বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: সংকট ও উত্তরণ
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি লিঃ) মূলত একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। এআইআরডি-এর একটি ওয়েভ পোর্টাল হচ্ছে এনডিসিয়া (nDicia) যার উদ্যোগে উন্নয়ন আলোচনা শীর্ষক এই আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করা হয়েছে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: সংকট ও উত্তরণ। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, এবং জনাব মো. আল-মামুন জমাদ্দার, নির্বাহী পরিচালক বিডি রিসাইকেল টেকনোলজিস লিঃ ঢাকা। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্টানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ১২/১২/২০২৪ তারিখ রাত ৮ টা থেকে ৮:৪৫ মিনিট।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিন।
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি পরিপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন ধাপের সমন্বয়ে সম্পন্ন হয়। এটি মূলত বর্জ্য উৎপাদনের স্থান থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত একাধিক ধাপ নিয়ে গঠিত। এই ধাপগুলো হলো: বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহণ, পরিশোধন ও পুনঃব্যবহার (প্রয়োজনে) এবং উপযুক্ত স্থানে নিষ্পত্তি এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে একত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলা হয়। প্রত্যেকটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। এর যে কোনো একটি ধাপ যদি বাদ পড়ে, তাহলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হবে। উদাহরণস্বরূপ, বর্জ্য যদি শুধু এক স্থান থেকে সরিয়ে অন্যত্র ফেলে দেওয়া হয়, সেটাকে যথাযথ ব্যবস্থাপনা বলা যাবে না, বরং পরিবেশসম্মত ও পরিকল্পিত উপাযয়ে বর্জ্য নিষ্পত্তি করতে হবে। বর্জ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পুনঃব্যবহার করা হলে বর্জ্য থেকে সম্পদ উৎপাদন সম্ভব। অন্যথায়, এটি পরিবেশগত বিপর্যয়, স্বাস্থ্য সমস্যা, দুর্গন্ধ এবং দূষণের কারণ হযয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পুরো প্রক্রিয়াকে একটি চক্র বা “সাইকেল” হিসেবে ভাবা যায়। এটি একটি পরিপূর্ণ সাইকেল তখনই হবে, যখন উৎপাদনের স্থান থেকে শুরু করে পরিবহন, পরিশোধন এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ গ্রামীন ও নগর বর্জ্যের প্রকৃতি ও প্রকারের মধ্যে যে পার্থক্যটা আছে এবিষয়ে কিছু বলুন।
আল-মামুনঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় বর্জ্যকে সঠিকভাবে সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করা। মানুষ সাধারণত বর্জ্যকে অপ্রয়োজনীয় ও মূল্যহীন বলে মনে করে, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব।
গ্রামীণ বর্জ্যের বেশিরভাগই অর্গানিক। এখানে সাধারণত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা মেডিকেল বর্জ্যের উপস্থিতি নেই। অন্যদিকে, নগর বর্জ্য বিভিন্ন ধরণের হয় যেমন, সলিড ওয়েস্ট, মেডিকেল ওয়েস্ট, এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল হ্যাজার্ডাস বর্জ্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রধানত দুই প্রকার: অর্গানিক বর্জ্য (যা সহজে পচনশীল), সলিড ওয়েস্ট (যেমন প্লাস্টিক, ধাতু, কাঁচ ইত্যাদি) বিডি রিসাইকেল টেকনোলজিস লিঃ সাধারণত সলিড ওয়েস্ট নিয়ে কাজ করে থাকে, বিশেষত প্লাস্টিকের মতো বর্জ্য নিয়ে। তবে মেডিকেল বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল হ্যাজার্ডাস বর্জ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা কার্যপরিধির বাইরে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট বর্জ্যের প্রায় ৭০% অর্গানিক, তবে বাস্তবে এটি ৮০-৮৫% পর্যন্ত হতে পারে। গ্রামীণ এলাকায় অর্গানিক বর্জ্যের পরিমাণ বেশি, আর শহরাঞ্চলে বর্জ্যের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি এবং ধরণে বৈচিত্র্যময়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা টেকসই করতে হলে সঠিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা প্রয়েজন। অপ্রয়োজনীয় বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার মধ্যেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সার্থকতা নিহিত।
মাসুদ সিদ্দিকঃ কৃষি জহিতে কিটনাশক দেওয়ার ফলে এগুলো গ্রামীন পর্যায়ে সারফেস হয়ে নদী-নালা খাল-বিলে পড়ছে, এখন এর ইমপেক্ট কি?
