বিষয়ঃ হাওর অঞ্চলের সংকটাপন্ন প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য: মোকাবেলা ও উত্তরণ
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ মূলত একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। এআইআরডি-এর একটি ওয়েভ পোর্টাল হচ্ছে এনডিসিয়া (nDicia) যার উদ্যোগে উন্নয়ন আলোচনা শীর্ষক এই আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করা হয়েছে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ হাওর অঞ্চলের সংকটাপন্ন প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য: মোকাবেলা ও উত্তরণ
আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন জনাব সুলতান আহমেদ, সাবেক উপ-পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, সিলেট বিভাগ এবং জনাব মোস্তাফিজুর রহমান, কমিউনিটি রিসোর্স ম্যানেজম্যান্ট এক্সপার্ট।
আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ।
অনুষ্টানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ৫/১২/২০২৪ তারিখ রাত ৮ টা থেকে ৮:৪৫ মিনিট পর্যন্ত।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওর বলতে আমরা বুঝি ইউনিক ইকোসিস্টেম বা অনন্য প্রতিবেশ ব্যবস্থা। হাওরকে কেন ইউনিক ইকোসিস্টেম বলা হয়?
সুলতান আহমেদঃ হাওর হলো একটি বিশেষ পরিবেশ, যেখানে মাটি, পানি, ও জলজ উদ্ভিদ মিলিয়ে অনন্য বৈচিত্র্য বিরাজমান। শুষ্ক মৌসুমে হাওরের মাটিতে সবুজ শস্যক্ষেত্র দেখা যায়, আর বর্ষায় এটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়, যা সাগরের মতো বিস্তৃত মনে হয়। ধারণা করা হয়, “হাওর” শব্দটি “সায়র” বা “সাগর” থেকে এসেছে। বর্ষায় নদী ও খালের পানি এসে হাওরগুলোকে একত্রিত করে, আর শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে তলানিতে চলে যায়। হাওরের সঙ্গে নদীর সংযোগ এটিকে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনন্য করেছে। ঋতুভেদে এর রূপ বদলে যায়, যা হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তোলে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাছ এবং ধানের প্রধান উৎস-এ বিষয়ে কিছু বলুন।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এলাকা, বিশেষ করে সিলেট হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভিবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সাতটি জেলা নিয়ে বিস্তৃত। এ অঞ্চলটি মূলত নদীর স্রোত, খাল, এবং মৌসুমী জল ব্যবহৃত চাষাবাদ-নির্ভর সমতলভূমি, বিল ও বিভিন্ন জলাভূমির সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিশাল হাওর অঞ্চলগুলো দেশের অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য এবং খাদ্য নিরাপত্তায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাওরগুলোতে বছরের একটি অংশ পানিতে প্লাবিত থাকে, যা মাছের প্রজনন এবং বৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয়। এই হাওর অঞ্চলে প্রকৃতির এমন এক চিত্র কাজ করে, যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য উদাহরণ। সবকিছু মিলিয়ে এ অঞ্চলটি এক অনবদ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের অন্য এলাকাগুলোও প্লাবন ভূমি, এখন ভৌগলিক অবস্থান, পরিবেশ বা ইকোসিস্টেমকে যদি কনসার্ন করি তাহলে হাওর অঞ্চল কেন বাংলাদেশের অন্য এলাকা থেকে ভিন্ন?
সুলতান আহমেদঃ দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চল বিশেষভাবে অনন্য। এই অঞ্চল প্রাকৃতিকভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। এ এলাকাগুলো হাওর ও নদীর মিলনস্থল, যেখানে সুরমা ও কুশিয়ারার মতো বড় নদীর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে। এক সময় এই অঞ্চলের নদীগুলোর শাখার সংখ্যা হাজারেরও বেশি হিসেবে গণনা করা হয়েছিল। এছাড়া, সুনামগঞ্জে রয়েছে ১০০৪টি বিলসহ অন্যান্য হাওর অঞ্চলে ও হাজার হাজার জলমহাল। অতীতে এসব জলমহাল একই নামে পরিচিত ছিল, তবে বর্তমানে তাদের আলাদা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে এখনও বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওরকে দেশীয় প্রজাতির ফিশ ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাওরের মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন?
