গড়জরিপা: শেরপুরের প্রাচীন রাজধানী

আবদুস সামাদ ফারুক
সাবেক সিনিয়র সচিব

ফেব্রু ৬, ২০২২ | ইতিহাস ও ঐতিহ‌্য

Ended soon

‘গড়’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ কেল্লা, দুর্গ, পরিখা, খাত। অতীতকালে সম্রাট, রাজা, বাদশা ও শাসকগণ কেল্লা কিংবা নিরাপত্তার জন্য সেনানিবাসে বসবাস করতেন। সেনানিবাস থেকে নিরাপদে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। দিল্লীর লালকেল্লা সম্রাট আকবরের সেই স্মৃতি বহন করে, আর ঢাকার লালবাগের কেল্লা মীর জুমলার স্মৃতিকে লালন করে। মহাস্থানগড় আড়াই হাজার বছরের আগের রাজধানী এবং সেনানিবাস। গড়জরিপা বর্তমান শেরপুর শহর থেকে ০৮ কি: মি: দূরে পশ্চিম-উত্তর দিকে অবস্থিত এক প্রাচীন জনপদ, যার অনেক সৌকর্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও এসব পুরাকীর্তি উদ্ধার করে এবং সংরক্ষণ করে গড়জরিপার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব। গড়জরিপা শেরপুরের শাসকদের প্রাচীন রাজধানী এবং সেনানিবাস।
বর্তমান শেরপুর জেলা ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর পাড়ে অবস্থিত। একশত বছর পূর্বেও জামালপুর শহর ও শেরপুর শহরের মধ্যবর্তী ১৬ কি: মি: জুড়েই ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ। জামালপুর শহরের নদীঘাট হতে শেরপুর শহরে পৌঁছতে নৌকাযাত্রীদের দশকাহন খরচ করতে হতো বলে শেরপুরের আরেক নাম দশকাহনিয়া বাজু। প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্র নদ পদ্মার চেয়ে তিনগুন প্রশস্ত ছিল। দক্ষিণ দিকে ব্রহ্মপুত্র এবং উত্তর দিকে গারো পাহাড় শেরপুর জনপদকে শত শত বছর যোগাযোগ বিছিন্ন করে রাখে। যোগাযোগ বিছিন্নতার জন্য শেরপুর অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
১৯০৬ সালে শ্রী কেদারনাথ মজুমদারের “ময়মনসিংহের বিবরণ” গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে কামরূপে মুসলিম শাসক মজলিস খাঁ হুমায়ুন ও গড়জরিপা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর আলোচনার সারমর্ম নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১৪৯১ খ্রি:-এ ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ব্রহ্মপুত্রের অপর পাড়ে বিজয়ের চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর সেনাপতি মজলিস খাঁ হুমায়ুনকে সেনাবাহিনীসহ প্রেরণ করেন। মজলিস খাঁ শেরপুর আক্রমণ করেন। গড়জরিপায় তখন দলিপ সামন্ত নামক কোচ রাজা রাজত্ব করতেন। যুদ্ধে দলিপ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর থেকেই ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের শুভ সূচনা হয়।
১৪৯০ সালে হাবসী সিদি বদর শামসুদ্দিন আবু নসর মুজাফফর শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসন আরোহণ করেন। ১৪৯৩ সালে কারারুদ্ধ অবস্থায় সিদি বদরের মৃত্যু হলে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ১৪৯৩ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

গড়জরিপার শিলালিপি:
শিলালিপি ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বহন করে। মজলিস খাঁ হুমায়ুনের মৃত্যু হলে দুর্গের ভিতর তাঁকে সমাধিস্ত করা হয়। সমাধিগাত্রে আরবী ভাষায় শিলালিপি পাওয়া যায় (চিত্র ১)। ১৮৭৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা থেকে শিলালিপিটির ইংরেজী অনুবাদ করা হয়।
“In the name of God, the merciful, the element! There is no God but Allah,
Mahammed is Allah’s prophet ** there is no God but Allah** Mahammad is Allah’s prophet **
God bless Mahammed the pure Hussan Hossain ** built ** king of the age and period of Saifudduya uddin Abdul Mazaffar Foroz Shah the king, may God perpetuate his Kingdom and his rule. This (vault?) was completed is blessed Ramjan 8**

শেরপুরের বিদ্যুৎসাহী জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী ১৮৭১ সালে এই শিলালিপিটি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতায় প্রেরণ করেন। ১৯৭৪ সালে অধ্যাপক ব্ল্যাকম্যান (Blackman) আরবী ভাষায় লেখা শিলালিপিটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। যার ভাবানুবাদ নিম্নরূপ:
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহর পয়গম্বর। হে আল্লাহ মুহাম্মদ (সা:), হযরত আলী (রা:) হযরত হাসান এবং হযরত হোসেনকে রহম কর।
নির্মাণকাল: সাইফদ্দিন আবদুল মোজাফফর ফিরোজ শাহ তাঁর সময়কাল এবং সাম্রাজ্যকে চিরস্থায়ী করেন। রমজান মাসের ৮ তারিখে নির্মিত।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ ও গড়জরিপার বিভিন্ন স্থাপনা:

জরিপ শাহ’র মাজার:
জনশ্রুতি আছে যে, সেনানায়ক হুমায়ুন শাহ গড়জরিপায় প্রবেশ করে দেখতে পান যে জরিপ শাহ নামের এক দরবেশ শরীরের অর্ধেক অংশ মাটিতে পুতে অবস্থান করছেন। তাঁকে স্থান ত্যাগ করতে বলা হলে তিনি কিছুতেই স্থান ত্যাগ করতে রাজী নন। র্শত প্রদান করনে যে, যদি তার নামে গড় নির্মাণ করা হয় তবে তিনি স্থান ত্যাগ করতে পারেন। হুমায়ুন শাহ তাঁর নাম অনুসারে গড়জরিপা নামকরণ করেন।
জরিপ শাহ’র মৃত্যুর পর কালীদহ সাগরের পূর্ব তীরে ১৯০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৬৫ ফুট প্রস্থ এক খন্ড জমির উপর তাঁকে কবরস্থ করা হয় যা জরিপ শাহ মাজার নামে পরিচিত (চিত্র ২)।

হুমায়ুন খাঁ মজলিস রাজধানী সুরক্ষার জন্য প্রায় ১১০০ একর জমির উপর দুর্গ বা গড় নির্মাণ করেন। মাটির জাঙ্গাল দিয়ে দুর্গ প্রাচীর নির্মিত হয়। জমির পরিমাণ দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ১৫ মাইল। দুর্গটি সাতটি প্রাচীর দ্বারা বৃত্তাকারে পরিবেষ্টিত। প্রাচীরগুলি ছয়টি পরিখা দ্বারা পৃথককৃত। পরিখাগুলি আনুমানিক ৯০ ফুট প্রশস্থ এবং ৪০ ফুট উঁচু। বর্তমানে একটি পরিখা রয়েছে যা কালিদহ সাগর নামে পরিচিত।
জনশ্রুতি আছে যে, কোন বিবাহ অনুষ্ঠান বা কোন বড় আয়োজনে হাঁড়ি, পাতিল, ডেক দরকার হলে কালিদহ সাগরে চাওয়া হতো এবং এগুলো ভেসে আসতো। রান্না করে সিন্নী খাওয়ানো শেষে আবার ডেক, পাতিল কালিদহ সাগরে ফেরত দেয়া হতো।

পরিখার দুই পাড়ে দুইটি মাটির জাঙ্গাল এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুর্গ প্রাচীরের চারদিকে ৪টি তোরণ ছিল।
পূর্বপাশের তোরণকে বলা হতো কুমুদুয়ারী;
পশ্চিম পাশের তোরণকে বলা হতো পানিদুয়ারী;
দক্ষিণ পাশের তোরণকে বলা হতো শ্যামুদুয়ারী;
উত্তর পাশের তোরণকে বলা হতো খিরকিদুয়ারী।
দক্ষিণ তোরণের সংলগ্ন পূর্ব পার্শ্বে ছিল উচ্চ টাওয়ার। দুর্গের মধ্যে অনেকগুলি পাথর ছিল। দুর্গ প্রাচীরের ভিতরে পানিদুয়ারীর কাছেই হুমায়ুন শাহ’র কবর অবস্থিত। কবরের দুইটি পাথরের ফলক পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি পাথর ভেঙ্গে দুই খন্ড হয়ে গেছে।

কাদির পীর দরগাহ:

গড়জরিপার ঘোনাপাড়ায় একটি দরগাহ রয়েছে যা কাদির পীরের দরগাহ নামে পরিচিত (চিত্র ৩)। দরগাহ হতে একটি প্রাচীন মসজিদ ছিল যার ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। দরগার কাছে ৩টি পুকুর ছিল। পুকুর ৩টির নাম: রাজা মায়ের পুকুর, সাহেবের পুকুর, আলম পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পার্শ্বে একটি পাথর এবং টিলা প্রাচীন স্মৃতি লালন করছে। পীর সাহেবের কবরের কাছে দাখিল মাদ্রসার জন্য একটি ঘর উত্তোলন করা হয়েছে। অসচেতনতার কারণে কবরটি হারিয়ে গেছে।

কালিদহ সাগর:

গড়জরিপা গ্রামে এখনো শোভাবর্ধন করছে বর্গাকার কালিদহ সাগর (চিত্র ৪)। এর দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে ২টি উঁচু জাঙ্গাল। সাগরে এখনো চাষ হয় শাপলা, শালুক। তাছাড়া পাল তোলা নৌকায় চলে মাছ শিকার। ভ্রমণ পিপাসু বহু মানুষ এখনো এখানে বেড়াতে আসে। এখানে প্রতি বছর দুই তিনদিন ব্যাপী মেলা বা উৎসব হয়। যার নাম বরমীস্নান এবং অষ্টমী মেলা

ডিঙ্গি:
কালিদহ সাগরের দক্ষিণ পশ্চিমাংসে একটি লম্বা উঁচু স্থান আছে যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ ফুট, প্রস্থ ১৮ ফুট থেকে ৯ ফুট বা ৫ ফুট। সবাই বলে ইহা চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গি। জায়গাটি উঁচু এবং দেখতে ডিঙ্গির মতো। যদিও মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গি বগুড়ায় অবস্থিত।

ডিঙ্গির অনেক বৈশিষ্ট রয়েছে। কালিদহ সাগরে যতই পানি বৃদ্ধি হোক না কেন ডিঙ্গি কখনো ডুবে না। জনৈক ব্যক্তি সৈয়দুর রহমান কোঁদাল দ্বারা একপাশ কেটে ডিঙ্গির একাংশ কেটে ফেলার চেষ্টা কালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডিঙ্গির পাশে যে ছাদের গুড়ি আছে তা কেউ উঠাতে পারেন না। গুড়িটি কেউ উঠাতে গেলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

কোঁদাল ঝাড়া পাহাড়:
গড়জরিপার দুর্গের সন্নিকটে কালীগলু ও মোবারকপুর গ্রামের মাঝে আখেরী বাজারের কাছে একটি অনুচ্চ টিলা (পাহাড়) আছে। ইহাই কোঁদাল ঝাড়া পাহাড় নামে খ্যাত। দু’ধরণের জনশ্রুতি আছে এই টিলা নিয়ে।
প্রথম ধারণা হচ্ছে কালিদহ সাগর ও অন্যান্য পরিখা খনন করে শ্রমিকরা বিশ্রাম গ্রহণ করতো এখানে। সে সময় কোঁদাল পরিষ্কার করতো। কোঁদাল ঝাড়ার মাটি জমে টিলা পাহাড় সৃষ্টি হয়।
অন্য ধারণাটি হলো, ১৮০৭ সালে কালিগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এবং সেনানিবাস স্থাপন করা হয় প্রধানত ফকির সন্নাসী বিদ্রোহ দমন করার জন্য। সৈনিকদের প্রশিক্ষণের জন্য পুকুর কেটে এই পাহাড়টি সৃষ্টি করা হয়।

বারদুয়ারী শাহী মসজিদ:

বারদুয়ারী শাহী মসজিদটি অনুমান করা হয় মজলিস খাঁ হুমায়ুনের সময় নির্মিত। গড়জরিপার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। কিন্তু কালের প্রবাহে মসজিদটি মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। জামালপুরের মাওলানা আজিজুল হক ১৯৬১ সালে মসজিদটির সন্ধানে প্রচেষ্টা চালিয়ে ১৯৬৩ সালে মসজিদটির সন্ধান পান। মসজিদটির উপর বিশাল বড় বট গাছ ছিল। আশেপাশে ঘন জঙ্গল। প্রচন্ড ঝড়ে এক সময় বট গাছটি উপড়ে পড়লে মসজিদের এক কোন দৃষ্টিগোচর হয়। আজিজুল হকের নেতৃত্বে মাটি খনন করে মসজিদটির ভাঙ্গা দেয়াল দেখতে পাওয়া যায়। দেয়ালে বিভিন্ন নকঁশা খচিত। দরজা চিহ্নিত করে গণনা করা হলে দেখা যায় বারটি দরজা। প্রকৌশলীদের পরামর্শে পুরানো ভিত্তি ও দরজার অবস্থান এবং কাঠামো ঠিক রেখে নতুন দেয়াল ও ছাউনির কাজ সম্পন্ন করা হয়। পাঞ্জেখানা নামাজ শুরু করা হয়। ১৯৬৪ সালে মসজিদটি পুন:নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ ফুট, প্রস্থ ৪০ফুট। একটি একতলা মসজিদ। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের সামনে ৯টি দরজা, দক্ষিণ পার্শ্বে ২টি দরজা, উত্তর পার্শ্বে ১টি দরজাসহ মোট ১২টি দরজা।

তথ্যসূত্র:
১. ময়মনসিংহের ইতহিাস: দেজ পাবলিশিং, কলকাতা-০০০৩
২. ময়মনসিংহের বিবরণ: শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
৩. ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি: ময়মনসিংহের জেলা পরিষদ
৪. শেরপুর জেলার অতীত ও র্বতমান: আলহাজ্ব পণ্ডতি ফছিহুর রহমান
৫. ইতিহাস ও ঐতিহ্যে গড়জরিপা: প্রকৌশলী এম. আহসান আলী ও মো: আকরাম আলী
৬. শেরপুরের ইতিকথা: অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন