জীবন ও জীবিকায় বাংলাদেশের নদী
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ একটি গবেষণামূলক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। এআইআরডি-এর একটি ওয়েভ পোর্টাল হচ্ছে এনডিসিয়া (nDicia)। মূলতঃ এনডিসিয়ার উদ্যোগে উন্নয়ন আলোচনা শীর্ষক এই আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করা হয়েছে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ জীবন ও জীবিকায় বাংলাদেশের নদী। অতিথি হিসেবে জুম লিংকে যুক্ত ছিলেন ড. এস. এম রশীদ, পরিবেশবিদ ও কনসালটেন্ট বাংলাদেশ রিজিওনাল ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট-১, ঢাকা এবং জনাব তোফাজ্জল সোহেল, খোয়াই রিভার ওয়টারকিপার, সদস্য কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি-বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন। আলোচনাটির সঞ্চালনায় ছিলেন মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের নদ-নদী সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারনা দিন, পাশাপাশি গংগা-ব্রহ্মপূত্র-মেঘনা রিভার বেসিন (GBM) সম্পর্কে কিছু বলার অনুরোধ করছি|
তোফাজ্জল সোহেলঃ সিলেট অঞ্চলে যে নদীগুলো রয়েছে এবং এগুলো যে জায়গায় পতিত হয়েছে সেটা হবিগঞ্জের পার্শ্ববর্তী এলাকা লাখাইয়ের কাছে মেঘনা এখানে সীমান্ত অতিক্রমকারী নদী যেমন আছে তেমনি দেশীয় নদীও আছে। প্রায় দুই শতাধিকের উপরে নদীর নাম আছে, যা ১৯৭১ পরবর্তী ৫০ বছরে সংগ্রহ করা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী হবিগঞ্জ জেলায় প্রায় ৭০টি নদীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে একেকটা নদীর অঞ্চলভিত্তিক আলাদা নাম আছে। সাম্প্রতিককালে যেটা লক্ষণীয় হবিগঞ্জের পার্শ্ববর্তী জেলা কিশোরগঞ্জে হাওরে যে সড়ক হয়েছে তার জন্য কিছুটা প্রভাব পড়েছে হবিগঞ্জ তথা সিলেট অঞ্চলে। যার ফলে এই অঞ্চলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে যে নদীগুলো রয়েছে তার মতই এই অঞ্চলের নদ-নদীর অবস্থা। এদের অবস্থান খুব একটা ভালো বা সুখকর নয়। নদী কর্মী বা নদী নিয়ে কাজ করেন, নদী কেন্দ্রীক যাদের জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেখানেও খুব একটা ভালো অবস্থান নেই।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশে সঠিক হিসাবে ঠিক কতটি নদী রয়েছে?
ড. রশীদঃ এটা নিয়ে মতভেদ (কন্ট্রোভার্সি) আছে। কোন বইতে ৭০০টি দেখা যায়, আবার কোন কোন বইতে ৩০০টি, কোন বইতে ৩২০টি এবং কোন বইতে ৩৬০টি ও পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে আইনুন নিশাত স্যার বলেছেন প্রায় ১২০০টির মতো নদী আছে। সঠিক সংখ্যা এখনো নির্ণয় করা যায়নি তবে এর একটা ইনভেন্টরি করা প্রয়োজন। এর মধ্যে বাংলাদেশের কিছু নদী হারিয়ে গিয়েছে যার অস্তিত্ব পাওয়াও কঠিন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ৫৪টি নদী শেয়ার করেছে এই আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর (ক্রস বর্ডার রিভার) অবস্থা সম্পর্কে একটু বলুন।
ড. রশীদঃ বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহটা (ওয়াটার ফ্লো) কমে গেছে। নদীগুলোর পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার ফলে এর পরিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে। ভারতের পাটনা শহরেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে, যেখানে গঙ্গার পানি অতীতে যেমন ছিল প্রাচুর্য্যময়, আজ তা অনেক কমে গেছে। পানি সংকট ও নদীশাসনের প্রভাব এই সমস্যাগুলোর মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের নদী বা সীমান্তবর্তী নদীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ সিলেট-হবিগঞ্জ অঞ্চলে কয়েকটি বড় নদী আছে, যেগুলোকে সীমান্তবর্তী নদী (ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার) বলা হয়ে থাকে। ওই নদীগুলোর অবস্থা কি? পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় হাওর অঞ্চলের নদীগুলোর অবস্থা কেমন, তোফাজ্জল সোহেল একটু বলবেন?
তোফাজ্জল সোহেলঃ যে জিনিসটা দেখা যায় খোয়াই নদী যেটা সীমান্ত অতিক্রমকারী নদী। এই নদীটির উজানে নব্বইয়ের দশকে ভারত সরকার চাকমা ঘাট ব্যারেজ দিয়েছিলো। আর কুশিয়ারার দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে চর পড়েছে বা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীগুলোর যথার্থই পানির প্রবাহ কমে গেছে। এর কারণ উজানে ভারত সরকারের পানি সীমিতকরণ বা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নদীর উপর যে অত্যাচার করা হয় সেটাও দায়ী। সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীগুলোর অবস্থা ভালো নেই যার কারণে শুষ্ক মৌসূমে বাংলাদেশে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। খোয়াই নদী নব্বইয়ের দশকে প্রচন্ড স্রোতস্বীনী ছিল কিন্তু সেই নদীতেই শুষ্ক মৌসূমে এখন হাটু জলে নেমে আসে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ড. রশীদ নদীর হেলথের বিষয় যেটা বলতে চাচ্ছি যেমন শুষ্ক মৌসূমে পানি কমে যাওয়া, পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া বা আগাম বন্যা এগুলো কি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে?
ড. রশীদঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আছে, তবে বেশিরভাগই মানুষ দ্বারা যে কর্মকান্ড হয়েছে বা হচ্ছে তার প্রভাব। বাংলাদেশের তিস্তা নদীর উপর ভারতের চার-পাঁচটা বাঁধ আছে এই বাঁধ দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি উন্নতির জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, নদী সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ। নদীগুলোর সুরক্ষা ও পানি প্রবাহের উন্নতি না হলে, এই সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। নদী নিয়ে কূটনৈতিক বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের আরও ফলপ্রসু আলোচনা করা প্রয়োজন। যেহেতু বাংলাদেশ নিম্নাঞ্চল, ভারতকে অবশ্যই এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে। নদীগুলোর জীবনধারা বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী নদী নির্ভর, সেটা শহর বলেন বা গ্রাম বলেন। নদী নির্ভর জীবন-জীবিকা সম্পর্কে বলুন? দুজনের কাছেই জানতে চাচ্ছি।
তোফাজ্জল সোহেলঃ ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ দেশের মানুষের জীবনধারা নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সকালে নদীর পাড়ে হাঁটতে যাওয়া, হাত-মুখ ধোয়া কিংবা কৃষকের জমিতে সেঁচ দেওয়া সবকিছুতেই নদীর ভূমিকা অপরিহার্য। শুধু মানুষই নয়, নদী সকল প্রাণির জীবন-জীবিকার প্রধান ভিত্তি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক নদী চরম দূষণের শিকার। বর্তমানে হবিগঞ্জের সুতাং নদীকে দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী বলা যায়। এ নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে মৃৎশিল্পীরা মাটি সংগ্রহ করতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়েছেন, যার ফলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প সংকটে পড়ছে। হাজারো জেলে পরিবার মাছ ধরতে পারছে না। নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসূমে নদীপথে যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে। শিল্প ও বর্জ্য দূষণে বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা তো আরও শোচনীয়। এই নদীতে জীবনের কোনো চিহ্ন প্রায় নেই। দূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট চর্মরোগসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। নদীর পানির গুণগত মান কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানিও দূষিত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসূমে টিউবওয়েলেও পানি পাওয়া যায় না, যা মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে পানির স্তর আরও নীচে নেমে যায়। তাই নদী দূষণ রোধ করা জরুরী, না হলে নদী দূষণের প্রভাবে সামগ্রিক জীবনধারা ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যা ভয়াবহ হতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ নদীর পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে জলজ জীববৈচিত্র্যে নদীর ভূমিকা সম্পর্কে ড. রশীদ একটু বলুন?
ড. রশীদঃ নদী একটি লিনিয়ার সিস্টেম, যা সাধারণত উজান থেকে বয়ে এসে ভাটির দিকে প্রবাহিত হয়। সাধারণত উজানে নদী সরু থাকে, তবে যতই ভাটির দিকে আসে, এর প্রশস্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একইসঙ্গে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি ডেল্টা অঞ্চল বা প্লাবনভূমি, এখানকার নদীগুলোর মধ্যে একটি প্রধান চ্যানেল থাকে এবং পাশাপাশি প্লাবনভূমিগুলোও থাকে। একটি বড় সমস্যা হলো নদী এবং প্লাবনভূমির মধ্যে সংযোগ কমে যাওয়া। নদীর গতিপথে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেশ সৃষ্টি হয়, যাকে “ইকোলজিক্যাল নিস (Ecological Niche)” বলা হয়। প্রাণিকুল এটির উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণী ঘড়িয়াল একসময় পদ্মা নদীতে দেখা যেত, কিন্তু এখন তা উজানে যমুনা নদীতেও সীমিত হয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে করেন ঘড়িয়াল বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আবার কেউ বলেন বন্যার সময় ভারত থেকে কিছু ঘড়িয়াল চলে আসে। বর্তমানে এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। শুশুক নিয়েও কাজ হচ্ছে। কিছুদিন আগে জেলেদের জালে একটি ঘড়িয়াল ধরা পড়েছিল, কিন্তু তারা সেটি মেরে ফেলেছে। অথচ ঘড়িয়াল একটি নিরীহ প্রাণী, যা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। এসব বিষয় সবার বুঝতে হবে। বাংলাদেশের নদীগুলো থেকে কাছিম প্রায় হারিয়ে গেছে। একসময় ভোঁদড়ও পাওয়া যেত, কিন্তু সেটিও এখন বিলুপ্তঃপ্রায়। যমুনা নদীতে শুশুক নিয়ে কাজ করার সময় দেখা গেছে, জেলেরা যে জাল ব্যবহার করেন, তা শুশুকের জন্য ক্ষতিকর। অনেক সময় শুশুক ওই জালে আটকা পড়ে। এ ছাড়া অনেক জেলে অবৈধ জালও ব্যবহার করেন। জেলেরা নদীর ওপর নির্ভরশীল। এখন আমাদের নদীর পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, জলজ প্রাণিগুলোকে বাঁচাতে হবে, আবার জেলেদের জীবিকার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যদিও বিষয়গুলো অনেক চ্যালেঞ্জিং, তবুও নদী এবং দেশকে বাঁচাতে হবে আর গলগ প্রতিবেশ রক্ষা করতে হবে। নদী দেশের জীবন, এটি রক্ষা করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এখন প্রায় প্রতিবছরই বন্যা, নদী ভাঙ্গন, নদী দূষণ হচ্ছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে ক্ষয় ক্ষতিটা কোন কোন ক্ষেত্রে হয় ড. রশীদ একটু বলুন?
ড. রশীদঃ এটাতো একটা ডিজাস্টার। ভাঙ্গনের ফলে কৃষকের উপর প্রভাব পড়ছে, ভূমির প্রকৃতি পরিবর্তন (ল্যান্ডটাইপ চেঞ্জ) হয়ে যাচ্ছে, কৃষির ধরণও (ক্রপিং প্যাটার্ণ) পরিবর্তিত হচ্ছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার লস) যেমন, নদীর ধারে নির্মিত স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্র্রাসা, মন্দির, হাট-বাজার এবং রাস্তাঘাট বিলীন হচ্ছে। নদী ভাঙ্গনের কারণে সেখানকার লোকজন অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ নদী ভাঙ্গনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষ রিপ্লেসমেন্টের (স্থানান্তরিত) শিকার হয়। এ সম্পর্কে তোফাজ্জল সোহেল কিছু বলুন?
তোফাজ্জল সোহেলঃ নদী বাংলাদেশের মানুষের সভ্যতা, নদীর মাধ্যমে মানুষ সভ্যতা অর্জন করেছে। এখন কথা হচ্ছে মানুষ কতটুকু সভ্য হতে পেরেছে বা হয়েছে। অনেক মানুষ নদীকে পুঁজি করে নিয়েছে। উজানের পলিবাহিত দেশ বাংলাদেশ। আশেপাশের যত নদী আছে এগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় নদীর উপর কি মারাত্মক অত্যাচার মানুষ করছে। ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈজ্ঞানিকভাবে, অপরিকল্পিতভাবে এবং নির্বিচারে মাটি আর বালু উত্তোলন করছে। এভাবে নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে। মেশিন দিয়ে যখন বালু উত্তোলন করা হয় তখন নদীর যে অবকাঠামো আছে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নদীর তলদেশ অসমান হচ্ছে, প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে আর পরিবেশতো দূষণ হচ্ছেই। নদী কেন্দ্রীক যে লোকালয় বা বসতি গড়ে উঠে তার উপর প্রভাব পড়ছে। যেমন সিলেট অঞ্চলের কুশিয়ারা নদী যেটা মেঘনাতে পতিত হয়েছে, এর তীরবর্তী অনেকগুলো গ্রামের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে গেছে। নদীর উপর মানুষের অমানবিক অত্যাচারের কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ নদী রক্ষা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যত সরকারি দপ্তর (গভর্ণমেন্ট এজেন্সি) আছে তাদের মধ্যে সমন্বয় আনার জন্য কি করা দরকার? আর নদী রক্ষায় কোন সংস্থাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
ড. রশীদঃ বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড (ওয়াটার ডেভলপমেন্ট বোর্ড), ওয়ারপো (পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা) এবং নদী রক্ষা কমিশনও আছে। তবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় সমন্বয়হীনতা বা কো-অর্ডিনেশনের অভাব দেখা যায়। এখন এটা তাদের ইগোজনিত কারণ নাকি একজন আরেকজনকে ক্রেডিট দিতে চায়না সেই ধরনের কিছু। প্রকৃতপক্ষে এটার কারণে যে আমাদের জাতীয় ক্ষতি হচ্ছে এটা বুঝতে হবে। সচেতনতা ভিতর থেকে আসতে হবে। এটা যদি উপলব্ধি না করা হয় তাহলে এই সমন্বয়হীনতার জন্য আমাদের নদীগুলো এবং নদী পাড়ের মানুষের আরো ক্ষতি হবে। তাই সমন্বয় করে কাজ করাটা জরুরী। এলজিইডি, ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট, পাউবো এবং নদী রক্ষা কমিশন সবাইকেই নদী রক্ষার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ তোফাজ্জল সোহেল একটু বলবেন বাংলাদেশের নদীগুলোর ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা মাস্টারপ্ল্যান আছে কিনা?
তোফাজ্জল সোহেলঃ বাংলাদেশে নদী, হাওর বা পরিবেশ রক্ষায় যত আইন আছে পৃথিবীর আর কোনো দেশে এসবের জন্য এত আইন নেই। আইন আছে কিন্তু সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছেনা। যদি প্রয়োগ হতো তাহলে জীবন ও জীবিকায় বাংলাদেশের নদী নিয়ে আলোচনা করার দরকার হতো না। মূলত সবাইকে আগে মাইন্ডসেট পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে যারা নদী থেকে বে-আইনিভাবে বালু উত্তোলন করছেন, নদী দখল করছেন, বিভিন্নভাবে নদীকে ধ্বংস করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে। খাজনা আদায়ের নামে সরকারভিাবে নদী ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে শুধুমাত্র হবিগঞ্জে অর্ধেকের বেশি নদী হারিয়ে গেছে বা দখল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে নদী ব্যবস্থাপনা, বালু ব্যবস্থাপনা বা মাটি ব্যবস্থাপনা আইন আছে, এগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীকে দখল, দূষণ এবং ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশের নদীগুলোকে দূর্দশা থেকে বাঁচাতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে এবং সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ যেটা দেখা যায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নদী নিয়ে গবেষণা খুব কম হয়, এ বিষয়ে কিছু বলুন ড. রশীদ?
ড. রশীদঃ একেবারেই যে হচ্ছেনা তেমন নয় আবার খুব বেশি যে হচ্ছে সেটাও নয়। কিছু কিছু গবেষণা হয় ফিশারিজের উপর বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল (একোয়্যাটিক ফণা বা ফ্লোরা) আছে এসবের উপর হচ্ছে বা চলছে। এখন নদী বলেন আর হাওর বলেন এসবের উপর গবেষণা বাড়াতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে কি করতে হবে, কি করলে জলজ প্রাণির ক্ষতি হবেনা, কি করলে নদীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে এসব কিছু বুঝা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার জন্য গবেষণা বাড়াতে হবে। আর এ জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ এর আন্ডারে যে ভার্চুয়াল পোর্টাল nDicia, এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ সম্পর্কে কিছু বলুন?
ড. রশীদঃ অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। এই অলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। প্রকাশনার পাশাপাশি জনগণের সাথে কথা বলা, বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করা, যাতে এটাকে আরো জনপ্রিয় করা যায়। যত বেশি মানুষ জানবে তত বেশি উপকারে আসবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ সম্পর্কে তোফাজ্জল সোহেল আপনিও কিছু বলুন, আর আপনি টেরিবেকার এওয়্যার্ড (পুরষ্কার) পেয়েছেন এই এওয়্যার্ড সম্পর্কে কিছু বলুন?
তোফাজ্জল সোহেলঃ এআইআরডিকে অবশ্যই ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। এটা চালিয়ে যেতে হবে এবং সেইসাথে নদী কেন্দ্রীক আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি। এটা অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ। আর টেরিবেকার পুরষ্কারের কথা যেটা বললেন, ওয়াটারকিপার এলায়েন্স নামে আন্তর্জাতিক পানি এবং নদী বিষয়ক একটা সংগঠন রয়েছে, যার সদর দপ্তর আমেরিকায়। এর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন হয় আমেরিকার মিলওয়াকি শহরে। টেরিবেকার ছিলেন একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আর এই কমিউনিটির অন্যতম সদস্য এবং ওয়াটারকিপার এলায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সদস্য। তার মাধ্যমেই এই এওয়্যার্ডের যাত্রা। সারা বিশ্বে প্রতিবছর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে দুইজনকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। আমেরিকা এবং কানাডা থেকে একজন আর অন্য সব দেশ মিলিয়ে একজন। এটা অবশ্যই সম্মানের, এই এওয়্যার্ড আমার একার অর্জন নয় এই অর্জন সারা বাংলাদেশের।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মোদ্দা কথা যেটা দুজনেই বললেন নদীগুলি দেশের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং দেশের জীবন ও জীবিকার প্রধান চালিকাশক্তি। কৃষি, মৎস্য, পরিবহণ এবং বিশুদ্ধ পানির উৎস্য হিসেবে সর্বক্ষেত্রে নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গুরুত্বপূর্ণ নদী সম্পদ রক্ষা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। এর সঠিক সংরক্ষণ দেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য। আর সেটাই হলো নতুন চ্যালেঞ্জ।
আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য আপনাদের দুজনকেই ধন্যবাদ।