সুলতান আহমেদঃ হাওরের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো এটা মাছের বিচরনক্ষেত্র বা আদি অবস্থান। এক সময় এই অঞ্চলে মাছের এমন প্রাচুর্য্য ছিল যে এটি প্রকৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। যদিও সময়ের সাথে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে, তবুও হাকালুকি হাওরের মতো জায়গায় এখনো প্রায় ১৬০ প্রজাতি বা তার চেয়েও বেশি প্রজাতির মাছ টিকে আছে। বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে এমন প্রাচুর্য্যতা দেখা যায় না। এ কারণে হাকালুকি হাওরকে আমরা একটি “ফিশ ব্যাংক” বা মৎস্য আধার হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। শুধু মাছই নয়, এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ, প্রাণিকণা এবং পাখির বিচিত্র সমাবেশ দেখা যায়, যা অন্য কোনো জায়গায় এত সহজে দেখা যায় না। বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার পরেও এখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রজাতি এখনো টিকে আছে, যা এই হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত গুরুত্বকে বিশেষভাবে তুলে ধরে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওরকে বলা হয় জীববৈচিত্র্যের আধার। বিভিন্ন ধরণের পরিযায়ী পাখি, দেশীয় পাখিসহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণির বিচরন হাওরে। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে পাখির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের প্রাণির আধিক্য কমে যাচ্ছে, এর কারণ কি?
মোস্তাফিজুর রহমানঃ হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়ার পেছনে জলাশয়ের ক্রমাগত শ্রেণি পরিবর্তন, মানুষের অতিমাত্রায় ব্যবহার জলজ উদ্ভিদ ও গাছপালার সংখ্যা কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত, হাওরের হিজল ও করচ গাছের বাগান ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে এই সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে। পাখি সবসময় পানির মধ্যে বিচরণ করে না; এক পর্যায়ে তাদের বিশ্রামের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে যেতে হয়। কিন্তু সেই স্থানের অভাবেই পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। হিজল ও করচ গাছের অভাবে পাখিদের জন্য প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল সংকুচিত হয়ে পড়ছে, উপযুক্ত অবস্থান না পাওয়ার কারণেই হাওর অঞ্চলে পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যা পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওরের সম্পদের উপর হাওরবাসীর যে অতিনির্ভরতা এটা ইকোসিস্টেম বা জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য কতটুকু দায়ী?
সুলতান আহমেদঃ আল্টিমেটলি, এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত: সরকারি পলিসিগত দিক এবং মানুষের অতি নির্ভরশীলতা। হাওরের জলমহাল ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিমালা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। শুধুমাত্র আহরণকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার ফলে জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। ২০০৯ সালের নীতিমালায় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের স্বার্থ রক্ষার কথা উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বায়োলজিক্যাল ম্যানেজমেন্টের অভাবে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, যা জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর। হাওরের প্রাণ হলো মাছ, এবং হাওরের প্রতিটি উপাদান মিলেই এই পরিবেশ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই সম্পদ রক্ষা করা সহজ নয়। এর জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। হাওরের সম্পদের উপর হাওরবাসীর অতিনির্ভরতা ইকোসিস্টেম এবং জীববৈচিত্র্যের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এটি কয়েকটি দিক থেকে ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য দায়ী হতে পারে। শুষ্ক মৌসুম, বিশেষত ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন মাছ ধরার সময়কাল শুরু হয়, তখন অনেক সময় স্থানীয় জনগণ অতিরিক্ত মাছ ধরার মাধ্যমে হাওরের জীববৈচিত্র্যে ক্ষতি করে। হাওরের পানি স্থানীয় কৃষি ও গৃহস্থালির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং অবৈজ্ঞানিক কৃষি চর্চা পানির পরিমাণ ও গুণমান উভয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, কৃষি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হয়, যা জলজ প্রাণীদের ক্ষতি করে। এসব কার্যক্রম করার ফলে হাওরের ইকোসিস্টেমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ জলমহাল মৎস্যজীবীদের হাতে থাকলে একটা বিল বা জলাভূমির জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্যসম্পদ ঠিক থাকবে কিনা বিষয়টা একটু বলুন?
মোস্তাফিজুর রহমানঃ আমি যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি এবং গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি, সেটি হলো সরকারকে এই বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হবে। আমাদের বিশাল হাওর এলাকার জলমহালগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা জরুরি। বিশেষ করে আমাদের দেশের বিখ্যাত একটি রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর এবং আরও একটি উল্লেখযোগ্য হাওর হাকালুকি যেটা একটা ইসিএ । টাঙ্গুয়ার হাওর, যা এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রামসার সাইট, দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় থাকলেও আমরা এই এলাকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণে বিশেষ অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। টাঙ্গুয়ার হাওরের উৎপাদন ক্ষমতা বিশাল, বিশেষত প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। এই হাওরের মাছ দিয়ে পুরো অঞ্চলের চাহিদা পূরণ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা আমাদের সেই আশা পূরণে ব্যর্থ করছে। এটি পরিষ্কার যে, এখানে ব্যবস্থাপনা বা সংরক্ষণে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। সরকার ২০০৯ সালে “জলমহাল নীতিমালা” চালু করেছিল, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল “জাল যার জলা তার ” কিন্তু এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারায় হাওরের ইকোসিস্টেম এবং দেশীয় প্রজাতির মাছের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারকে এ বিষয়ে অনুধাবন করতে হবে যে, সাময়িক রাজস্ব আদয়ের পরিবর্তে ইকোসিস্টেম বজায় রাখা এবং দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করাই দীর্ঘমেয়াদে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়ায় অবৈজ্ঞানিক এবং অপরিকল্পিত মাছ আহরণ পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে, যা আমাদের হাওর অঞ্চলের ইকোসিস্টেমকে ধ্বংস করছে । আমাদের দায়িত্ব এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশকে রক্ষা করা, যাতে হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ টিকে থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ একসময় হাওরে প্রায় বারো হাজার হেক্টরের উপরে সোয়াম ফরেস্ট (হিজল করচের বাগান) ছিলো যা বর্তমানে এক হাজারের নিচে নেমে এসেছে। এই জলজ বনায়ন ধ্বংসের সাথে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক কতটুকু?
মোস্তাফিজুর রহমানঃ অক্সিজেন পেতে হলে গাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাওরের রাজধানী বা হাওরের গভীরতম অংশ সুনামগঞ্জের দিকে কিছু কিছু হিজল-করচের বাগান দেখা যায় । হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে একসময় হিজলসহ নানা ধরনের বৃক্ষ ছিল, যা আজকাল আর সেভাবে দেখা যায় না। এ ধরনের গাছগুলো কমে যাওয়ায় প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হিজলসহ অন্যান্য বৃক্ষ শুধু অক্সিজেন সরবরাহ করে না, বরং হাওরের মাছের আবাসস্থল হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সরাসরি এই বৃক্ষগুলোর ওপর নির্ভরশীল। বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা আলাদাভাবে বোঝার দরকার হয় না; এটি সবার জীবনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে হাওর অঞ্চল যখন শুকিয়ে যায় এই জায়গাগুলো প্রায় এক বিরাণ ভূমির মতো মনে হয়। তখন চারপাশে কোথাও কোনো গাছপালা দেখা যায় না, যা প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক । এ অবস্থা মেনে নেয়া যায় না । আমাদের উচিত প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে গাছ লাগানো এবং হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। এই অঞ্চলের পরিবেশ এবং মানুষের জীবনযাপনের জন্য বৃক্ষের গুরুত্ব কখনোই অগ্রাহ্য করা উচিত নয় ।
সুলতান আহমেদঃ হাওরের মাছ ধরার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাওরের মাছ ধরা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সঙ্গে মানুষের জীবিকা সরাসরি জড়িত। তবে দায়িত্বহীন ব্যবহারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, হিজল গাছ কাটা এবং মাছের নির্বিচার শিকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। গাছপালা সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষা না করলে মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির শঙ্কা দেখা দেয়। মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির জন্য সঠিক পরিবেশ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক। আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুললে হাওরের সম্পদ টেকসইভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। এজন্য সরকারের কঠোর এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মৎস্য অধিদপ্তর অভয়াশ্রম স্থাপন করে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় কিন্তু তারা মৎস্য অভয়াশ্রম না বলে কেন জলাভূমি অভয়াশ্রম বলেনা?