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমে এর উৎপাদনের স্থান অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করা প্রয়োজন। উৎপাদনের স্থান অনুযায়ী বর্জ্যকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: শহরের বর্জ্য ও গ্রামীণ বর্জ্য। উৎপন্ন বর্জ্যকে এর ধরন অনুযায়ী ভাগ করা যায়। বর্জ্য সাধারণত তিন ধরনের হতে পারে: যেমন, তরল বর্জ্য (Liquid Waste), গ্যাসীয় বর্জ্য (Emission-based Waste), কঠিন বর্জ্য (Solid Waste)। তরল বর্জ্যের উৎস মূলত কৃষি কাজ ও শিল্প কারখানা। ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ কৃষি কাজে ব্যবহৃত পানির সাথে মিশে যায় এবং তা পরিশোধন করার কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া বাংলাদেশে নেই। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোতে এই তরল বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিকের প্রভাব সরাসরি পরিবেশে পড়ে এবং পানির সাথে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশে যায়। খাদ্য নিরাপত্তা ও চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শিল্পকারখানা এবং কৃষি কাজে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে এটি ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এতে করে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্যান্য প্রধান শহরের বর্জ্য উৎপাদনের কোনো পরিসংখ্যান আছে কি?
আল-মামুনঃ সত্যিকার অর্থে সেই ধরনের কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণা, যেমন সিটি কর্পোরেশন বা বিভিন্ন সংস্থা (যেমন ওয়েস্ট কনসার্ন) জরিপের মাধ্যমে কিছু তথ্য প্রকাশ করে থাকে। ঢাকা নগরে দুই সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০০০ থেকে ৮০০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এটি সম্ভবত ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি তথ্যে জানা গিয়েছিল। অন্যান্য শহরেও এমন কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন প্রায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, খুলনায় প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন, রাজশাহীতে এই পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মেট্রিক টন এবং সিলেটেও প্রায় একই ধরণের তথ্য পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, তাদের বর্জ্য সংগ্রহ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা ঢাকার তুলনায় কিছুটা উন্নত। পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে রাজশাহী এগিয়ে রয়েছে। তাছাড়া বর্জ্যের ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়: মোট বর্জ্যের ৬৫-৭০% হলো অর্গানিক ওয়েস্ট, বাকি ৩০-৩৫% হলো সলিড ওয়েস্ট (যেমন প্লাস্টিক, পেপার, আসবাব ইত্যাদি)। এর মধ্যে প্রায় ১০% বর্জ্যকে ইউএস (ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট) হিসেবে ধরা হয়। আর গ্রামাঞ্চলেও বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এই পরিসংখ্যানের বিষয়ে জনাব মোস্তাফিজের কাছে জানতে চাচ্ছি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ মনে হচ্ছে পরিসংখ্যান বা হিসাবটা সঠিকভাবে নেওয়া হচ্ছে না। আসলে এটি খুব প্রোপারলি মেন্টেন করা হিসাব নয়। যদি বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়, এখানে একটি বিশাল সম্ভাবনা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সাহিত্য ও গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬,০০০ থেকে ৭,০০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এই অনুমানটা মূলত ২০০২-২০০৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে এবং এখনও তা চালু রয়েছে। কিন্তু বর্তমান জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে এই হিসাব আর সঠিক থাকার কথা নয়। হিসাবের প্রক্রিয়াটি আরও আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। এটি যদি আপডেট করা হয়, তাহলে হয়তো একটা সঠিক ও বাস্তবসম্মত চিত্র দেখতে পাওয়া যাবে। তবে ২০,০০০ বা ২৫,০০০ মেট্রিক টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি অনুমান অনুযায়ী এটি ৩০,০০০ মেট্রিক টনের কাছাকাছিও হতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মিউনিসিপল কর্পোরেশন বিশেষ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তারা কতটুকু ক্যাপাবল এই ৬০০০ মেট্রিকটন বর্জ্যকে ম্যানেজম্যান্টের আওতায় নিয়ে আসার? প্রোপারলি কি তারা পারছে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি ডেফিনেশন রয়েছে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে যদি বলা হয়, তাহলে এই ডেফিনেশনের বাইরে অন্য কোনো সংজ্ঞা হওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে যা করা হচ্ছে বা যা ঘটছে, তাকে কি ব্যবস্থাপনা বলা যায়? যদি বর্জ্য সংগ্রহ করে একটি জায়গায় ফেলে দেওয় হয়, অথচ সেই জায়গাটি সঠিকভাবে পরিকল্পিত নয়, এটি কোনো সিলেটিজ সিস্টেমের অংশ না হয়, তাহলে সেটিকে কি সঠিক ব্যবস্থাপনা বলা যায়? এই প্রক্রিয়াটিতে অনেক উন্নতির সুযোগ রয়েছে এবং পরিবর্তনেরও যথেষ্ট সুযোগ আছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বর্জ্যের সঠিকভাবে সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং নিষ্পত্তিকে বোঝায়। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই এ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিকল্পিত নয়। এখানে শুধু সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করলে চলবে না। জনগণ, রাষ্ট্র, এবং প্রতিষ্ঠান সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে বর্জ্য উৎপাদকদের মধ্যেও। প্রতিদিনের বর্জ্য সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প কারখানার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের বর্জ্যের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। সমস্যার সমাধানে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। একটি ডাউন অ্যাপ্রোচ প্রয়োজন, যা দ্রুত ও কার্যকর সমাধানে কাজ করবে। তবে সিটি কর্পোরেশনকে অবশ্যই আরও বেশি জনসম্পৃক্ত হতে হবে। জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে, সিটি কর্পোরেশন এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এককভাবে সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা হচ্ছেনা, তবে প্রো-এক্টিভলি এগিয়ে আসা এবং নগরবাসীকে সচেতন করা এগুলোর জন্য তো সিটি কর্পোরেশনকেই এগিয়ে আসতে হবে।
আল-মামুন সিটি কর্পোরেশন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে অনেক পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে পড়ে, যেমন পলিথিন নিষিদ্ধকরণ। পলিথিন বা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০২ সালে। যদিও এটি কিছু সময়ের জন্য বাস্তবায়িত হয়েছিল, পরে এর প্রয়োগ শিথিল হয়ে যায়। আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে, যেমন বর্জ্য সংগ্রহ এবং ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা। তবে, এই ডাম্পিং স্টেশনগুলো এখনও যথেষ্ট নয়। কনজিউমার পর্যায়ে, বিশেষত প্লাস্টিক সংগ্রহ এবং রিসাইক্লিংয়ে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সলিড ওয়েস্টেও বিভিন্ন প্রকারের বর্জ্য রয়েছে, যেমন পিইটি বোতল, যা প্রায় ৪০% ভাগ হয়ে থাকে। অন্যান্য মাল্টি-লেয়ার প্লাস্টিকগুলো সংগ্রহে জটিলতা রয়েছে। ঢাকা সিটিতে সঠিক উৎস থেকে বর্জ্য পৃথকীকরণের হার প্রায় ৩৬ থেকে ৪০%। রিসাইক্লিং যোগ্য প্লাস্টিকের একটি বড় অংশ পুনর্ব্যবহার হলেও ওয়ান-টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিবেশের ক্ষতি করছে। বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। সমন্বিত উদ্যোগে বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পুনর্ব্যবহার কার্যক্রম আরও কার্যকর হতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ময়লা পরিষ্কার বা ডাস্টবিনে ফেলা, যেমন উন্নত বিশ্বের বাচ্চারা এদিক দিয়ে বাংলাদেশের বাচ্চাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এখন আপনারা কি মনে করছেন স্কুলের পাঠ্যপুস্তক বা কারিকুলামে মোর ইফেক্টেড করা কি দরকার পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ সমস্যার সমাধানে প্র্যাকটিস গুরুত্বপূর্ণ। মামুন ভাই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যা বলেছেন, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে ভাগাড় থেকে পেট বোতল বা ময়লা সংগ্রহ করতে হচ্ছে, যা শ্রমসাধ্য। যদি এসব উপকরণ আলাদা করে একটি সিস্টেমে আনা যায়, কাজ সহজ হবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে প্লাস্টিক মুক্ত পরিবেশ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চর্চা শুরু করতে হবে। স্কুলে এ অভ্যাস গড়ে তুললে, তা পরিবার ও সমাজেও ছড়াবে। স্কুল পর্যায় থেকে এই চর্চাগুলো শুরু হলে, বাসা-বাড়িতেও প্র্যাকটিস হবে। এই চেইনটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে যাবে। নেক্সট জেনারেশন কিন্তু একটা ইথিকাল কনসেপ্ট নিয়ে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হবে এবং সে সেভাবেই বেড়ে উঠবে। গ্রাম পর্যায়েও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগকে কার্যকরভাবে পরিচালনা ও প্রচার করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। ওয়েস্ট ওয়ার্কারদের জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, সামাজিক চর্চা এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
মাসুদ সিদ্দিকঃ লরেন্স ফোর্সম্যান একটা বড় জিনিস বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে, কিন্তু যখন ইকোসিস্টেম নিয়ে কাজ করা হয় তখন একটা বিষয়ের সাথে একটা এপ্রোচে যাওয়া হয় (পিইএস) পেমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম সার্ভিস। এ ধরণের এপ্রোচ কি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নেওয়া যেতে পারে?
আল-মামুনঃ অবশ্যই নেওয়া যায়। গভর্নমেন্টের একটি বিশেষ ইনসেন্টিভ রয়েছে, বিশেষ করে এক্সপোর্ট ক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শিক্ষা ও কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করা গেলে বড় পরিবর্তন সম্ভব। স্কুল পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করে এক্সট্রা কারিকুলামের অংশ হিসেবে কম্পোস্ট তৈরি, সোর্স সেপারেশন এবং প্লাস্টিক সংগ্রহ শেখানো যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠবে। ন্যাশনাল মার্কিং সিস্টেমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ক্রাইটেরিয়া হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচেষ্ট হবে। শিক্ষার্থীদের কাজের জন্য এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে পয়েন্ট দেওয়া যেতে পারে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য স্থানীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করলে, লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। এই উদ্যোগ কমিউনিটি বিল্ডিংয়ে সহায়ক হবে এবং শিক্ষার্থীরা পরিবেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। মূল সমস্যা হলো লজিস্টিক কস্ট। যেমন, কারো কাছে ২ কেজি প্লাস্টিক থাকলে সেটি বিনামূল্যে নিতে কেউ আসবে না, কারণ ট্রান্সপোর্টেশন খরচ অনেক বেশি। সেজন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে এই কাজটি করলে তা কমিউনিটি বিল্ডিং-এর কাজ করবে। এই কমিউনিটি থেকেই বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে। সুতরাং, প্লাস্টিক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অনেক বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
মাসুদ সিদ্দিকঃ কি কি ধরণের স্বাস্থ্যঝুকি দেখা যায়?
আল-মামুনঃ পানিবাহিত রোগগুলো এবং বায়ুবাহিত রোগগুলো বা অন্যান্য রোগগুলো আসলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছড়ায়। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে যে, গ্রামীণ মানুষের ২০% এর বেশি বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করার কারণে স্বাস্থ্য বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল ওয়েস্টও রয়েছে। বড় বড় হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট মনোনীত কোম্পানিগুলো সেগুলো সংগ্রহ করে এবং সঠিকভাবে ডিসপোজ করছে। কিন্তু বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ছোটখাটো ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপন্ন বর্জ্য যেমন কাটা-ছেঁড়া সরঞ্জাম বা অন্যান্য মেডিকেল বর্জ্য অনেক সময় সাধারণ ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই প্রয়োজন একটি সঠিক এবং টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এসব স্বাস্থ্যঝুকি কমাতে কি করা যায়।
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ একটা ক্যাচ এক্সাম্পল দেখেন, ডেঙ্গু ম্যানেজ করা যাচ্ছেনা কেন? সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এটার স্ট্রাটেজিতে প্রথমেই মনে করা হয়েছিলো যে ডেঙ্গুর আর্টিকুলার সিজন আছে, এবং ডেঙ্গু আসবেই। ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেশের বর্তমান স্ট্রাটেজি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি সিজনাল রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাস্তবে পরিবেশগত অব্যবস্থাপনা, অপরিচ্ছন্নতা, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে ডেঙ্গুর বিস্তার ক্রমাগত বাড়ছে। সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় নগরবাসী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। বিশেষত, প্রতিদিনের ৩০০ টন মেডিকেল বর্জ্যের মধ্যে মাত্র ২০-২৫ টনের সঠিক ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে। বাকিটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, যা ডেঙ্গুর জন্য আবাসস্থল তৈরি করছে। সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। শর্ট টার্মে দ্রুত ফলাফল পেতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি এপ্রোচের ওপর জোর দিতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, দায়বদ্ধতা, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন পলিথিন নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর নয়, জনসচেতনতা এবং বিকল্প ব্যবস্থা জরুরি। তাই, প্রোডাকশন কমাতে মানুষের চাহিদা কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেমন, ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে পলিথিন উৎপাদন সেই সময়ের তুলনায় আরও বেশি। বর্তমানে, পার ক্যাপিটা প্লাস্টিক কনজাম্পশন ১৭ কেজি বার্ষিক। কিন্তু প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারারদের প্রজেকশন অনুযায়ী, ২০৩০-২০৪০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। যদি মানুষের ডিমান্ড না থাকে, তাহলে প্রোডাকশনও হবে না। এজন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, ইনক্লুসিভনেস এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সফল হওয়া সম্ভব।
মাসুদ সিদ্দিকঃ থ্রি R যেমন রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
আল-মামুনঃ রিডিউস এটা একটা নীতিমালা। রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখানে আরও একটি R যোগ করা যেতে পারে যেমন, রেগুলেশন। এটা প্রপারলি রেগুলেট করা। রিচার্স একটা ইস্যু হতে পারে যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইনোভেটিভ কোনো প্রোডাক্ট। প্রপার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রিচার্সযোগ্য প্রোডাক্ট ও ইনোভেটিভ আইডিয়া দেশে অন্তর্ভুক্ত করে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে। সিস্টেমেটিক সমাধানের মাধ্যমে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টকে কার্যকরী করতে হবে, যেখানে ফ্রেমওয়ার্কের অংশ হিসেবে উন্নত প্রযুক্তি এবং রেগুলেটরি মডেল যুক্ত থাকবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমানঃ রিসার্চ তো হচ্ছে স্টুডেন্টরা করছে, শিক্ষকরা করছে, এই যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবলেমটা বলা হয়েছে এই গবেষণাটা তো বাংলাদেশের গবেষকরা করেছে। আমি সহ আমার কলিগদের দ্বারা গবেষণা করা হচ্ছে যা google এ সার্চ করলেও পাওয়া যাবে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। গবেষণাগুলো যদিও চলছে, তবে প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিবেশবান্ধব চিন্তা-চেতনা ও অভ্যাস গড়ে তোলা। রিসাইকেল, রিইউজ বা রিফিউজ যা-ই বলা হয়না কেন, মূল চ্যালেঞ্জ হলো সচেতনতা তৈরি করা এবং তা কার্যকর করা। পরবর্তী প্রজন্ম যেন পরিবেশ সম্পর্কে দায়িত্বশীল হয়, সেটা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বাজারে নিজস্ব ব্যাগ ব্যবহার, প্লাস্টিক বর্জন, এবং পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গড়ে তোলার মতো ছোট ছোট উদ্যোগই বড় পরিবর্তন আনতে পারে। শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, কার্যকর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমার সকল ভাবনা পরবর্তী জেনারেশন নিয়ে, তাদের চিন্তা চেতনার নীতি-নৈতিকতা যেন পরিবেশবান্ধব, প্রতিবেশ বান্ধব হয় সেটাই এখন কাম্য। সকলের কাজ হওয়া উচিত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ তৈরি করা।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনাদের দুজনকে এবং সম্মানিত দর্শকশ্রোতাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ।