Ended soon
রোবট একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোবট নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা কাজ হলেও বাংলাদেশে অতি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় আধুনিক প্রযুক্তির রোবট বানাতে সক্ষম হয়েছে। অনেক পরে হলেও বাংলাদেশ গুরুত্ব দিচ্ছে রোবট ও রোবোটিকস শিক্ষার ওপর। রোবট নিয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে ‘রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে আলাদা বিভাগ। জানা গেছে, ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টেও সম্প্রতি রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্য পরিবেশনের কাজে।
বাংলাদেশে রোবোটিক্স শিক্ষা ব্যবস্থাঃ রোবোটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর সমন্বিত রূপ। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই তিনটি বিষয়ে আলাদাভাবে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ থাকলেও, কেবল রোবোটিকসের ওপর কোনো আলাদা বিভাগ বা কোর্স ছিল না। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম চালু করে ‘রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে একটি বিভাগ।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রোবট নিয়ে চর্চা করার জন্য বুয়েট রোবোটিকস সোসাইটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে তারা নিজেদের মধ্যেই কাজ শেখা এবং শেখানোর বিষয়টি না রেখে স্কুল ও কলেজ পর্যায়েও রোবট শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন। সংগঠনটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫০০। সোসাইটি থেকে বছরে অন্তত একটি হলেও ন্যাশনাল ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। সারা বছর থাকে বিভিন্ন ধরণের ওয়ার্কশপের আয়োজন। রোবট নিয়ে নানা কাজ করছে সিলেটের শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও।
কৃষিনির্ভর এই দেশ ধীরে ধীরে শিল্পনির্ভর দেশ হয়ে উঠছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণে এখনো বিদেশী যন্ত্রপাতি এবং লোকবলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বিশেষায়িত শিক্ষা না থাকার দরুন দেশীয় জনবল এখনো প্রয়োজনীয় পর্যায়ে যেতে পারছে না। কিন্তু শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদশীলতা এবং সমৃদ্ধি বাড়াতে রোবট ও রোবোটিকসের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে রোবটের সম্ভাবনাঃ শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোবোটিকস নিয়ে আগ্রহ থাকলেও কাজের ক্ষেত্র ছিল সীমিত। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিকস প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। রোবট নিয়ে কাজ করছেন এমন অনেকেই জানান, রোবোটিকস প্রতিযোগিতার আয়োজন করার জন্য নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য সামনে রাখা উচিত। যে শিক্ষার্থীরা এই বিষয়ে আগ্রহী তাদের আগ্রহ ধরে রাখতে, রোবট তৈরির প্রয়োজনীয় সব জিনিস সহজলভ্য রাখতে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে, তাদের প্রেরণার জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত।
বিদেশে রোবট রপ্তানিঃ ‘প্ল্যানেটার লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে রোবট। এই প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ২৮টি এবং বাণিজ্যিকভাবে ১১টি রোবট তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম রোবট রপ্তানি করা হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। দক্ষিণ কোরিয়ার ‘সলিউশন ব্যাংক প্লাস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ত্রিমাত্রিক কংক্রিট প্রিন্টার রোবট পাঠানো হয়। এটি নকশা অনুযায়ী কংক্রিট দিয়ে ত্রিমাত্রিক স্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার দিয়ে সাধারণত প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যাদি প্রিন্ট করা হয়; কিন্তু এই রোবট কংক্রিটের স্থাপনা প্রিন্ট করতে সক্ষম। এই রোবটের রপ্তানিমূল্য ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা (প্রায় ২ হাজার ১০০ ডলার)।
রোবটে পুরস্কারঃ দেশ-বিদেশের নানা আয়োজনে পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা। এর মধ্যে আছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে থাইল্যান্ডের চিয়াংমাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের (আইআরও) ২১তম আসরে একটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্যসহ ১০টি পদক অর্জন। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার লংকাউয়িতে অনুষ্ঠিত ‘আইইইই-আরএএস ইন্টারন্যাশনাল রোবট প্রাইড কম্পিটিশন-২০১৫’-এ স্বর্ণপদক পায় বুয়েটের ‘টিম দিশারি’। ধ্বংসস্তূপের নিচে গিয়ে মানুষের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে, দূর থেকে রোবটটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং রোবটের সঙ্গে থাকা ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি সরাসরি পর্দায় ভেসে উঠবে ‘ম্যাপ-এক্সপ্লোরার’ নামে এমন একটি রোবট বানিয়েছিল তারা।
শিক্ষার্থীদের বানানো কিছু রোবটঃ বিশ্বের প্রথম বাংলাভাষী এবং সোশ্যাল রোবট ‘রিবো’। মানুষের সঙ্গে বাংলায় কথা বলা এবং বাংলায় লিখতে পারাসহ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে পারে রিবো। বিভিন্ন ধরনের মুখভঙ্গি করা, চোখের পাতা ও ঠোঁট নাড়াতে পারা, হ্যান্ডশেক করা এমনকি নাচতেও পারে রোবট রিবো। শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তরুণ তৈরি করেন এই রোবটটি। ‘রিবো’র পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে বানিয়েছিলেন রোবট ‘লি’। রিবোর মতো লি’ও কথা বলতে পারে, হ্যান্ডশেক করতে পারে। তবে লি হাঁটতে পারে, যেটি রিবো পারত না।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী মুদ্রণব্যবস্থার নাম ব্রেইল। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বানানো ‘স্কারা আর্মবট’ নামের রোবটটি সহজ ও সুলভমূল্যে এই ব্রেইল ছাপার কাজ করতে পারে। শিল্পক্ষেত্রে যন্ত্রাংশ সংযোজন এবং প্লটার ও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে এই রোবট কাজে লাগানো যাবে।
কথা শুনে গাড়ি চালাতে পারে এমন রোবট তৈরি করেছিল বুয়েটের আরও কিছু শিক্ষার্থী। কথার নির্দেশনার পাশাপাশি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ এবং কিবোর্ড দিয়েও রোবোকারটি চালানো যাবে। সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্মার্ট হুইলচেয়ার বানানো যায়। নিজে না চালালেও দূর থেকে অন্য কেউ রোবোকারটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
আমাদের প্রত্যাশা বিশ্বমানের রোবোট তৈরি ও উন্নয়নে যুবক-যুবার আরো বেশী এগিয়ে আসবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর উন্নয়নে আরো বেশী গুরুত্ব প্রদান করবে এবং সর্বোপরি সরকার এ বিষয়ে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা নিবেন। তা ছাড়া এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন জরুরী।