সুলতান আহমেদঃ এডমিনে বসে থাকা ব্যক্তিরা প্রায়ই ‘ট্রাম’ শব্দটি ভুলভাবে ‘অভয়ারণ্য’ উচ্চারণ করেন, তবে ‘অভয়াশ্রম’ শব্দটি এখনো শেখেননি। যদিও নাম বড় বিষয় নয়, মূল লক্ষ্য হলো জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। সুনামগঞ্জের উন্মুক্ত জলাশয় বা নদীগুলো ‘জলমহাল নীতিমালা’র ৩৪ ধারার আওতায় অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করার কথা বলা আছে। একবার সুরমা নদীর শাখায় এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মৎস্যজীবীদের তালিকা তৈরি করে তাদের সহযোগিতায় কিছু স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ ধরনের উদ্যোগ সফল হলে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মৎস্যজীবীদের জীবিকা নিশ্চিত করে সমাজ উপকৃত হতো।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মোস্তাফিজুর রহমান আপনি তো কমিউনিটি ব্যজড ম্যানেজম্যান্ট বা কোলাবরেটিভ ব্যজড ম্যানেজম্যান্ট নিয়ে কাজ করেন, আপনার অভিজ্ঞতা একটু শেয়ার করুন।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ কো-ম্যানেজমেন্টের প্রসঙ্গ যদি বলি, এটি সম্ভবত মাছ প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল । পরবর্তীতে, ১৯৯৫/১৯৯৭ সাল থেকে এই পদ্ধতির উন্নতি ঘটেছে। পাশাপাশি, লোকাল গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের (LGED) একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১১ বছরের বেশি সময় ধরে কমিউনিটিভিত্তিক জলমহাল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পরিচালিত হয়েছে । এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে লক্ষ্য করা গেছে যে, চমৎকার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে । মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তাদের ম্যানেজ করা সহজ হচ্ছে, এবং তারা বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে । যেমন, বিলগুলোতে ডি-ওয়াটারিং না করা, বৃক্ষরোপণ করা এবং সেই বৃক্ষগুলো রক্ষার জন্য তাদের সচেতন করা । সবকিছু ঠিক থাকলেও আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা হলো, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর মানুষগুলোকে পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না, তখন তাদের অংশগ্রহণ কমে যায় । প্রকল্পের প্রাথমিক লক্ষ্য প্রকল্প সহায়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যা প্রকৃতপক্ষে টেকসই উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয় । এক্ষেত্রে, প্রকল্পের কার্যক্রমকে মূলধারায় (mainstreaming) নিয়ে আসার জন্য আরও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধুমাত্র প্রকল্পগুলোর সাময়িক লক্ষ্য পূরণ করে থেমে না থেকে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং মানুষের স্বার্থে পরিবেশের টেকসই উন্নয়নের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। ইকোসিস্টেম রক্ষার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রকল্পের স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের দিকে মনোযোগ দেওয়াই এখন সময়ের দাবি ।
মাসুদ সিদ্দিকঃ পরিবেশ অধিদপ্তর গোটা হাওর অঞ্চলকে ইকোলজিক্যালী ক্রিটিক্যাল এড়িয়া ঘোষণা করেছে। আর বাংলাদেশ সরকার ইসিএ রোলস ২০১৬ প্রণয়ন করেছিলো এখন এটা বাস্তবায়ন করাটা কতটুকু জরুরী?
সুলতান আহমেদঃ ইসিএ (Environmental Conservation Act) বিভিন্ন সম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহীত একটি উদ্যোগ। ১৯৫০ সালের ফিশ অ্যাক্ট থেকে শুরু করে নানা নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে, এসব নিয়ম কার্যকর করতে উপযুক্ত বাস্তবায়ন ও এনফোর্সমেন্ট প্রয়োজন। জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও ব্যবস্থাপনার অভাবে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সমন্বয়ের অভাবের কারণে সম্মিলিত উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল সংকট একটি বড় সমস্যা, যা কার্যক্রমে দক্ষতার অভাব তৈরি করছে। এই সংকট মোকাবেলায় কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে জনবল বৃদ্ধি করা জরুরি। পাশাপাশি জনসচেতনতা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা পরিবেশ সংরক্ষণকে আরও সফল করে তুলতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মৎস্য অধিদপ্তর সারাদেশের ছোট বড় বিভিন্ন হাওরে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পোনা অবমুক্ত করে। এটা কি হাওরের ইকোসিস্টেমের জন্য লাভজনক নাকি ক্ষতিকর? এতে কি প্রজাতি বৈচিত্র্যের মত ঘটনা ঘটতে পারে?
সুলতান আহমেদঃ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা এবং ধারাবাহিক স্টাডি চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে। আপাতত মৎস্য আহরণের পরিপূরক হিসেবে পোনা অবমুক্ত করার উদ্যোগটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়া জরুরি। এর জন্য বিল নার্সারি এবং স্টারিং পদ্ধতি উন্নত ও সৃজনশীল হওয়া প্রয়োজন। আমি nDicia এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করছি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা চালিয়ে এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এই প্রক্রিয়া কোনোভাবেই ইকোসিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ হাওরবাসীর অধিকার- এবিষয়ে আপনাদের মন্তব্য কি?
মোস্তাফিজুর রহমানঃ অবশ্যই! যেখানে আমি জন্মেছি, সেই স্থানটির প্রতি আমার অধিকার আছে এটিই স্বাভাবিক। তবে, এই অধিকার ছাড়িয়ে অতিরিক্ত কিছু দাবি করা ঠিক না। উদাহরণস্বরূপ, হাওরের বিশাল জলরাশি হলো প্রাকৃতিক সম্পদ, যা সেচ, কৃষিকাজ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত হয়। এই পানি এবং হাওরের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহারের অধিকার অবশ্যই সবার রয়েছে, তবে এই ব্যবহারের সীমা এবং দায়িত্বশীলতা একটি আলোচনার বিষয় । নিজের প্রয়োজনের কথা ভাবার পাশাপাশি, অন্যের অধিকার এবং সম্মিলিত কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব । বিবেকবান ও বিচক্ষণতার সাথে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
সুলতান আহমেদঃ মানুষ অধিকারের বিষয়ে যতটা সচেতন, দায়িত্ব সম্পর্কে ততটাই উদাসীন। তবে অধিকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দায়িত্ববোধও ততটাই জরুরি। দায়িত্ববোধ চর্চা করলে স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কমে আসবে। প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় অধিকার ও দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয় থাকা আবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, বাড়ির পাশের জলাশয়ে শোল বা টাকি মাছের পোনা ধরে যদি ভাজি করে খাওয়া অধিকার মনেকরি তাহলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাই, অধিকার চর্চার সময় আমাদের উচিত দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ থাকা। অধিকার ও দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক হলে সমাজে ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২/৩টা সুপারিশ করুন।
সুলতান আহমেদঃ
- অভয়াশ্রম স্থাপন এবং এর রক্ষনাবেক্ষন করা জরুরী
- প্রজননক্ষম মা মাছের প্রজননের সময় অন্তত ২মাস হাওর অঞ্চলে মাছ শিকার বন্দ রাখতে কঠোর আইন এবং সঠিক প্রয়োগ।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ
- প্রচুর পরিমাণে জলজ বৃক্ষ রোপন করা জরুরী
- হাওরের ইকোসিস্টেম বা জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য হাওর অঞ্চলে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরীর আগে এনালাইসিস বা রিসার্চ করা অবশ্যই প্রয়োজন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ nDicia-র এই উদ্যোগ সম্পর্কে আপনাদের মতামত তুলে ধরুন।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ nDicia-র উদ্যোগে প্রতি সাপ্তাহিক আয়োজিত বিভিন্ন বিষয়ের উপর উন্নয়ন আলাপচারিতা অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ । এ ধরনের আলোচনা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস । আমি nDicia-র উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি ।
সুলতান আহমেদঃ এটা একটা অসাধারণ উদ্যোগ। এই আলোচনা প্ল্যাটফর্ম সমাজের নানামুখী সমস্যা ও উন্নয়নের সুযোগগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবার এবং প্রয়োজনীয় সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করে। আপনাদের এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক এবং ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত ও কার্যকর হোক এই প্রত্যাশা রইল।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনাদের দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ।