উন্নয়ন আলোচনা পর্ব-২২

ndicia24

জুন ২৯, ২০২৫ | প্রকৃতি ও প্রতিবেশ

অপরিকল্পিত নগরায়নঃ কারণ ও প্রতিকার

এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD) লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ অপরিকল্পিত নগরায়নঃ কারণ ও প্রতিকারআলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্লানার এবং  তাসফিন আজিজ, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সিনিয়র লেকচারার, আর্কিটেকচার বিভাগ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মোস্তাফিজুর রহমান, পরিচালক, এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ২২/০৫/২০২৫ তারিখ রাত ০৮:০০ টা থেকে ৯.০০ মিনিট।

মোস্তাফিজুর রহমান: অপরিকল্পিত নগরায়ন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত করে কিছু বলুন?

মেহেদী আহসান: অপরিকল্পিত নগরায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যদি আমরা দেখি, এর উন্নয়ন, দর্শন বা উন্নয়ন পরিক্রমা এই যাত্রাপথ যদি আমরা ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের আমল ধরে ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে মূলত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, তখন আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ড নিয়ে একটি নতুন যাত্রা শুরু হয়। অর্থনৈতিকভাবে যদি আপনি দেখেন, স্বাধীনতার পরে দেশ ছিল একেবারে ভঙ্গুর। তারপর এলো দুর্যোগ বন্যা, মহামারিসহ নানা ধরনের দুরবস্থা। কিন্তু এই দুরবস্থার মধ্য দিয়েই দেশটির পূর্ণ গঠন হয়েছে। এই উন্নয়ন পরিক্রমায় রাজনৈতিক দিকটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে, নানা ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে, আর এই ধারাবাহিক পরিক্রমার মাধ্যমেই আমরা এখন ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছি। রাজনৈতিক পরিক্রমার সাথে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের একটি নিবিড় যোগসূত্র আছে। কারণ, রাজনৈতিকভাবে আমরা নানা ধরনের ‘আপস অ্যান্ড ডাউনস’-এর মধ্য দিয়ে এসেছি, এবং বলা যায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো একটি ম্যাচিউরড (পরিপক্ব) স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। আমরা এখনো একটি চলমান যাত্রায় আছি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটা টেকসই উন্নয়নের মডেলে পৌঁছায়নি। উন্নয়নের প্রসঙ্গে আসলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয় নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যত বেশি হবে, নগরায়ন তত বেশি হবে, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নও তত বেশি হবে আর দেশ এগিয়ে যাবে। এখন আমাদের যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল ছিল বা আছে, সেই মডেলেই প্রবৃদ্ধি কত হবে, পার ক্যাপিটা ইনকাম কত এসবই হয়ে উঠেছে আমাদের উন্নয়নের মূল নির্ণায়ক। এই উন্নয়ন নির্ণায়ক করতে গিয়ে আমরা বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে যা পেয়েছি, তা হলো ঢাকা মহানগরীসহ বাংলাদেশের অন্যান্য নগর অঞ্চল ও ছোট শহরগুলো আমরা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। এর মূল কারণ হলো আমাদের উন্নয়নের যে দর্শন বা ইকোনমিক মডেল, তার সাথে যে ভূমি ও স্থানের (land and space) সম্পর্ক, সেই সম্পর্কটিকে আমরা উপেক্ষা করেছি। ফলে আমাদের এখনো কোনো কৌশল নেই যেখানে বলা যায়, ধরুন দেশে যদি ১৮ কোটি মানুষ থাকে (যদিও এই সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে), তাহলে কতজন মানুষকে আমরা ঢাকায় রাখবো, কতজনকে অন্য শহর বা বন্দরে বা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃত করব এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। এই সংখ্যার ভিত্তিতে আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমগুলোকে সাজাতে হবে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কোন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কোথায় হতে পারে, তার একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা দরকার। এর পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থান, বাসস্থান, নাগরিক পরিষেবা ও পরিকাঠামোগত ব্যবস্থাপনাও পরিকল্পিতভাবে সাজাতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয়ভাবে এই বিষয়গুলো কীভাবে ম্যানেজ করা হবে, উন্নয়নের দর্শনের সাথে কীভাবে ইন্টিগ্রেট করে এগিয়ে নেওয়া হবে সেই ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট নীতি বা পরিকল্পনা আমাদের নেই। এই কারণেই আমরা প্রতিনিয়ত ঢাকায় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি একটু বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয়, বায়ু দূষণের দিক থেকে আমরা বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরের তালিকায় থাকি, বাসযোগ্যতার দিক থেকেও তলানিতে। এবং অন্যান্য শহরগুলোতেও অবস্থার খুব ভালো কিছু দাবি করার সুযোগ নেই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন রাজশাহী শহরের কিছু অংশে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের উদাহরণ রয়েছে। তবে জাতি হিসেবে আমরা এখনো বাংলাদেশের কোনো একটি শহরকেও সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারিনি এই গৌরব অর্জন আমরা করতে পারিনি। এটা আমাদের জাতিগত ব্যর্থতা। কারণ, এই বিষয়টিকে আমরা যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, ততটা গুরুত্ব দিতে পারিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান: তাহলে আপনি কি বিকেন্দ্রীকরণের (Decentralization) কথা বলবেন? মানে শহরের উপর যেভাবে চাপটা পড়েছে আমি যদি ঢাকার কথা বলি, তাহলে কি রাজধানীতে যে ভীষণ একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কি কমানো সম্ভব হবে যদি প্রশাসনিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়? আপনি কি মনে করেন এতে চাপটা কমবে?

মেহেদী আহসান: আমরা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স-এর পক্ষ থেকে দেড় বছর ধরে গবেষণা করে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। আসলে, এটা বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ঢাকাকে কেন্দ্র করে সমাধান করা সম্ভব নয়। এমনকি ঢাকার সমস্যা সমাধান করতেও শুধু ঢাকা শহরকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা যথেষ্ট নয়। আমাদের বাংলাদেশের সম্পূর্ণ ভৌগোলিক এলাকার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। পাশাপাশি একটি কৌশলপত্র লাগবে যেখানে নির্ধারণ করা হবে, ঢাকা শহরে কত মানুষের কর্মসংস্থান হবে, চট্টগ্রাম, রংপুর, পাইকগাছা বা দেশের অন্যান্য এলাকায় কত মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। আমাদের প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদ বিবেচনায় এনে সেখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সাজাতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সেই অনুযায়ী নগরায়নও সাজাতে হবে। তাহলেই ঢাকার উপর চাপ কমবে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে যদি সুনির্দিষ্টভাবে বলি, তাহলে ঢাকার সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান কী হতে পারে? বিকেন্দ্রীকরণ অবশ্যই একটি মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে যা করা যায়, তা হলো আমাদের ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করা। এছাড়া ঢাকার আশেপাশে যেসব ছোট শহর আছে যেমন মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ এই শহরগুলোর সঙ্গে যদি আমরা সংযোগ বা connectivity বাড়াতে পারি এবং যাতায়াতের সময় যদি কমাতে পারি, বিশেষ করে যাতায়াতের সময় যেন নির্ভরযোগ্য (predictable) হয়—তাহলে ঢাকার উপর অর্ধেক চাপ কমে যাবে। আপনি চিন্তা করে দেখুন, যদি মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ ও ময়মনসিংহ থেকে কেউ ঢাকা শহরে এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে যাতায়াত করতে পারেন এবং আবার ফিরে যেতে পারেন তাহলে কিন্তু অনেকেই আর ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকবেন না। কারণ, আমরা কেউই চাই না আমাদের সন্তান দূষিত বায়ু গ্রহণ করুক, কিংবা পরিবার দুর্ভোগে পড়ুক। এই ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে পারলে, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ মৌলিক সেবা যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তাহলে ঢাকার উপর চাপ অনেকটাই কমবে। যদিও এটাও সম্পূর্ণ তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, এটা মাঝারি মেয়াদি সমাধান। তবে, যদি তাৎক্ষণিক সমাধানের কথা বলি, তাহলে আমাদের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি শুধু তাৎক্ষণিক চিন্তা করলেই হবে না, আমাদের মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাও করতে হবে। কারণ, সাধারণত আমাদের সরকারগুলো শুধু ইমিডিয়েট বা তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানেই ব্যস্ত থাকে। মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় তারা খুব একটা মনোযোগ দেয় না। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারগুলো বেশি ইমিডিয়েট চিন্তা করে, কারণ তারা নিজেরাই জানে না তাদের মেয়াদ কতদিন। তাই আমার জানা মতে, কোনো মন্ত্রণালয়েই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। সবাই শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান নিয়েই ব্যস্ত।  

মোস্তাফিজুর রহমান: জনাব তাসফিন সাহেব, অপরিকল্পিত নগরায়নের মূল কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন? এবং গ্রাম থেকে শহরে যে অভিবাসনের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণগুলো কী?

তাসফিন আজিজ: নগর আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন’ বলে আমরা যেটা বলছি, সেটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। আমরা যেটা দেখি, সেটা হলো সামগ্রিক জনজীবনের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা মূলত দুইটা কারণে তৈরি হয় একটা হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণ, আরেকটা হচ্ছে সামাজিক। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ অনেক সময় ব্যর্থ হতে পারে, যদি প্রকৃতি বা প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের প্রতি আমাদের উদাসীনতা তৈরি হয়। আমি সব সময় এভাবে দেখতে চাই, আমাদের যেভাবে নগরায়ন হচ্ছে, সেটা আমরা পরিপক্ব নগরায়ন (matured urbanization) হিসেবে দেখতে পারি না। আমরা একাডেমিয়াতে যেটা বলি, সেটা বেশ রুটিমেন্টারি আরবানাইজেশন খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের নগরায়ন। এটা বলার পেছনে দুইটা কারণ আছে।

প্রথমত, যদি তাত্ত্বিকভাবে নগরায়ন প্রক্রিয়াটা দেখি, তাহলে এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়াটা তখনই পরিপূর্ণতা পায় যখন আমরা তিনটি নির্দিষ্ট স্তরের কথা চিন্তা করি।

প্রথম ধাপটা হলো মানুষের আগমন বা স্থানান্তর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ আসছে। সাধারণত, আমাদের গ্রামীণ এলাকা থেকে মানুষ শহরের দিকে যাত্রা করে।

দ্বিতীয় ধাপটা হলো শহরে এসে তার পেশাগত জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটছে কি না।

তৃতীয় ধাপটি হলো তার মানসিক পরিবর্তন ঘটছে কি না।

আমাদের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায়, আমরা শুধু প্রথম ধাপটিকে নগরায়ন ধরে নিই যে গ্রাম থেকে কিছু মানুষ শহরে এল, এখন নগর প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট পরিষেবা সংস্থাগুলো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে এই মানুষগুলোর ব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু নগরায়ন প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ নিয়ে আমরা খুব কম কাজ করি। মানুষ যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই শহরে আসে, সে কি আসলে তার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে? তার প্রতিবন্ধকতাগুলো কোথায় তৈরি হচ্ছে? এই প্রেক্ষিতে আমি দ্বিতীয় একটা দিক বলতে চাই—মানুষ নগরে আসে দুইভাবে। হয় সে নিজ ইচ্ছায় আসে, শহরের উপযোগিতা ও সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে চায়; অথবা সে বাধ্য হয়ে আসে। প্রথম ক্ষেত্রে আমরা দেখি, বড় একটি যুব জনসংখ্যা বা ‘ইউথ কোহর্ট’ আছে, যারা ভালো কিছু করার আশায় নগরমুখী হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, অনেকেই বাধ্য হয়ে আসে যেমন, জলবায়ু অভিবাসীদের (climate migrants) কথা বলা যায়। তারা বাধ্য হচ্ছে তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে চলে আসতে। এই পুরো প্রেক্ষাপট একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে আমাদের নগরায়ন এখন নানা ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। এখানে প্রশ্নটি কেবল নগর পরিকল্পিত হবে কি না, সেটাই না; বরং, নগরের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষায় যে বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে, সেটাই মুখ্য। নগর তো মানুষকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা “আপনারা আসুন, এখানে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, উন্নয়নের মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান রাখবেন, একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক কাঠামো তৈরি হবে, একটি বাসযোগ্যতা গড়ে উঠবে।” কিন্তু বাস্তবে আমরা উল্টো চিত্র দেখি মানুষ বাধ্য হয়ে আসছে, আবার যারা ইচ্ছায় আসছে, তারাও তাদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রসঙ্গটা আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি। যদি মানুষ-কেন্দ্রিক চিন্তা করি, তাহলে মানুষের আকাঙ্ক্ষাগত দিক (aspirational aspect) অর্থাৎ ‘আরবান এসপিরেশন’ থেকেই মূলত নগরায়নের সূত্রপাত ঘটে, এবং এটি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। এক পর্যায়ে এসে মানুষের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা তৈরি হয়, যা মেটাতে পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে। কিন্তু এই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে এক বড় ধরনের বৈপরীত্য থেকে যায়, যার কারণেই আমরা প্রাথমিকভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ন দেখতে পাই।

মোস্তাফিজুর রহমান: আপনার কথার মধ্যে একটি সুন্দর দিক উঠে এসেছে যাঁরা ফোর্স মাইগ্রেশনের শিকার, তাঁরা বাধ্য হয়ে শহরে আসছেন। আবার এমন একটি শ্রেণিও আছে, যারা আরও ভালো সুযোগ বা আরাম-আয়েশের আশায় শহরমুখী হচ্ছেন। কিন্তু সেই ‘ভালো কিছু’ যদি আমরা নগর থেকে গ্রামে সরিয়ে নিতে পারি, তাহলে আমার মনে হয় শহরের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমতে পারে।

তাসফিন আজিজ: কিছুটা কমবে, তবে এর সাথে একটি বিষয় যোগ করতে চাই শুধু সুযোগ-সুবিধা গ্রামে নিয়ে গেলেই মানুষ সেখানে যাবে, এমনটি ভাবা ঠিক নয়। আমাদের মূল সমস্যা হলো, আমরা বিষয়গুলো সামগ্রিকভাবে না দেখে খণ্ডিতভাবে দেখি। আমরা সাধারণত সেক্টরভিত্তিক পরিকল্পনা করি যেমন, একটি নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিকে ঘিরে উন্নয়ন ঘটাতে চাই। কিন্তু মানুষ শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্থান পরিবর্তন করে না। মানুষের প্রথম চাহিদা হলো ‘সহাবস্থান’ যা তার পরিচিত পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন এবং সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনের সাথে জড়িত। একজন মানুষ যখন গ্রাম থেকে শহরে আসে, তখন সে এই সম্পর্কগুলো ছিন্ন করে আসে। তার ভেতরে থাকে সেই সম্পর্কগুলো পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা। আর এই ‘ফেরত পাওয়ার’ সুযোগ বা অনুষঙ্গগুলো যদি আমরা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে নগরমুখী মানুষের হার কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। তখন আমরা হয়তো অপরিকল্পিত নগরায়নের রিভার্সাল প্রক্রিয়া দেখতে পাব।

মোস্তাফিজুর রহমান: জনাব মেহেদী সাহেব, আপনি কি বলবেন নগরায়ন কীভাবে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করছে? বিশেষ করে শিশু ও নারীদের ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে?

মেহেদী আহসান: নগরায়নের রিভার্স কোনো দেশে কখনোই হয়নি। যদি আমরা বৈশ্বিক প্রবণতা দেখি, তাহলে দেখা যায় যে দেশে যত বেশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, সে দেশে নগরায়নের হারও তত বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে নগরায়ন বাড়বেই। মানুষকে শহর থেকে গ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় এটা কোনো দেশই পারেনি। গত ৩০ বছর ধরেই সরকার ‘একটি বাড়ি একটি খামার’, ‘চলো গ্রামে ফিরে যাই’ ইত্যাদি বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু নগরায়ন কি রোধ করা গেছে? না, যায়নি। কারণ নগরায়ন একটি অর্থনৈতিক বল একটি economic force যেটিকে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই। বরং এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে দেশের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটিই ভাবার বিষয়। তখনই আমরা এটিকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারব। বর্তমানে নগরায়নের মাত্রা অনেক বেড়েছে। স্বাধীনতার সময় যেখানে নগরায়নের হার ছিল মাত্র ৭-৮ শতাংশ, এখন তা প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই হার ৬০–৭০ এমনকি ৮০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এর প্রভাব আমরা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি। শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন বস্তিতে বসবাস করছে বিশেষ করে ঢাকায়। অন্যান্য শহরেও কমবেশি একই অবস্থা। এটি একটি বড় সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব। কারণ সারা দেশ থেকে বিভিন্ন কারণে যেমন নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জীবিকার সমস্যা ইত্যাদি মানুষ শহরে এসে ঠাঁই নিচ্ছে। যাঁদের যেটুকু সামর্থ্য আছে, তাঁরা শহরের ভাড়াবাড়িতে থাকছেন; আর নিম্নআয়ের মানুষগুলো বস্তিতে বাস করছেন। ফলে প্রতিনিয়ত বস্তির সংখ্যা বাড়ছে।

এটি অপরিকল্পিত নগরায়নের অন্যতম বড় প্রভাব। আরেকটি প্রভাব হচ্ছে ঢাকা শহর এখন কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। পরিকল্পনার বাইরে গড়ে উঠছে অসংখ্য বিল্ডিং। এইভাবে চলতে থাকলে নগরায়ন পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং বিশেষ করে শিশু ও নারীদের জীবনমানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মোস্তাফিজুর রহমান: আপনার কথায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে যাঁরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তাঁরা বাধ্য হয়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার এমন একটি শ্রেণিও আছে, যারা আরও ভালো সুযোগ কিংবা আরাম-আয়েশের আশায় শহরমুখী হচ্ছেন। কিন্তু যদি আমরা সেই ‘ভালো কিছু’ যেমন জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো নগর থেকে গ্রামে স্থানান্তর করতে পারি, তাহলে আমার মনে হয় শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।

তাসফিন আজিজ: হ্যাঁ, চাপ কিছুটা কমতে পারে। তবে এখানে একটা বিষয় জোর দিয়ে বলতে চাই শুধু সুযোগ-সুবিধা গ্রামে নিয়ে গেলেই মানুষ সেখানে যাবে, এমন ভাবা ঠিক নয়। আমাদের মূল সমস্যা হলো, আমরা বিষয়গুলোকে সামগ্রিকভাবে না দেখে খণ্ডিতভাবে দেখি। সাধারণত আমরা সেক্টরভিত্তিক পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকি যেমন, একটি নির্দিষ্ট শিল্পকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন ঘটাতে চাই। কিন্তু মানুষ কেবল অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় স্থান পরিবর্তন করে না। তার প্রথম চাহিদা হলো ‘সহাবস্থান’ যেখানে পরিচিত পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন ও সামাজিক সম্পর্কের বন্ধন থাকে। একজন ব্যক্তি যখন গ্রাম থেকে শহরে আসে, তখন তাকে এই সম্পর্কগুলো ছিন্ন করতে হয়। অথচ তার মধ্যে সেই বন্ধনগুলো পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়।

এই ‘ফেরত পাওয়ার’ সুযোগগুলো যদি আমরা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামে তৈরি করতে পারি, তাহলে নগরমুখী মানুষের প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। তখন হয়তো আমরা অপরিকল্পিত নগরায়নের রিভার্সাল প্রক্রিয়া দেখতে পারব।

মোস্তাফিজুর রহমান: জনাব মেহেদী সাহেব, আপনি কি আমাদের বলতে পারেন নগরায়ন কীভাবে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জীবনমানকে প্রভাবিত করছে? বিশেষ করে শিশু ও নারীদের ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?

মেহেদী আহসান: নগরায়নের রিভার্সাল কোনো দেশেই ঘটেনি। বৈশ্বিক প্রবণতা যদি দেখি, দেখা যাবে যে দেশে যত বেশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, সেই দেশেই নগরায়নের হারও তত বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যত বাড়বে, নগরায়ন তত বাড়বে। মানুষকে শহর থেকে গ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় এটা কোনো দেশই পারেনি।

গত ৩০ বছর ধরে সরকার ‘একটি বাড়ি একটি খামার’, ‘চলো গ্রামে ফিরে যাই’ ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু নগরায়ন কি থেমেছে? হয়নি। কারণ নগরায়ন একটি অর্থনৈতিক বল একটি economic force যেটিকে থামানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে আমরা এই অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারি। তখনই আমরা পরিকল্পিতভাবে নগরায়নকে পরিচালনার সুযোগ পাব।

বর্তমানে নগরায়নের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। স্বাধীনতার সময়ে যেখানে নগরায়নের হার ছিল ৭-৮ শতাংশ, এখন তা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই হার ৬০–৭০ এমনকি ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর ফল আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি।

ঢাকা শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে। অন্যান্য শহরেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। এটি বড় ধরনের সামাজিক ও জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত সংকট। কারণ সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় বা জীবিকার অভাবের কারণে মানুষ শহরে এসে ঠাঁই নিচ্ছে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা ভাড়াবাড়িতে উঠছেন, আর বাকি মানুষগুলো বস্তিতে ঠাঁই নিচ্ছেন। ফলে বস্তির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

এটি অপরিকল্পিত নগরায়নের অন্যতম প্রধান নেতিবাচক ফলাফল। এর পাশাপাশি, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ঢাকা শহর ধীরে ধীরে একটি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে। পরিকল্পনার বাইরে গড়ে উঠছে অসংখ্য ভবন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে নগরায়ন পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, এবং বিশেষ করে শিশু ও নারীদের জীবনমানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মোস্তাফিজুর রহমান: মেহেদী ভাই, ড্যাপ (DAP) নিয়ে আমি আপনার কাছ থেকে একটু জানতে চাচ্ছি। এটি আসলে কোথায় আছে, সেটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার না। আপনি একটু বিস্তারিত বলবেন?

মেহেদী আহসান: ড্যাপ অর্থাৎ ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (Detailed Area Plan) এটি ঢাকা মহানগরের জন্য একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা। আমি আগেও বলেছি, প্রথম ড্যাপ হয়েছিল ২০০৮-১০ সালের দিকে। বর্তমানে দ্বিতীয় ড্যাপ প্রণয়ন ও গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর এটিতে কিছু সংশোধনী আনা হয় রাজউকের পক্ষ থেকে।

কিন্তু ৫ই আগস্টের পর থেকে কিছু মহল এটিকে বাতিলের দাবি তুলেছে। আমরা, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের পক্ষ থেকে বলেছি পরিকল্পনা বাতিল করা যাবে না। আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি।

ড্যাপ আপডেট করা যেতে পারে, কারণ এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতি ৫ বছর পরপর হালনাগাদ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এটি যদি বারবার পরিবর্তন করা হয়, তাহলে পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে। আগের ড্যাপ অনুমোদনের আগে ১৫৬ বার পরিবর্তন করা হয়েছিল। এটা তো শহরের বাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে।

একদিকে বাসযোগ্যতা রক্ষা, আরেকদিকে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আমরা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে না, কিন্তু তারা যেভাবে ড্যাপ বাতিলের দাবি করছে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। শহর যদি অপরিকল্পিতভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে রাজউক কিংবা পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাই উঠে যাবে।

ড্যাপের মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা আংশিক হলেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবায়নের যে সক্ষমতা দরকার, তা রাজউক দেখাতে পারছে না।

২০২২ সালে গেজেট প্রকাশের পর তিন বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে রাজউক কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও রাজউক যেন কেবল Floor Area Ratio (FAR) নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ ড্যাপে আরও বহু নতুন ধারণা ছিল।

একটা বড় সমস্যা হলো, ড্যাপ বাস্তবায়নে অনেক সংস্থা যুক্ত, যেমন এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ, MRT প্রকল্প, ইত্যাদি। কিন্তু তারা রাজউকের পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় রাজউকের মতামত নেওয়া হয় না। যেমন, আমাদের ইনস্টিটিউটের পাশে হাতিরঝিল ও পান্তকুঞ্জ পার্ক এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হচ্ছে, যা ড্যাপের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এতে পার্ক ধ্বংস হচ্ছে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এক্সপ্রেসওয়ের সংজ্ঞাও তো মানা হচ্ছে না। শহরের ভেতরে নামিয়ে দিলে তা ফ্লাইওভার হয়ে যায়, এক্সপ্রেসওয়ে নয়। পলাশীতে ট্রাফিক নামলে সেখানে ফ্ল্যাশ ফ্লাডের মতো জ্যাম তৈরি হবে এই ধরনের বিশ্লেষণ কোনো পরিকল্পনায় নেই।

সরকার একদিকে গেজেট করে বলছে এটি একটি আইনি দলিল, অন্যদিকে আরেকটি সরকারি সংস্থা সেই আইন অমান্য করে চলেছে। এমন আরও বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে সরকারি দপ্তরগুলো নিজেরাই ড্যাপ মানছে না।

রাজউক নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও ড্যাপ মানছে না। তাহলে এই পরিকল্পনার বাস্তবতা কী? এত শ্রম, এত টাকায় পরিকল্পনা করে যদি কেউ না মানে, তাহলে তো আমাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনগুলোরও কোনো মূল্য থাকে না।

মোস্তাফিজুর রহমান: বর্তমানে ড্যাপ কি স্থগিত আছে?

মেহেদী আহসান: না, ড্যাপ স্থগিত নয়। কিছু দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অংশ পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার যখন একটি পরিকল্পনাকে গেজেট আকারে অনুমোদন করে, তা আইনের মর্যাদা পায়। এটি বাতিল বা স্থগিত করার একমাত্র ক্ষমতা রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর। রাজউকের বা অন্য কারো এখতিয়ার নেই এটি স্থগিত করার।

মোস্তাফিজুর রহমান: আমি একটু তাসফিন ভাইয়ের কাছে শুনতে চাই। আপনি কী মনে করেন সিটি কর্পোরেশন, রাজউক এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কেমন ধরনের সমন্বয় প্রয়োজন? আমার যেটা মনে হয়, মেহেদী ভাইয়ের কাছ থেকে শুনলাম এই সমন্বয়টা প্রায় নেই বললেই চলে। তারা প্রয়োজনই অনুভব করছে না। আপনি একটু বলবেন, প্লিজ?

তাসফিন আজিজ: আপনি যদি ভালোভাবে নজর দেন, যেসব শহরকে আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখি সেইসব শহরে স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন সিটি কর্পোরেশন, তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকে।

আমাদের ক্ষেত্রেও সিটি কর্পোরেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত ছিল। সেইসাথে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেসি বা বিচারিক ক্ষমতা থাকাও জরুরি ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের সিটি কর্পোরেশনগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় তারা সেই স্বাধীনতা পায় না।

আমরা জানি, দেশে বর্তমানে ১২টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩২৮টি পৌরসভা আছে। কিন্তু তারা তাদের পরিকল্পনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না। আমরা বোগোতা (কলম্বিয়ার রাজধানী) সম্পর্কে জানি টেক্সটবুকে পড়া একটি উদাহরণ, যেখানে একজন মেয়র ‘নগরপিতা’র ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু আমাদের দেশে, এই শহরের প্রতি ভালোবাসা বা মায়া আছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমরা খুঁজে পাই না। আমার মতে, সিটি কর্পোরেশন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যারা নাগরিকদের সরাসরি সেবা দেয়। যদিও তারা প্রধানত তিন-চারটি পরিষেবায় সীমাবদ্ধ, তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়া উচিত। সেইসাথে রাজউক এবং অন্যান্য লাইন মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোকেও সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে একসাথে কাজ করতে হবে। তাহলে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও ভাঙা সম্ভব। একটা উদাহরণ দেই রাজউক একসময় ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ছিল, পরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হয়েছে। তাদের ম্যান্ডেট ছিল ‘ডেভেলপমেন্ট কন্ট্রোল’ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন। কিন্তু এখন রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে বিক্রিও করছে, আবাসন ব্যবসাতেও নেমে পড়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজের কর্মপরিধির বাইরে গিয়ে অন্যদের জায়গায় ঢুকে পড়ছে। এই ‘সাইলো ইফেক্ট’ বন্ধ করা জরুরি। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় স্থানীয় সরকার বিভাগকে শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় লিডারশিপ, সক্ষমতা এবং আইনগত ক্ষমতা দিতে হবে। তাহলেই নগর পরিকল্পনা একটি কেন্দ্রীয় জায়গায় এসে দাঁড়াবে। আমার মনে হয়, বর্তমানে কেউই ‘নগর ভাবনা’ থেকে কাজ করছে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজেকে ‘সেবা প্রতিষ্ঠান’ বললেও, তারা আসলে কাকে সেবা দিচ্ছে, সেই প্রশ্নটা অনুপস্থিত। ধরুন, পানির বিষয়েই বলি প্রায় পাঁচ বছর আগের এক তথ্য অনুযায়ী, এই শহরে দৈনিক দুই বিলিয়ন গ্যালন পানির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ওয়াসার মাধ্যমে আমরা এর অর্ধেকও পাচ্ছি না। তাহলে বাকি অর্ধেক জনগণ কীভাবে পানি পাচ্ছে? এটা থেকেই বোঝা যায়, আমাদের নগরায়ন অপরিকল্পিত। প্রতিটি সেবা প্রদানকারী, আইন প্রয়োগকারী এবং নীতি নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট ভুল, ত্রুটি এবং উদাসীনতার ফলেই আজকের এই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

মোস্তাফিজুর রহমান: একটি জিনিস আমরা লক্ষ্য করছি, আমরা এমনি এমনিতেই সমস্যায় জর্জরিত  ঢাকা বলেন, চট্টগ্রাম বলেন, রাজশাহী বলেন  হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, মেহেদী ভাই সম্ভবত রাজশাহীর কথা বলছিলেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য বড় বড় শহরগুলোকে আমরা ‘মহানগর’ বলি। আপনি দেখবেন, ভালুকা পর্যন্ত কিন্তু সম্প্রসারিত হয়ে গেছে শহরের বিস্তৃতি। আর কিছুদিন গেলে হয়তো ঢাকা থেকে ভালুকা পর্যন্ত মাঝখানে রাস্তার পাশে কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না পুরোটা জুড়ে একটানা নগরায়ন হয়ে যাবে। একই অবস্থা সাভার ও টাঙ্গাইলের দিকেও হচ্ছে। মেহেদী ভাই, আপনার কাছে জানতে চাই, আগামী পাঁচ বছরের জন্য যদি আপনাকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আধুনিক শহর (ইন্টিগ্রেটেড টাউন) গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে আপনি কী ধরনের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবেন?

মেহেদী আহসান: আপনি যা দায়িত্ব দিলেন, সেটা হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আধুনিক শহর গঠনের জন্য একটি কর্মসূচি বা রোডম্যাপ তৈরি করা। আমি সেটার ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

প্রথমত, আমাদের নীতিমালায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন দরকার। এটি খুব সহজেই সম্ভব, এবং করলে তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, পরিকল্পনা কমিশন হলো সেই জায়গা যেখান থেকে সব ধরনের সরকারি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। সুতরাং, একটি সরকারি সার্কুলার জারি করা যেতে পারে  যেখানে বলা থাকবে, যে কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ যখনই কোনো প্রকল্প গ্রহণ করবে, তা অবশ্যই মহাপরিকল্পনার (যেমন, ড্যাপ) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

এটি বাস্তবায়ন খুব সহজ। সরকার চাইলে আগামীকালই এই পরিপত্র জারি করতে পারে। আর একবার এটি হলে, সরকারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রকল্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাস্তবায়ন হবে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নে আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সেটি হোক উপদেষ্টা, রাজউকের চেয়ারম্যান, কিংবা রিকশাওয়ালা  সবার জন্য এক আইন। এতে পরিকল্পনার প্রতি আস্থা ও শৃঙ্খলা তৈরি হবে।

তৃতীয় অগ্রাধিকার: বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন। উদাহরণ দেই একসময় ব্যাংকক শহরে ঢাকার মতো অনেক বস্তি ছিল। কিন্তু এখন ব্যাংককে কোনো বস্তি নেই। তারা কী সেই মানুষগুলোকে শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে? না। তারা পুনর্বাসন ও উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নত করেছে।

এই রকম মডেল রয়েছে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কিছু এলাকায়। পরীক্ষিত এসব মডেল যদি তারা বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না?

চতুর্থত, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, বা অন্যান্য সরকারি দপ্তরগুলো এখনও সেই কর্মদক্ষতা ও লোকবলের ঘাটতিতে আছে। যেভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়ে ঢাকা শহরকে এই পরিস্থিতিতে এনেছে, সেভাবে চালালে এই শহরের কোনো পরিবর্তন হবে না, আমি লিখে দিতে পারি।

তবে আমরা আশাবাদী। আমরা জানি সমস্যাগুলো কোথায়, এবং সমাধানের কৌশলও আমাদের জানা।

আমরা চাই যে, কেবল একজন ব্যক্তি বা একজন মেয়র নির্ভর পরিকল্পনা না করে, দলগত ও সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পরিবর্তন হোক। উদাহরণ দেই ক্রিকেট খেলায় যদি শুধু সাকিব আল হাসান থাকেন, তাহলে কাপ জেতা সম্ভব না। সেখানে ১১ জন খেলোয়াড় লাগে কেউ ব্যাটসম্যান, কেউ বোলার, কেউ ফিল্ডার, কেউ উইকেটকিপার। একইভাবে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় সব বিভাগ, সব প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কর্মীদের সম্মিলিত দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ দরকার।

সবশেষে বলি আমাদের দরকার একটি জাতীয় পর্যায়ের কৌশলপত্র, যেখানে: জাতীয় পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা (যেমন উপকূল, পাহাড়, হাওড়, বারিন্দ অঞ্চল অনুযায়ী ভিন্ন পরিকল্পনা) স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা (পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত) এই তিন স্তরে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ড্যাপ একটি স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা। এ ধরনের পরিকল্পনা প্রতিটি অঞ্চলে করতে হবে। আমাদের হাতে গবেষণা, সমাধান, কৌশলপত্র ও প্রস্তাবনা আছে আমরা সরকারের হাতে তুলে দিয়েছি। এখন দরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তবে যদি আবার শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি যেমন, একজন মেয়র নির্বাচিত হন, যিনি মনে করেন তিনি তিন মাস বা ছয় মাসে ঢাকা শহরের দৃশ্যপট বদলে ফেলবেন সেটা বাস্তবসম্মত নয়। তিন বছরেও সম্ভব না।

সুতরাং, উন্নয়নের জন্য আমাদের দরকার একটি পূর্ণাঙ্গ দল, কার্যকর প্রতিষ্ঠান, এবং পরিকল্পিত, আইনের শাসনভিত্তিক বাস্তবায়ন কাঠামো।

মুস্তাফিজুর রহমান: মেহেদী সাহেব যে কথাগুলো বলেছেন, বিশেষ করে শেষে আপনার গ্রামের বা ইউনিয়নের একটি ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং, এমনকি আঞ্চলিক বা উপজেলা ও পৌরসভার প্ল্যানিং এই পরিকল্পনার বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।

তাসফিন আজিজ: যে তিনটি স্তরের পরিকল্পনার কথা বলেছেন, তার সাথে পুরোপুরি একমত। স্থানিক পরিকল্পনার অভাব আমরা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি। এই অভাব থেকে কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা বলার আগে আমি একটু ভিন্নভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। আমাদের সমাজে একটি প্রবণতা আছে অন্য কাউকে অনুকরণ করার। উদাহরণস্বরূপ, আমরা আগের একটি সরকারের সময় শুনেছি, “আমরা সিঙ্গাপুর হতে চাই।” অথচ, এই অনুকরণে আমরা ভুলে যাই আমাদের প্রেক্ষাপট। আমি সম্প্রতি একটি বই পড়েছি, Cities for People—লিখেছেন ইয়ান গেহল, যিনি একজন কোপেনহেগেন-ভিত্তিক স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ। সেই বইয়ে ‘Brazilian Syndrome’ নামে একটি অধ্যায় আছে, যেখানে ব্রাজিলিয়ার শহর পরিকল্পনার সমালোচনা করা হয়েছে। লেখক বলছেন—যদি একটি শহর অতিমাত্রায় স্থাপত্যকেন্দ্রিক বা কেবল ভৌত উন্নয়নমুখী হয়, তাহলে শহরটি প্রাণহীন হয়ে পড়ে। সেখানে মানুষের জীবনের গুণগত পরিবর্তনও আসে না।

সুতরাং, পরিকল্পনা হতে হবে মানুষকেন্দ্রিক। মানুষের জীবনে ছোঁয়া আনে এমন পরিকল্পনা দরকার। এটি শুধু টেকনিক্যাল কোনো কাজ নয়, বরং এটি মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ার একটি সামাজিক দায়িত্ব। আমাদের কাজের মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত মানুষ ও তার ভবিষ্যৎ।

তবে এখানে একটি জটিলতা আছে সাসটেইনেবিলিটির বিষয়টি। আমরা নিজের ভবিষ্যৎও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি না, তাহলে আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনগুলো কীভাবে নির্ধারণ করব? এই প্রশ্ন কঠিন হলেও, আমরা ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস, ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং প্রজন্মগত রূপান্তর বিশ্লেষণ করে একটি ধারণা নিতে পারি।

পরিকল্পনা হওয়া উচিত ইনক্রিমেন্টাল, অর্থাৎ ধাপে ধাপে আগানো এবং সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম এমন। আমাদের একটি বড় সমস্যা হলো পরিকল্পনা বিষয়ে সামগ্রিক জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব। ‘পরিকল্পনা’ বলতে আমরা অনেক সময় শুধু একটা কাগজে আঁকা ম্যাপ বুঝি। অথচ, প্রতিদিন সকালে কী খাব সেটাও এক ধরনের পরিকল্পনা।

শহরের বিষয় বললে, ‘Urban Metabolism’ বা ‘নগর বিপাকীয় প্রক্রিয়া’ নামে একটি ধারণা আছে। একটি নগর কতটুকু চাপ নিতে পারে, কিভাবে ধাক্কা সামলাতে পারে, এবং কীভাবে দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারে এসব এর অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা শহরের এখন যে অবস্থা, সেটা দেখলে মনে হয়, এর ‘Metabolic Capacity’ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে নানা অসুখের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে বললে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায্যতা-ভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার, যেখানে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সকল বয়স ও শ্রেণির জনগণের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে।

মেহেদী আহসান: তাসফিন অনেক ভালো বললো, তবে আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করবো। কারণ হচ্ছে, আমরা শুধু মানুষ নই, আমরা একটি বাস্তুসংস্থানের অংশ। তাসফিন বললো, “মানুষের জন্য পরিকল্পনা,” কিন্তু আমি বলি, শুধু মানুষের জন্য পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়।

আমরা যদি বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে না পারি, তাহলে আমাদের অস্তিত্বও থাকবে না। সভ্যতাও হারিয়ে যাবে। পরিকল্পনা হওয়া উচিত বাস্তুসংস্থান-ভিত্তিক। যেমন, আমরা যদি ২০৫০ সালের মানুষের সংখ্যা হিসাব করতে পারি, তাহলে হাতির সংখ্যা, গাছের সংখ্যা, জীববৈচিত্র্যের অনুপাতও আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায়, প্রকৃতির অন্যান্য জীব ও উদ্ভিদ অদৃশ্য হয়ে যাবে।

আজ ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলো Harmony with Nature for Sustainable Development। এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটি এলাকায় ‘স্পেশাল প্ল্যানিং’ দরকার।

আগে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কেবল Protected Areas এবং কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। এখন বুঝতে পারছি, নগরায়ন, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এই ড্রাইভিং ফোর্সগুলোকে পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত না করলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না। তাই ‘Special Planning for All Areas’ এই ধারণাটি এখন বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা ইতোমধ্যে এই কাঠামো নিয়ে কাজ করেছি, গবেষণা করে একটি পরিকল্পনা সরকারের হাতে তুলে দিয়েছি। আমরা চাই সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে। আজকের এই আয়োজনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা ও সাধারণ মানুষ এ বিষয়গুলো জানুক, সচেতন হোক। আমরা পাবলিক ইন্টারেস্টে পরিকল্পনা করি, এবং ভবিষ্যতেও একসাথে কাজ করতে চাই।

মোস্তাফিজুর রহমান: আপনারও নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে একমত হবেন যে জলাশয়, বন এবং জীববৈচিত্র্য সব কিছুকে নিয়ে আমাদের সামগ্রিকভাবে টিকে থাকতে হবে।তাসফিন আজিজ: নিশ্চয়ই, সম্পূর্ণ একমত। আমি নিজেও এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করি। শুধু ‘মানুষ’ নয়, Non-Human Species নিয়েও পরিকল্পনায় চিন্তা করা উচিত। এটা ছাড়া কোনো বাস্তুতন্ত্রই টেকসই হতে পারে না। আমি শুধু কথাগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন