উন্নয়ন আলোচনা পর্ব-৯

ndicia24

জানু ১২, ২০২৫ | প্রকৃতি ও প্রতিবেশ

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণিঃ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা

এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি লিঃ) মূলত একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। এআইআরডি-এর একটি ওয়েভ পোর্টাল হচ্ছে nDicia (এনডিসিয়া) যার উদ্যোগে উন্নয়ন আলোচনা শীর্ষক এই আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করা হয়েছে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণিঃ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন ড. এস.এম.এ রশীদ, বন্যপ্রাণি গবেষক  এবং ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ০২/০১/২০২৫ তারিখ রাত ৮ টা থেকে ৮:৪৫ মিনিট।

মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশর বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যতা ওয়াইল্ডলাইফ ডাইভার্সিটি এবং ওয়াইল্ডলাইফের রিচনেস নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলুন ।

ড. এস. এম. এ রশীদঃ বন্যপ্রাণী বলতে সেই সমস্ত প্রাণী বোঝায়, যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই সংগ্রহ করে এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল নয়। প্রকৃতিতে বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণী রয়েছে, যেমন স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর এবং মাছ। বর্তমানে বাংলাদেশে মাছকেও বন্যপ্রাণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রজাপতি এবং অসংখ্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীও রয়েছে। আজকের আলোচনায় সেই সমস্ত প্রাণী নিয়ে কথা বলব, যাদের মেরুদণ্ড রয়েছে, অর্থাৎ ভার্টিব্রেট। এর মধ্যে রয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, উভচর প্রাণী। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থান অনেকটাই সৌভাগ্যময়, কারণ এখানে প্রচুর প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, যা অনেক দেশের তুলনায় বেশি। এর কারণ হলো বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ (ট্রপিক্যাল) জলবায়ু এবং বাসস্থানগুলির বৈচিত্র্য। এখানে বন, খালবিলসহ বিভিন্ন বাসস্থান রয়েছে, যা প্রাণীর বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩৩-১৩৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। তবে কিছু প্রাণী, যেমন বারাসিং ও গন্ডার, ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাখির মধ্যে প্রায় ৭০০-এরও বেশি প্রজাতি রয়েছে, এবং পাখি প্রেমীদের অবদানসহ প্রতিনিয়ত নতুন প্রজাতি শনাক্ত হচ্ছে। সরীসৃপদের মধ্যে কাট্টা কচ্ছপ, সাপ, এবং লিজার্ড (টিকটিকি জাতীয়) প্রাণীসহ প্রায় ১৭০-এরও বেশি প্রজাতি রেকর্ড করা হয়েছে। উভচর প্রাণীর মধ্যে বর্তমানে ৬৪ প্রজাতি চিহ্নিত হয়েছে, তবে গবেষণা বাড়লে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার আগ্রহ বাড়ছে। ফলে নতুন তথ্য প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। তবে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে এত প্রাণী থাকা সত্ত্বেও এখানে কোনো এন্ডেমিক (স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ) প্রজাতি নেই। কিছু প্রজাতিকে প্রথমে এন্ডেমিক মনে হলেও পরে জানা গেছে, সেগুলি অন্যান্য দেশেও পাওয়া যায়। সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে জলজ প্রাণী এবং পাখি, বিশেষ করে যেগুলো জলের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া মেছো বিড়ালের মতো কিছু বিড়ালজাতীয় প্রাণীও সংকটাপন্ন। বাংলাদেশের প্রাণীসম্পদের সংরক্ষণ এবং গবেষণার প্রতি আরও মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী  সম্পর্কে একটু ইন্ট্রুডাক্টরী এবং রিচনেস ডাইভার্সিটি, সম্পর্কে কিছু বলুন ।

ড. ফিরোজ জামানঃ এটি একটি চমৎকার সুযোগ, কারণ আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি এবং পড়াই, সেই বিষয়েই আলোচনা করছি। বাংলাদেশ এমন একটি স্থান যেখানে ভৌগোলিক অবস্থান ডেল্টা অঞ্চলে। ডেল্টা অঞ্চল হিসেবে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত উচ্চ এবং সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে আমরা বিভিন্ন সূচক ও ক্ষেত্র গবেষণার মাধ্যমে এটি যাচাই করতে পেরেছি। ‘ওয়াইল্ড লাইফ’-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রধানত মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং মানুষের বাইরে অন্যান্য প্রাইমেট এবং গৃহপালিত পশু ছাড়া সব প্রাণী এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত। যদিও মাছ সাধারণত ওয়াইল্ড লাইফ হিসেবে গণ্য হয় না, অনেকক্ষেত্রে পোকামাকড়কেও ওয়াইল্ড লাইফ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রজাতি বৈচিত্র্য (species diversity) অত্যন্ত সমৃদ্ধ, এবং এটি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় নতুন প্রজাতি আবিষ্কারের খবর পাওয়া যায়। তবে এটি মানে না যে এই প্রজাতিগুলো আগে ছিল না, বরং গবেষণার অভাবের কারণে এগুলো আমাদের নজরে আসেনি। স্পেসিস ডাইভার্সিটি বাড়লেও, জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, যা প্রকৃতপক্ষে উল্টো পথে চলছে। আমাদের প্রজাতিগুলো সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্পেসিসের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটি করতে পারলে আমাদের ইকোসিস্টেম আরো স্বাস্থ্যকর হবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং কৃষিজ উৎপাদনে শুধু সার ও কীটনাশকের ভূমিকা নয়, আমাদের অসংখ্য পরজীবী প্রাণী, বিশেষত পোকামাকড়, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারলে ক্ষতিকারক পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ফলে কৃষিজ উৎপাদনও অনেক বৃদ্ধি পাবে। ইঁদুরের মতো প্রাণীগুলো আমাদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, তারা যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি নষ্ট করে। এই পরিমাণ হাজার হাজার টনে পৌঁছায়, যা একটি বিশাল ক্ষতি। এই বিষয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। আমার মতে, আমাদের জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রজাতি বৈচিত্র্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এটি শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষিত করবে না, বরং কৃষিক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটাবে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ প্রজাতি সংখ্যা কমে যাচ্ছে,  এই হুমকিটা কি বা ওয়াইল্ড লাইফের জন্য থ্রেডস গুলা কি কি ।

ড. ফিরোজ জামানঃ সকলের মনেই প্রশ্ন আসে যে, বাংলাদেশে প্রজাতি সংখ্যা কমছে, কিন্তু আমরা কি যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্যের প্রতি? দেশে বন্যপ্রাণীকে প্রায়োরিটি দেওয়া হয় না বললেই চলে। বিশেষজ্ঞ মহল বা নীতিনির্ধারকদের কাছেও এর গুরুত্ব তেমনভাবে প্রতিফলিত হয় না। বুঝতে হবে যে, জীববৈচিত্র্য না থাকলে মানুষের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। আমরা এটি বুঝাতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে, বর্তমানে দেশে যেসব উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, সেগুলো জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ব্রিজ নির্মাণ, ইকোনমিক জোন স্থাপন, এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো প্রকল্পগুলো প্রাকৃতিক হ্যাবিটেট ধ্বংস করছে। ড. রশিদ উল্লেখ করেছেন যে, দেশে অনেক ইকোসিস্টেম ছিল, কিন্তু সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেখানে একসময় বিভিন্ন প্রজাতির জীব বাস করতো, সেসব জায়গা এখন শূন্য। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আওতায় এসব জায়গা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে, ফলে ইকোসিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হচ্ছে। যারা এইসব বাস্তুতন্ত্রে বাস করতো, তারা হয় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, নয়তো অন্য কোথাও মাইগ্রেট করছে। যারা বন্যপ্রাণী ও ইকোলজি নিয়ে গবেষণা করেন, তারা যতই বেসলাইন সার্ভে করেনা কেন, বাস্তবায়নের সময় এসব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না। এর পেছনে বাজেটও অত্যন্ত কম রাখা হয়। আমার মতে, যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেটের অন্তত ২-৫% পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে এই বরাদ্দ এত কম যে, তা প্রায় উপেক্ষিত অবস্থায় থাকে। আমি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নই। অবশ্যই উন্নয়ন হওয়া উচিত, তবে তা হতে হবে টেকসই পদ্ধতিতে। পরিবেশবিদ ও প্রাণী গবেষকদের অন্তর্ভুক্ত করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করলে তা অনেক বেশি টেকসই হয় এবং ক্ষতির পরিমাণও কমে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো দূষণ। আমরা আমাদের পলুট্যান্টগুলো সরাসরি প্রাকৃতিক হ্যাবিটেটে ফেলে দিচ্ছি। বিশেষ করে জলাভূমি এবং নদীগুলো দূষণের শিকার হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়ছে। নদীতে মাছ কমে গেলে মাছ খেতে আসা মৎসভোজী পাখিরাও বিপদে পড়ে। এছাড়াও, এখনো মানুষ বন্যপ্রাণীর মাংস খাচ্ছে। বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট আছে, কিন্তু তাদের জনবল অত্যন্ত অপ্রতুল। এই ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করতে জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমান সরকার যদি বন্যপ্রাণী রক্ষা এবং এর উপকারিতা বোঝাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়, তাহলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আর কমবে না। সবার সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সদয় পদক্ষেপই এই সমস্যার সমাধান আনতে পারে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ বিভিন্ন এন্ট্রোপজেনিক কারণে আজকে  বন্যপ্রাণী অস্তিত্বের প্রধান হুমকি, ড. রশীদ আপনি কি কিছু যোগ করবেন এর সাথে?

ড. এস. এম. এ রশীদঃ পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় প্রকল্পটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। সেতু নির্মাণের কারণে পরিবেশের উপর যে প্রভাব পড়তে পারে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা যায় এবং কীভাবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সৃষ্টি করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পদ্মা সেতুর টোল থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ব্যয় করার পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত বন বিভাগ এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখায়নি বা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। যদি এই পরিকল্পনাটি সক্রিয়ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আশা করা যায় সেতু বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একত্রে কাজ করে পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারবে। এ অঞ্চলে ডলফিন, শিয়াল, এবং বিলুপ্তপ্রায় কিছু প্রাণী যেমন মেছো বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীকুলের সংরক্ষণ কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব। বিশেষ করে যেহেতু অভয়ারণ্যটি ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর সীমানা নির্ধারণ করা আছে, সেক্ষেত্রে এসব উদ্যোগ যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের ঘড়িয়াল সম্পর্কে জানতে চাই।

ড. এস. এম. এ রশীদঃ ঘড়িয়াল একসময়, বিশেষ করে পদ্মা ও যমুনা নদীতে বসবাস করত। রাজশাহীর কিছু অঞ্চলে তাদের ডিম পাড়ার এবং বাচ্চা ফোটানোর ঘটনাও দেখা গেছে। আমার কাজের অংশ হিসেবে এ নিয়ে বিশেষ গবেষণা করেছিলাম। পুরনো কিছু তথ্য থেকে জেনেছি যে পাবনার বেড়া অঞ্চলের যমুনার চরে এখনো কুমির দেখা যায়। বয়স্ক কিছু ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নাকি ঘড়িয়ালের ডিম দিয়ে ফুটবল খেলেছেন! বর্তমানে পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে ঘড়িয়ালের উপস্থিতি কমে গেছে। তবে বন্যার পরে মাঝেমধ্যে কিছু বাচ্চা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়াল পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এগুলো হয়তো বন্যার সময়ে ভারত থেকে ভেসে আসে। ২০১২ সালে মহানন্দা নদীতে প্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়াল পাওয়া গিয়েছিল, এমনকি গত বছরও কয়েকটি ঘড়িয়াল ধরা পড়েছে। এ বিষয়ে একটি গবেষণা অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে। ভারতের ঘড়িয়াল ও আমাদের দেশে পাওয়া ঘড়িয়ালের ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বোঝা যাবে, এগুলো একই পপুলেশনের প্রাণী নাকি ভিন্ন পপুলেশনের। যদি ভিন্ন হয়, তবে এটি বাংলাদেশের নিজস্ব পপুলেশনের অংশ হতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু মেগাস্পিসিস (বড় প্রজাতি) যেমন বাঘ, হাতি ইত্যাদির অবস্থাও সংকটপূর্ণ। তাদের জন্য হ্যাবিটেটের ঘাটতি বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি নববর্ষের অনুষ্ঠানে শর্ষে তেল ব্যবহারের কারণে অনেক পাখি মারা গেছে, যা মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হলেও বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশে বিদ্যমান আইন রয়েছে, তবে সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ ও এনফোর্সমেন্ট নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

মাসুদ সিদ্দিকঃ সুন্দরবন ওয়েটল্যান্ড ফরেস্ট এই সুন্দরবনের যে বিভিন্ন নদী বা খালে বা ক্যানাল গুলোতে যে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হয় এটার প্রভাবটা কি?

ড.ফিরোজ জামানঃ সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যার সুরক্ষা ও সংরক্ষণে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সম্প্রতি একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, সুন্দরবনের ছোট ছোট নদী ও খালগুলোতে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে। এই ঘটনা শুধু আশ্চর্যের নয়, এটি অত্যন্ত দুঃখজনকও। এটি প্রমাণ করে যে, বিষ প্রয়োগে মাছ ধরার এই বিধ্বংসী পদ্ধতি অনেকেই জানে এবং এটি বেশ প্রচলিত। এই কার্যক্রমের ক্ষতিকর প্রভাব বিশাল। বিষ প্রয়োগে শুধু মাছ নয়, সুন্দরবনের জলের অন্যান্য প্রাণীও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ফুড চেইনের বিভিন্ন স্তরের প্রাণী প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি স্তরের সকল অর্গানিজম বিষের কারণে মারা যাচ্ছে। বিষ প্রয়োগের ফলে মাছভিত্তিক খাদ্য চেইনে থাকা প্রাণীরা যেমন উদবিড়াল, বক, মেছো বাঘ বিপন্ন হচ্ছে। বিশেষত বক বিষযুক্ত মাছ খেয়ে মারা যাচ্ছে। ব্রুট ফিশ থেকে শুরু করে বাচ্চা মাছ পর্যন্ত, সকল স্তরের মাছ এই প্রক্রিয়ায় ধ্বংস হচ্ছে। একসময় দেখা যাবে পানি আছে, হ্যাবিটেট আছে, কিন্তু প্রাণবৈচিত্র্য একেবারেই নেই। এই বিপর্যয় রোধে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। সকল জেলেদের নিয়ে মিটিং আয়োজন করা উচিত। বিষ প্রয়োগের ক্ষতিকর দিকগুলি সহজ ভাষায় তাদের বোঝানো প্রয়োজন। মৎস্যজীবীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের জীবিকা পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করতে হবে। সরকারের উচিত সুন্দরবনের এইসব এলাকায় কড়া নজরদারি ও আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। সুন্দরবনের সুরক্ষা শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নৈতিক অঙ্গীকার। এজন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

মাসুদ সিদ্দিকঃ হ্যাবিটেট গুলোকে যদি স্পার্শিয়াল ডিস্টিবিউশন করা হয়, তাহলে হাওরের ক্ষেত্রে কি বলবেন, হাওড়ের ওয়েটল্যান্ড ইকোসিস্টেম অথবা ওয়াইল্ডলাইফ হুমকির মুখে কেনো?  

ড.ফিরোজ জামানঃ ওয়েটল্যান্ড বা জলাভূমি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম। বাংলাদেশে ওয়েটল্যান্ড ইকোসিস্টেম অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং এর বিস্তৃতি ব্যাপক। এই ওয়েটল্যান্ডগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির জলজ পাখি, কচ্ছপ, সাপ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। একসময় আমরা প্রচুর পরিমাণে কচ্ছপ পেতাম, কিন্তু এখন সেগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিশেষ করে, হাওর অঞ্চলে প্রচুর মাইগ্রেটরি বা অভিবাসী পাখি আসে। মাইগ্রেটরি পাখি বলতে মানুষ মূলত ডাক বা হাঁস বোঝে। তবে, এই পাখিগুলোর মধ্যে অনেক ধরনের প্রজাতি রয়েছে, যেমন টেরিস্ট্রিয়াল পাখি এবং জলজ পাখি। এসব পাখির মধ্যে ওয়াটার বার্ডস বা সোর বার্ডস উল্লেখযোগ্য, যারা সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় বিচরণ করে। এদের পা লম্বা হয় এবং এদের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, আমরা এই জায়গাগুলো নিরাপদ রাখতে পারছি না। ইদানীং হাওর অঞ্চলে ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তোলা হয়েছে। ইকো-ট্যুরিজম মানে হলো পর্যটকদের ভিড় বাড়ানো, টাকা আয় করা। কিন্তু এখানে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যদি আমরা এই ইকো-ট্যুরিজমকে সীমিত করে ক্যারিং ক্যাপাসিটির মধ্যে রাখতে পারতাম, তাহলে জায়গাগুলোতে ডিস্টার্ব কম হতো। ডিস্টার্ব কম হলে মাইগ্রেটরি পাখিগুলো স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারত। এগুলো ওয়াইল্ড এলিমেন্টস, যেগুলো অত্যন্ত সেনসিটিভ। আমি বিদেশে দেখেছি, পাখিগুলো ডোমেস্টিক হাঁসের মতো মানুষের খুব কাছাকাছি থাকে। কারণ, সেখানে পাখি ধরা, বিরক্ত করা বা ঢিল মারা নিষেধ। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা ফায়ারিং করি, যার ফলে পাখিরা মানুষকে শত্রু মনে করে। বিদেশে পাখিরা মানুষকে শত্রু মনে করে না। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের ট্যুরিজমকে ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারকে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যাতে হাওরের বন্যপ্রাণী এবং ইকোসিস্টেম রক্ষা পায়। এছাড়া, হাওরে পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মাছ ও পাখি ধ্বংস করা হয়। ধান বা ভাত দিয়ে সন্ধ্যায় পয়জনিং করে সকালে বস্তা নিয়ে গিয়ে মাইগ্রেটরি পাখি ধরে আনা হয়। আমি নিজে এমন অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি এবং অন্যদের কাছ থেকেও শুনেছি। এজন্য ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যারা এই পেশায় জড়িত, তাদের বিকল্প পেশায় রূপান্তরিত করতে হবে। পাশাপাশি, পাখি বিক্রির জায়গাগুলো এবং আশেপাশের গ্রামগুলোকে সচেতন করে তুলতে হবে। এই পাখিগুলো খেলে রোগব্যাধি হতে পারে, কারণ এরা আমাদের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম উপাদান এবং রিনিউয়েবল রিসোর্স। যেমন, সিলেট রোডে ভোরবেলা আমি প্রায়ই দেখি, বিভিন্ন ধরনের বক ও হাঁস ঝুলিয়ে বিক্রি করা হয়। এটি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি।

মাসুদ সিদ্দিকঃ ইনডেঞ্জারড স্পিসিজ বা এক্সটিঙ্কশন নিয়ে কিছু বলুন।

ড. এস. এম. এ রশীদঃ অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। তবে যেসব প্রজাতি এখনো টিকে আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই সরকার ও বন বিভাগ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রজননের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা একটি প্রকল্পে কাজ করেছিলাম, যেখানে বাটাগুর বাস্কা নামক একটি কচ্ছপ প্রজাতি নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম বিপন্ন প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি। প্রথমে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে এ প্রজাতির প্রজনন প্রকল্প শুরু হয়। এরপর কচ্ছপের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমানে সুন্দরবনে এ নিয়ে আরও গবেষণা করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ নিলে কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। তবে এ ধরনের কাজ করার সময় বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। যেমন, বনে পুনঃপ্রজনন করানোর পর সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার আগে নিশ্চিত করতে হয় যে তারা বনের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে কি না। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কথাও বলা যায়। ১৯৯০-এর দিকে আমরা সেখানেও কাজ শুরু করি। প্রতি বছর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হচ্ছে, তবে কয়টি টিকে থাকে তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করা জরুরি। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণা করলে এটি আরও ফলপ্রসূ হতে পারে। আমাদের এক সহকর্মী চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাকস থেকে কিছু বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপ সংগ্রহ করেছিলেন। স্থানীয় জনগণ এবং বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সেগুলো ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে লালন-পালন করা হয়েছে। তিনটি প্রজাতি সফলভাবে বিপন্ন তালিকা থেকে বের হয়ে এসেছে। এদের উপর ট্রান্সমিটার স্থাপন করে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং তাদের গতিপথ রেকর্ড করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অজগর সাপ নিয়ে একটি সমস্যা ছিল। এগুলো মাঝে মাঝে বাড়িতে ঢুকে হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলত। বন বিভাগের সহযোগিতায় এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে এবং অজগরগুলোর উপর ট্রান্সমিটার বসিয়ে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এভাবে সাপগুলোকে পুনরায় জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশে নতুন করে বিভিন্ন চর জেগে উঠছে, আর বনায়ন করা হচ্ছে। এগুলো কীভাবে সুফল বয়ে আনছে?

ড.ফিরোজ জামানঃ বাংলাদেশে নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। পলিমাটি নদীর মাধ্যমে জমা হওয়ার কারণে এই চরগুলো গঠিত হচ্ছে। এই চরগুলো পাখিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রতীরবর্তী পাখিরা, যেমন হাঁস ও অন্যান্য জলচর পাখি, এখানে আসে। এ কারণে এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। তবে বনায়নের ক্ষেত্রে ইকোলজিক্যাল সাকসেশন নামে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া রয়েছে। সাকসেশন অনুযায়ী, মাটি প্রস্তুত হয়, ধীরে ধীরে ঘাস, ঝোপ, হার্ব, শার্ব ও গাছ তৈরি হয়। যদি এসব জায়গা ৫-১০ বছর ফেলে রাখা হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই এগুলো সুন্দরবনের মতো বন হয়ে উঠবে। যদি দ্রুত ফল পেতে বন বিভাগ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করে, তবে এটি সঠিক নাও হতে পারে। গাছগুলো পরিবেশবান্ধব কিনা, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক পোকা-মাকড় ও পাখির ইকোসিস্টেমও ঠিক রাখতে হবে। বোটানিস্ট ও ফরেস্ট বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কাজ করা হলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।

মাসুদ সিদ্দিকঃ ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ এবং বিশ্বের জীববৈচিত্র্যে কীভাবে প্রভাব ফেলছে বা বিপন্ন করছে?

ড. এস. এম. এ রশীদঃ ক্লাইমেট চেঞ্জ থেকে অবশ্যই প্রভাব পড়ছে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি মানুষই করছে। এক কথায়, ক্লাইমেট চেঞ্জের ইমপ্যাক্ট যতটা, মানুষের কর্মকাণ্ড তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে। উদাহরণস্বরূপ, মৌসুমি পাখি এবং আবাসিক পাখিদের প্রজনন চক্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণত, এ পাখিগুলো নির্দিষ্ট সময়ে ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই চক্র ২১-২৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন না হয়ে বিলম্বিত হচ্ছে। এ সময় বাচ্চারা খাবার পেতে সমস্যায় পড়ে, কারণ তাদের স্বাভাবিক খাদ্য উৎস প্রাপ্যতার সাথে আর মিলছে না। আরেকটি উদাহরণ হলো গাছপালার ফুল ফোটার সময়কাল। আগে যেসব উদ্ভিদ নির্দিষ্ট সময়ে ফুল দিত, এখন তাদের সেই সময় পেছাচ্ছে। এর পেছনে কারণ হতে পারে তাপমাত্রার পরিবর্তন, সঠিক আলোর অভাব বা অন্য পরিবেশগত কারণ। এছাড়া, বর্ষার আগেই নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখিরা ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটায়। কিন্তু এখন বাচ্চারা বর্ষার পানিতে অভ্যস্ত হওয়ার আগেই তাদের সময়সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে। গাছপালা কাটা, বন উজাড় করা এবং জীববৈচিত্র্যের বাসস্থান ধ্বংস করার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতিকে বিপন্ন করে তুলছে। তাই বলা যায়, ক্লাইমেট চেঞ্জ কিছুটা প্রভাব ফেলছে ঠিকই, তবে মানুষের কর্মকাণ্ডই সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ।

মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী কার্যকরভাবে সংরক্ষণের জন্য এক-দুইটি সুপারিশ জানার ইচ্ছা আছে। আপনারা কী পরামর্শ দিতে চান?

ড. এস. এম. এ রশীদঃ আমার মতে, একটি আলাদা বিভাগ করা উচিত। অর্থাৎ, একটি ওয়াইল্ডলাইফ ডিপার্টমেন্ট গঠন করা প্রয়োজন। ১৯৮৬ সালে এই বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি আলাদা বিভাগ থাকা উচিত। কিন্তু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে তখনই বিরোধিতা করা হয়েছিল এবং এখনো করা হচ্ছে। বর্তমান উদ্যোগগুলোর মধ্যে থেকেও বোঝা যায় যে, সমস্যা ঘরের ভেতরেই রয়ে গেছে। তাই আমি বলব, একটি স্বাধীন এবং কার্যকর ওয়াইল্ডলাইফ ডিপার্টমেন্ট গঠন করা অত্যন্ত জরুরি।

ড.ফিরোজ জামানঃ একটি আলাদা ডিপার্টমেন্ট করলে কাজ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতো। তবে অনেকের দ্বিমত রয়েছে যে, আলাদা বিভাগ করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। আমি বলব, যদি ওয়াইল্ডলাইফ ডিপার্টমেন্ট তৈরি করা হয়, তাহলে অবশ্যই সেটির জন্য পৃথক বাজেট থাকতে হবে। সরকারের উচিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য আলাদা ফান্ড এবং কনজারভেশনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করা। এছাড়া, সরকারের বন অধিদপ্তরের প্রধানদের উচিত সরকারের কাছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করা। বন্যপ্রাণীকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে হবে যে, বন্যপ্রাণীর মাংস খাওয়া যাবে না, তাদের ধ্বংস করা যাবে না, এবং পাচারও করা যাবে না। যদি পাচারের মতো কোনো ঘটনা ঘটে, তাৎক্ষণিকভাবে তা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব।

মাসুদ সিদ্দিকঃ nDicia-এর উদ্যোগ সম্পর্কে আপনাদের মতামত বলুন।

ড. এস. এম. এ রশীদঃ অবশ্যই ভালো। অনেকেই শুনছে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে জানতে। শুধু বন্যপ্রাণী না, আপনারা তো অন্য বিষয় নিয়েও করেন, আমরা শুনি, এবং আমাদেরও কাজে লাগে। এটি লোকজনের জন্য ভালো, কারণ তারা জানবে, এবং এগুলোর মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। তাই, অবশ্যই এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

ড.ফিরোজ জামানঃ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। যারা জানবে, বুঝবে, শুনবে, তারা নিজেকে যেমন অনেক কিছুই বুঝতে পারবে, তেমনি তাদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। বিশেষ করে যারা অন্য ক্ষেত্রের, তারা অনেক কিছু জানতে পারবে আপনাদের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই টকশোর মাধ্যমে সরকারের একটি মেসেজও পৌঁছাবে। মেসেজগুলো যদি পৌঁছায়, তাহলে বন্যপ্রাণীরাও অনেক উপকৃত হবে। মানুষ জ্ঞান অর্জন করবে, আর বন্যপ্রাণীরা তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে আরো সচেতন হবে। এ ধরণের প্রোগ্রাম যদি নিয়মিত করা যায়, তাহলে আরো ভালো হবে। মানুষ সংরক্ষণ সম্পর্কে বুঝতে পারবে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনাদের দুজনকে এবং সম্মানিত দর্শকশ্রোতাদেরকেও ধন্যবাদ।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন