প্রাইভেট হ্যাচারির মাধ্যমে যদি এই রেণুর চাহিদা কমানো যায়, তাহলে তো সিন্ডিকেট নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে?
মোঃ মহসিন: এক সময়, ধরুন ১০-১৫ বছর আগে, হ্যাচারির সংখ্যা ছিল অনেক। তখন এটা বেশ ভালো চলত। কিন্তু বর্তমানে হ্যাচারির সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে, এবং উৎপাদনও সন্তোষজনক নয়। অনেক উদ্যোক্তা এই ব্যবসা থেকে সরে গেছেন। আমাদের এখন দরকার প্রাইভেট সেক্টরে হ্যাচারিকে আবার সক্রিয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। যাতে তারা বাণিজ্যিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে পিএল (Post-Larvae) উৎপাদন করতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে কিন্তু কেউ ন্যাচারাল কালেকশন করে না, সবখানে হ্যাচারি বেসড প্রোডাকশন চলে। আমাদেরও সেই পথে যেতে হবে। এখানে মৎস্য অধিদপ্তরকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। দক্ষ নিয়ন্ত্রণ, নীতি সহায়তা, এবং প্রণোদনার মাধ্যমে প্রাইভেট হ্যাচারিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আমি একজন জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, তবে আমার দায়িত্ব হলো উপরে যারা আছেন, তাদের কাছে এই বাস্তব চিত্র পৌঁছে দেওয়া। যেন তারা যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
মাসুদ সিদ্দিক: হ্যাচারির পোনা নিয়ে যে ধারণা আছে, সেটা কি যথার্থ? অনেকেই বলেন, হ্যাচারির পোনা ততটা ভালো নয়, প্রাকৃতিক রেণুর মতো নয়। এজন্য গদির মালিকরা প্রাকৃতিক রেণুর প্রতি নির্ভরশীল। এ বিষয়ে জিয়াদ, আপনি কিছু বলবেন?
জিয়াদ মাহমুদ: যারা রেণু সংগ্রহ করে বা পাইকার, তারা বলছেন চাহিদা বেশি প্রাকৃতিক রেণুর। কারণ হ্যাচারির রেণু অনেক সময় গুণমানে খারাপ হয়।
আমরা শুনেছি, ভারত থেকেও মাঝে মাঝে রেণু আনা হয়, কিন্তু সেগুলোর মানও ভালো না। তাই পাইকাররা বরং এখান থেকেই সংগ্রহ করে। যদিও কিছু রেণু মারা যায় বা সারভাইভ করতে পারে না, তবু এখানকার রেণু তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য।
ভারত বা অন্য দেশ থেকে আনা রেণুগুলো অনেক সময় আরও নিম্নমানের হয়। ফলে বাজারে এখানকার প্রাকৃতিক রেণুর চাহিদা থেকেই যায়।
মাসুদ সিদ্দিক: এবার একটু টেকনিক্যাল প্রশ্ন লবণাক্ত নদ-নদী বা উপকূলীয় খাল-নদীতে রেণু ধরার ফলে অন্যান্য জলজ জীববৈচিত্র্যের উপর কতটা প্রভাব পড়ছে? জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, আপনি আগে বলুন।
মোঃ মহসিন: এটি জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি বড় হুমকি এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমার কাছে বর্তমান কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, তবে আগে জানা ছিল প্রায় ২১৭টি প্রজাতি এসব কার্যক্রমে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া অনেক প্রজাতির ক্ষতি আমাদের খালি চোখে ধরা পড়ে না। একটি মাত্র প্রজাতির পেছনে যদি আমরা এরকম নির্বিচারে চলতে থাকি, তাহলে তা সমগ্র ইকোসিস্টেমের উপর প্রভাব ফেলবে। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে নদী ও খালের অবস্থা এমনিতেই ভালো না পলি জমা, দূষণ, কীটনাশকের ব্যবহার সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
তার ওপর নির্বিচারে রেণু শিকার পুরো উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
মাসুদ সিদ্দিক: জনাব জিয়াদ মাহমুদ, আপনি কি এই বিষয়ে কিছু বলবেন?
জিয়াদ মাহমুদ: হ্যাঁ। আমরা লক্ষ্য করেছি জেলেরা যে জাল ব্যবহার করে, তা অনেক সূক্ষ্ম, যাকে ‘মশারি জাল’ বলা হয়। এই জালের মাধ্যমে তারা যখন রেণু তোলে, তখন শুধু চিংড়ি রেণুই না, বরং অসংখ্য অন্যান্য মাছের লার্ভা ধ্বংস হয়।
আমার দেখা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ প্রজাতির মাছ এই প্রক্রিয়ায় বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে। আমরা মাঠে যাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছি, তারা বলেছে “নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ নেই।” দাম অনেক বেড়ে গেছে, কারণ মাছ কমে গেছে।
এক সময় যেসব মাছ বোয়াল, পাবদা, পোয়া, বাইম, শোল, টেংরা ইত্যাদি পাওয়া যেত এখন সেগুলো প্রায় অনুপস্থিত। বোয়াল মাছ, যেটা একসময় নদীতে সহজেই পাওয়া যেত, এখন আর দেখা যায় না। এটা শুধু চিংড়ি রেণু শিকারের জন্য না, বরং গোটা পরিবেশ ব্যবস্থার উপর একটি মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এই ধরনের কর্মকাণ্ড এখন শুধু বরগুনা বা পাথরঘাটায় সীমাবদ্ধ না পুরো উপকূলজুড়েই একই রকম চিত্র দেখা যাচ্ছে।
এবং বর্তমানে এই প্রবণতা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে।
মাসুদ সিদ্দিক: এই যে কিছু মানুষ উপকূলীয় অঞ্চলে কোনো বিধি-নিষেধ মানছে না, বেআইনিভাবে চিংড়ির রেণু শিকার করছে এটা থেকে উত্তরণের জন্য মৎস্য বিভাগ কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বা কী চিন্তাভাবনা করছেন? জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, আপনি বলুন।
মোঃ মহসিন: আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি, তবে ১০০% এলাকা কাভার করা খুবই কঠিন। জনবল সীমিত তবুও যেসব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে, সেখানে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই।
ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের মাঠ সহায়ক কর্মী আছেন, তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে এলাকা ভাগ করে দিয়েছি। তারা নিয়মিত ডিউটি করে।
আমরা অনেক সময় কিছু লোককে আটক করেছি, কিছু নৌকা জব্দ করেছি। তবুও স্বীকার করতেই হয় চিত্রের তুলনায় আমাদের কার্যক্রম এখনও যথেষ্ট নয়।

মাসুদ সিদ্দিক: তাহলে যাঁরা এ কাজ করছেন, তাদের জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি না করলে তো এটা থামানো যাবে না। কী বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যায়?
জিয়াদ মাহমুদ: এরা সাধারণত বছরে মাত্র ৩–৪ মাস এই কাজে থাকে, বাকি সময় তারা কৃষিকাজ বা অন্যান্য পেশায় থাকে।
অনেকে কৃষক, আবার অনেক নারী গৃহস্থালির কাজ করেন। এ সময়টাতে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে তারা এই অবৈধ কাজে না-ও আসতে পারে। এনজিও বা সরকারিভাবে বিকল্প আয়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে এর প্রভাব পড়বে।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে তারা যে আয় করে, সেটাও তেমন লাভজনক না। ধরুন, প্রতিদিন ২০০–৫০০টি রেণু ধরে, যা মাত্র ৮০ পয়সা বা ১ টাকায় বিক্রি করে।
কিন্তু সেই রেণু মোকামে গিয়ে ৪–৫ টাকায় বিক্রি হয়। মাঝখানে সিন্ডিকেট লাভ করে, অথচ যারা সংগ্রহ করছে, তারা প্রকৃত উপকারভোগী না।
এটা শুধু টাকার ব্যাপার না এক ধরনের সামাজিক প্রভাবও আছে। পাশের কেউ করলে, আমি কেন করব না এই মানসিকতা তৈরি হয়।
মাসুদ সিদ্দিক: সামনে তো ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ’ আসছে, সম্ভবত আগস্টে। এই উপলক্ষে কি আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে?
মোঃ মহসিন: অবশ্যই আছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হবে ২২ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত।
এই সপ্তাহে প্রতিদিনই আমাদের কর্মসূচি থাকবে অভিযান, গণসচেতনতা কার্যক্রম, ওয়ার্কশপ, কমিউনিটি মিটিং ইত্যাদি। যেহেতু ঝাটকা ধরা এখন নিষিদ্ধ নয় এবং ইলিশ মৌসুম সামনে, তাই এই সময় আমরা মূলত অবৈধ জাল, বিশেষ করে চিংড়ি রেণু ধরার জাল, এই বিষয়ে অভিযান চালাচ্ছি।
আজকেই আমরা বিসকারী নদীতে অভিযান পরিচালনা করেছি। প্রতিটি উপজেলায় এই কর্মসূচি পালিত হবে।
মাসুদ সিদ্দিক: উপকূলীয় অঞ্চল তো একসময় আমাদের একটি সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম ছিল। এখন এই সংকট শুধু অবৈধ রেণু শিকারের কারণে হচ্ছে, না কি আরও কারণ রয়েছে? সংক্ষেপে বলুন।
মোঃ মহসিন: এটা শুধু রেণু শিকারের কারণে না এটা একটা সম্মিলিত সংকট।
আমরা প্রতিদিন দেখি লোকজন বিস্কুটের প্যাকেট, পানির বোতল, তেল, ফুয়েল, প্লাস্টিক জাল সব সরাসরি নদীতে ফেলে। এসব সামগ্রী সমুদ্রে গিয়ে আটকে থাকে একটা জাল কাটলে সেটা সাগরের তলদেশে পড়ে যায়, ফাঁদ হয়ে যায় মাছ ও প্রাণীর জন্য। কেউ যখন রাস্তায় ফেলে কীটনাশকযুক্ত পানির বোতল বা বর্জ্য, সেগুলো বৃষ্টির মাধ্যমে নদীতে পড়ে। এতে মাইক্রো-অর্গানিজম, ফিশ লার্ভা ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়। এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাবই আসলে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী।
ঘোস্ট নেট (পরিত্যক্ত জাল) তো আরও ভয়াবহ এগুলো সাগরের নিচে পড়ে থেকে হাজার হাজার প্রাণীকে মেরে ফেলে।
আমাদের এখানকার উপকূলীয় অঞ্চল এখন অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। এই সিস্টেমকে একক কোনো বিষয় দিয়ে দায়ী করা যাবে না সবকিছু মিলেই একটি বিধ্বংসী পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
মাসুদ সিদ্দিক: এখানে যেসব কার্যক্রম চলছে, তাতে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য বা ম্যাংগ্রোভ বন ধ্বংস হচ্ছে। বরগুনা অঞ্চলে আমাদের ২১ সিস্টেমের অংশ ছিল এমন জায়গাগুলোও এর আওতায় পড়েছে। আপনি কিছু বলুন কী কী কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি?
জিয়াদ মাহমুদ: আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আলোকপাত করতে চাই:
১. তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র: পায়রা নদীর পাশে স্থাপিত একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইতোমধ্যে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
- কয়লাবাহী জাহাজগুলো নিয়ম অনুযায়ী ঢেকে আনা উচিত, কিন্তু বাস্তবে উন্মুক্তভাবে কয়লা আনা হয়, ফলে নদীতে পড়ে দূষণ তৈরি করে।
২. অবৈধ ট্রলিং ট্রলার: নিষিদ্ধ সময়ে ও সীমা অতিক্রম করে অনেক ট্রলার মাছ ধরছে।
- ইলিশের মৌসুমে ছোট মাছ শিকার করে পরে তা পানিতে ফেলে দিচ্ছে।
- জালের মাইক্রো গেজ ব্যবহার করে ছোট মাছ ধ্বংস করছে, অথচ এসব মাছ বাজারে উপযোগী নয়।
৩. ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস: পাথরঘাটা ও তালতলীতে সংরক্ষিত বনের ডাল কেটে চরঘেরা (মাছ ধরা কাঠামো) তৈরি করা হচ্ছে।
- নদীতে দীর্ঘ দূরত্বজুড়ে এসব কাঠামো বসিয়ে রাখা হচ্ছে, যা নদী ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
৪. গবেষণার অভাব: অনেক মাছ, ডলফিন, কচ্ছপ মরে ভেসে আসছে কেন মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।এটি খুবই দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক।
মাসুদ সিদ্দিক: এখন এমপিএ বা Marine Protected Area (সংরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকা) নিয়ে কথা বলি। আমাদের দেশে এখনও মাত্র ১০% এলাকা এমপিএ ঘোষিত। উপকূলীয় অঞ্চলে এর বিস্তার প্রয়োজন কি না, বলুন।
মোঃ মহসিন: অবশ্যই প্রয়োজন। আমরা ইতোমধ্যে NGO ‘Fixnet’-এর সঙ্গে কিছু কাজ করেছি। তারা পাথরঘাটা ও তালতলীতে স্টাডি করছে।
স্টাডি রিপোর্ট জমা দিলে আমাদের বিভাগ থেকে একটা কারিগরি দল এটি পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেবে।
আমরা যদি একটি এলাকা এমপিএ ঘোষণা করি, তাহলে সেখানে যারা মাছ ধরত, তাদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিক: যদি সংরক্ষিত এলাকা বাড়ানো হয়, তাহলে তো জেলেদের মাছ ধরার সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কি করা যেতে পারে?
জিয়াদ মাহমুদ: অবশ্যই। বরগুনা, পায়রা নদীসহ বিভিন্ন এলাকায় সংরক্ষিত এলাকা আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে জীবিকা রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
- সরকার চাইলে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান যেমন কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদি উদ্যোগে নিয়ে আসতে পারে।
- তাহলে তারা সহজে এই অবৈধ শিকারের কাজ থেকে বেরিয়ে আসবে।
মোঃ মহসিন: আমাদের জেলায় বর্তমানে ৪৬ হাজার রেজিস্টার্ড জেলে আছেন। তাদের অনেকেই বিশেষ মৌসুমে সরকারের খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন (মাসে ৪০ কেজি করে চাল)।
তবে এটি সকলের জন্য সম্ভব নয়, এবং সবাইকে ঢালাওভাবে সহায়তা দেওয়া বাস্তবসম্মতও নয়।
আমরা বিকল্প কর্মসংস্থানে কাজ করছি:
- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় গরু দেওয়া হয়েছে, অনেকে ১টি গরু থেকে ৩টি পর্যন্ত করেছেন।
- জাল বিতরণ করেছি, যাতে তারা পুকুরে মাছ ধরতে পারে।
- ফুটপাতে খাবার বিক্রেতাদের হেল্প করেছি, ভ্যান বা চটপটির ভেলাসহ।
তবে বাস্তবতা হলো ৪৮% লোককে সহায়তা দেওয়া সম্ভব না। তাই আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং জনসচেতনতা (Awareness building) বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মাসুদ সিদ্দিক: অবৈধ রেণু শিকার বা মৎস্য ধ্বংসের ঘটনা ঘটে, তখন অনেকেই বলে “মৎস্য বিভাগ কিছু করছে না।” কিন্তু এটা তো কেবল মৎস্য বিভাগের একক দায়িত্ব নয়। অন্য সরকারি দপ্তর বা স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা থাকা উচিত নয় কি?
মোঃ মহসিন: অবশ্যই! আমরা কখনো একা ছিলাম না। পুলিশ, কোস্ট গার্ড, নেভি, আনসার সবাই আমাদের সহযোগিতা করেছে। আমি কখনোই সহযোগিতা চাইলে পাইনি, এমনটা হয়নি। প্রশাসন যথেষ্ট সহানুভূতিশীল, অনেকবারই তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।
জিয়াদ মাহমুদ: হ্যাঁ, সহযোগিতা চাইলে তারা দেয়, কিন্তু সমস্যা হলো তার বাইরেও তো অনেক কিছু করার সুযোগ থাকে, সেখানে সবাই এগিয়ে আসে না। অনেক সময় সময়মতো তথ্য না দিলে অভিযানও বিফলে যায়।
মাসুদ সিদ্দিক: সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও তো আসে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ বা সাধারণ মানুষ তাদেরও ভূমিকা দরকার। কী বলেন?
মোঃ মহসিন: একদম ঠিক। সবাই বাজারে গিয়ে মাছ কিনছে, জানে এটা নিষিদ্ধ সময় তাও নিচ্ছে। সুশীল সমাজের ব্যক্তিরাও ছাড় পাচ্ছে না। সচেতনতা তৈরি জরুরি বাচ্চারা যেন বলে, “বাবা, এখন মাছ ধরা নিষেধ, আমি খাব না।” এটা হলে একটা সামাজিক আন্দোলন হবে।
জিয়াদ মাহমুদ: আমরাও কিন্তু দায়ী। পেশাগত নৈতিকতার বিচ্যুতি হচ্ছে। কেউ কেউ তথ্য ফাঁস করে দেয়। এমনকি কিছু সাংবাদিক বা কর্মকর্তাও সুবিধা নেন রেণু শিকারিদের কাছ থেকে। তবে সব কর্মকর্তা এক নয় বরগুনার কর্মকর্তার মতো নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাও আছেন, যাঁরা প্রকৃত অর্থে চেষ্টা করছেন।
মাসুদ সিদ্দিক: আজকের আলাপচারিতাগুলো আমরা ডিজিটালি সংরক্ষণ করবো, ভবিষ্যতে এটি বই আকারে প্রকাশিত হবে। গবেষক, বিশেষজ্ঞ বা নীতিনির্ধারকরা এটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। আপনাদের কেমন লাগলো এই উদ্যোগ?
মোঃ মহসিন: খুব ভালো লাগলো। আমরা যা করছি, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছানো জরুরি। সবাই মিলে সচেতন হলে, তখন আমরা একটি মৎস্য-সমৃদ্ধ, নিরাপদ খাদ্যনির্ভর, টেকসই বাংলাদেশ গড়তে পারবো। আপনাকে ধন্যবাদ।
জিয়াদ মাহমুদ: নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি উদ্যোগ। এই পর্বটি শুধু একটি আলোচনা নয়, বরং এটি একটি ডকুমেন্টেশন যা বাস্তব সমস্যাগুলো তুলে ধরছে। আমি আশা করি এর ধারাবাহিকতা থাকবে, আরও পর্ব হবে। ধন্যবাদ আপনাদের।
মাসুদ সিদ্দিক: আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। সম্মানিত অতিথি ও দর্শকদের জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনাদের ভালোবাসা ও সচেতন অংশগ্রহণই আমাদের আগামীর পথচলা।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমাদের প্ল্যাটফর্মে লাইক, শেয়ার ও সাবস্ক্রাইব করুন।