ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ও মুসলমানদের ঈদ ঐতিহ্য (প্রথম পর্ব)

ড. সৈয়দ আলী আজহার
চেয়ারপার্সন, AIRD Ltd.

অক্টো ১৫, ২০২২ | ইতিহাস ও ঐতিহ‌্য

Ended soon

শোলাকিয়া ইদগাহ প্রতিষ্ঠার অন্তরালে রয়েছে কিশোরগঞ্জে ইসলাম প্রচার ও প্রসার, মুসলমানদের ঈদ ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক ইতিহাস ও সৃষ্টি রহস্য যেমনটি রয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টিরহস্য। তবে হয়তো তাঁদের অনেক রহস্যই আমাদের অজানা রয়েছে। তাই গবেষকগণ প্রতিনিয়ত গবেষণা করে অনেক বিষয়ে আমাদেরকে জানার সুযোগ করে দিচ্ছেন। শোলাকিয়া ইদগাহ মাঠের এই সৃষ্টি রহস্য হয়তোবা বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন অবয়বে, বিভিন্ন মাধ্যমে ও বিভিন্ন স্থানে এই ইতিহাস ও সৃষ্টি রহস্য স্থীর হয়ে আছে। তাছাড়া শোলাকিয়া ইদগাহ মাঠ কেন ঐতিহাসিক, এর ঐতিহ্য কতটুকু ও প্রাসংগিক কি কি বিষয় এ মাঠের সাথে জড়িত রয়েছে-এসকল প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিতে পারলে তা হবে বেশ সহায়ক, তা ছাড়া জানতে হবে আরব বিশ^ থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ইসলামের আগমন ও ক্রম বিকাশ সম্পর্কে। কেননা পৃথিবীর সৃষ্টির পর মহান আল্লাহতাআলা জীব সৃষ্টি করেন, মানুষ সৃষ্টি করেন, মানুষকে দুনিয়াতে পাঠান, দুনিয়াতে ইসলাম ধর্ম প্রেরণ করেন, নবী ও রাসুল প্রেরণ করেন, প্রথমে আরব বিশে^ ইসলামকে প্রস্ফুটিত করেন এর পর ইসলামের বিকাশ ঘটান সারা দুনিয়াতে। তিনি নামাজের জন্য মসজিদের ব্যবস্থা করেন এবং ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহ মাঠের ব্যবস্থা করেন। তবে প্রতিটির সৃষ্টির অন্তরালে আলাদা অলাদা রহস্য লুকিয়ে আছে-আছে শানেনুজল। একই ধারাবাহিকতায় শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ সৃষ্টির অন্তরালে একটি সুপ্ত ইতিহাস রয়েছে। স্থানীয়পর্যায়ে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে এগুলো বিকশিত থাকলেও বা সীমিত মানুষ জেনে থাকলেও বৃহত্তর আঙ্গিকে এগুলো প্রকাশিত না হওয়ায় অনেকেই এই ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিতে পরেন। ফলে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে ইতিহাস বিকৃতির প্রবনতার সৃষ্টি হয়। এই ইতিহাস ভিত্তিক প্রবন্ধে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখিত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ প্রথম ইসলাম প্রচার
১৫ শত শতাব্দীর শেষের দিকে কিশোরগঞ্জের বড় পীর হযরত শাহ ময়েজ উদ্দিন মজনু বা শাহ্ মন্নুন (রঃ) কিশোরগঞ্জে ইসলাম প্রচার করতে এসে কুঁচ রাজার নির্দেশে শহীদ হওয়ার পর অনেক বছর পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে ইলাম প্রচারের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারেনি। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কুঁচ রাজা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এক সময় তাঁর বংশের আর কোন সদস্য জীবিত থাকে না বা থেকে থাকলেও তারা এলাকা ত্যাগ করে। অন্যদিকে এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কুঁচ রাজার মূল বাড়ী সহ তাঁর বাগান বাড়ী হয় ধংশস্তুপ এবং এক সময়ে জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু হযরত শাহ ময়েজ উদ্দিন মজনু বা শাহ্ মন্নুন (র:) এর কবররের স্থানটি এক ধরণের ফুলগাছ দ্বারা চিহ্নিত হয়ে থাকে। এ অবস্থার মধ্যেই সৈয়দ আহাম্মদ (র:) এর আগমন ঘটে রাজাবাড়ীয়া নামের এ স্থানটিতে এবং তিনি পুনঃরায় ইসলাম প্রচার ও ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারে নিজেকে আত্বনিয়োগ করেন।

চিত্র ১. সৈয়দ আহম্মদ (র:) সাহেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শোলাকিয়া সাহেব বাড়ী মসজিদ (প্রথম অবস্থা)

কিশোরগঞ্জে পুনঃরায় ইসলাম প্রচার ও ইসলামের বিকাশ
কিশোরগঞ্জ জেলায় পুনঃরায় ইসলাম প্রচার ও ইসলাম ধর্মের বিকাশে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। পাক-ভারত উপ-মহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের প্রাক যুগ হতেই আরব মুসলমানেরা ধর্ম, রাজনীতি, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই উপ-মহাদেশে এক উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশেষ করে ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলামী দেশসমূহ এবং পরবর্তী মুসলিম শাসকদের আমলে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম এশিয়া ও আরবের মুসলমানেরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কোরআনের ঐশিবাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে দলে দলে এদেশে আগমন করতে থাকেন এবং এই উপ-মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং ইসলামের ঐশিবানী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতির মধ্যে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ২৩ শে জুন বৃটিশ বণিক গোষ্ঠী পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ নামক প্রহসন করে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে সমগ্র ভারত বর্ষে তাদের আধিপত্ত সুপ্রতিষ্ঠিত করে। পলাশী যুদ্ধের পর হতেই ইংরেজ বণিক গোষ্ঠী বিশেষ করে এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ধারায় প্রচন্ড আঘাত হানতে থাকে। ইংরেজ বণিকদের অত্যাচার, নিপিড়ণে অতিষ্ঠ হয়ে ভূ-সম্পতির মায়া ত্যাগ করে অনেক মুসলিম সাধক পুরুষ তখন বিভিন্ন যায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। শোলাকিয়া “সাহেব বাড়ীতে” অবস্থিত মসজিদ এবং শোলাকিয়ার ঐতিহাসিক ঈদগাহের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহম্মদ (র:) সাহেবের পিতা সৈয়দ ইব্রাহীম(র:) সাহেব ইংরেজ বণিকদের এমনি এক নিপিড়ণের শিকার। তিনি ইংরেজ বণিকদের আধিপত্যবাদকে সহজে মেনে নিতে না পারায় বর্তমানে ভারতের বর্ধমান জেলার টেংগাপাড়ায় অবস্থিত তার ভূ-সম্পত্তি হারিয়ে কুমিল্লা জেলায় চলে আসেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সপ্তদশ শতাব্দীর কোন একব সময়ে সৈয়দ ইব্রাহীম সাহেবের পূর্ব পুরুষগণ সুদূর মক্কা শরীফ হতে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইয়েমেন হয়ে এই উপ-মহাদেশে আগমন করে বর্ধমান জেলার টেংগাপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ ইব্রাহীম সাহেব প্রথমে উত্তর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘ কাল পর্যন্ত ধর্মীয় কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন এবং এভাবে একদিন তিনি কিশোরগঞ্জ হতে প্রায় ৭ (সাত) মাইল দূরবর্তী কান্দাইল গ্রামে পদার্পন করেন। পরবর্তীকালে তিনি উক্ত গ্রামের এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু আবদ্ধ জীবন তাঁর বেশী দিন ভাল লাগার কথা নয়। তাই ধর্মীয় কাজ তথা আল্লাহর ঐশীবাণী প্রচারের তাগিদে তিনি আবার বেড়িয়ে পরেন এবং পরিশেষে হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে তাবলীগ জামাত সহ মক্কাশরীফ চলে যান এবং তথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, ঐ সময়ে তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন।
এদিকে মরহুম সৈয়দ ইব্রাহীম (র:) সাহেবের গর্ভবর্তী স্ত্রীর এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। অতঃপর স্বামীর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক পুত্রের নামকরণ ও পরবর্তী সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে শিক্ষার লাভের উদ্দেশ্যে ঢাকার আজিমপুর দায়রাশরীফে ১২ বৎসর বয়সে তাহাকে পাঠানো হয়। বালক পুত্র সৈয়দ আহম্মদ (স:) সাহেব তথায় প্রায় ২৪ বৎসর তদ্বীয় পীরের খেদমতে থেকে শিক্ষা-দিক্ষায় পরিপক্ক জ্ঞান লাভের পর স্বীয় ওস্তাদের নির্দেশে কিশোরগঞ্জ এর বর্তমান শোলাকিয়া গ্রামে ফিরে আসেন এবং এখানে এসে শহীদ শাহ্ মায়েজ উদ্দিন (রহঃ) [মতান্তরে শাহ মন্নুন (রঃ)] সাহেবের মাঝারের নিকট নিজ হুজুরা স্থাপন করতঃ এবাদত বন্দেগীতে আত্মনিয়োগসহ ইসলামের ঐশিবাণী প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
এখানে বলা বাহুল্য যে বিভিন্ন সূত্র থেকে জনাব সৈয়দ আহম্মদ সাহেবের উপস্থিতি সম্পর্কে নিম্নরূপ ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, বর্তমান শোলাকিয়া সাহেব বাড়ী যেখানে অবস্থিত সেস্থানের পূর্বনাম ছিল ‘রাজাবাড়ীয়া’। ১৭শ শতাব্দীর শেষার্ধে জনাব সৈয়দ আহম্মদ সাহেব কিশোরগঞ্জে এসে হাজির হন। তিনি প্রথমে এসে বর্তমান কোট শোলাকিয়া এলাকার এক মুসলিম ভূইয়া পরিবারের বাড়ীতে পৌঁছেন এবং ভূইয়া বাড়ীর লোকজনকে তিনি রাজাবাড়ীয়া পৌছার জন্য সহযোগিতার অনুরোধ জানান। কিন্তু সেই সময়ে ‘রাজাবাড়ীয়া’ ছিল গভীর অরণ্যে পূর্ণ। সেখানে হিংস্র জীব-জন্তুর অস্তিত্ব ছাড়া কোন মানুষের বসবাস ছিল না। কিন্তু সৈয়দ আহম্মদ সাহেবের মন অস্থির ছিল সেখানে যাওয়ার জন্য এবং কোন ভাবেই তাহাকে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করা গেল না। এই গভীর অরণ্যে পীরে কামেল শহীদ হযরত শাহ ময়েজ উদ্দিন মজনু (র:) এর পবিত্র মাজারের আধ্যাত্মিক আকর্ষন তাঁকে প্রতিনিয়ত বিমোহিত করে তুলেছিল। শেষ অবধি অনেক অনুরোধের পর ভূইয়া বাড়ীর লোকজন গ্রামের আরো কয়েকজনকে ডেকে নিলেন সেখানে যাওয়ার সাথী হওয়ার জন্য। সাথে নিলেন দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি আত্মরক্ষামূলক স্থানীয় অস্ত্র। যাওয়া রাস্তা নেই কিন্তু সাথে আছেন আল্ল্াহর এক ওলী যিনি এই অপরিচিত স্থানেও পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করলেন। সাথীদের অশ্বস্ত করার পরও সাথীদের মনে প্রচন্ড ভয় ছিল। কি জানি শেষ অবধি বাঘের শিকার হতে হয় যদি। কিন্তু সৈয়দ আহম্মদ (র:) সাহেব ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং উৎফুল্লতার ছাপ ছিল তার মনে-প্রাণে। সবাই মিলে জঙ্গল কেটে কেটে রাস্তা তৈরী করে এগুতে লাগলেন। হঠাৎ সৈয়দ আহম্মদ সাহেব রাস্তা তৈরী বন্ধ রাখতে অনুরোধ করে জানান। দেখা গেল “গোলাপী পাঁচ পাপড়ী যুক্ত” এক ধরনের ফুল গাছ দ্বারা একখানা কবর চারদিক বেষ্টিত অবস্থায় সম্পূর্ণ চি‎ি‎হ্নত আছে। সৈয়দ সাহেব তার পাশেই হুজরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আল্লআহর প্রতি শোকরিয়া আদায় করেন নফল নামাজ দ্বারা। তিনি তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন যে, তিনি এখানে অবস্থান করবেন। কিন্তু সাথীরা বিস্মিত হন। বিরাট এই অবণ্যে বাঘসহ হিংস্র জীব-জন্তুর অবস্থানের কথা তারা সৈয়দ সাহেবকে জানান। পরিশেষে সাথীরা সৈয়দ সাহেবের সম্মতিক্রমে কবরের সন্নিকটে বাঁশ ও গাছের পাতা দ্বারা একখানা কুঁড়ে ঘর তৈরী করে দেন এবং ছোট মাটির মুচিতে (এক ধরনের মাটির পাত্র) সরিষার তৈল দিয়ে একখানা বাতির ব্যবস্থা করে দেন (মতান্তরে ভেন্নার তেল/কাঠালের কষ)। সৈয়দ সাহেব সাথীদের নিজ নিজ বাড়ী ফিরে যেতে বার বার অনুরোধ জানাতে থাকেন। পরে সাথীরা একত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৈয়দ সাহেবকে এই গভীর অলণ্যের মাঝে এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে রেখে স্ব-স্ব বাড়ীতে চলে যান। সৈয়দ সাহেব এই কুঁেড় ঘরকেই হুজরাখানা হিসাবে ব্যবহার করেন এবং উপাসনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ঐ রাতেই প্রবল বৃষ্টিসহ প্রচন্ড ঝড় হয় এবং তার গতি এমন অকল্পনীয় ছিল যে, জঙ্গলের বিরাট বিরাট গাছ পালাও ভেঙ্গে যায়। এমনকি মাটি থেকে গাছের মূল সহ গাছ উপড়ে যায়। এদিকে ভূইয়া বাড়ীর লোকজনসহ অন্যান্য সাথীরা প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় নিপতিত হন এবং তারা ধারণা করেন যে সৈয়দ সাহেব হয়তো বেঁচে নেই। তাঁরা ধারণা করেন যে তিনি হয় ঝড়ে না হয় বাঘের আক্রমনের শিকার হয়েছেন। পরদিন খুব ভোরে পূর্বদিনের সাথীরা একত্রিত হয়ে আবার আগের দিনের ন্যায় আত্মরক্ষার স্থানীয় অস্ত্রসহ “রাজাবাড়ীয়া”র দিকে রওনা হন। রাজাবাড়ীয়া পৌঁছে সকলেই স্তম্ভিত হন। সবাই দেখতে পান যে সৈয়দ সাহেবের ছোট্ট ঘরটিতে বাতি জ্বলছে আর তিনি এক বিশেষ ধরনের তসবীহ যা “সোলেমানী তসবীহ” নামে পরিচিত তাতে তিনি খোদার নাম নিচ্ছেন অর্থাৎ তিনি আজিফায় মগ্ন আছেন। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলেই বিশ্মিত হন এবং বুঝতে বাকী নেই যে সৈয়দ সাহেব সাধারণ মানুষ নন, তিনি প্রকৃতপক্ষেই আল্লার ওলী। পরে তাৎক্ষণিকভাবে আগত সাথীরা সৈয়দ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ বা মুরীদ হওয়ার জন্য আবেদন জানান। সৈয়দ সাহেব এতে সম্মত হন এবং সকলকে শিষ্যত্ব দান করেন। উল্লেখযোগ্য যে, এরই মধ্যে ময়মনসিংহে ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার (১৯৭৮) অনুযায়ী ১৭৭১ সালে মজনু শাহ এর নেতৃত্বে ফকির আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৭৯০ সাল পর্যন্ত উক্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকে। উক্ত ফকির আন্দোলন ছিল বৃটিশ বা কোম্পানী বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু কোন হিন্দু জমিদার উক্ত আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেননি বরং তাঁরা সরকার তথা ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। জানা গেছে কিশোরগঞ্জ এর ফকির-দরবেশদের নিয়ে সৈয়দ আহাম্মদ (র:) সাহেব তাঁর নেতৃত্বে উক্ত ফকির আন্দ্রোলনেও আংশগ্রহণ করেন।
এদিকে ক্রমে ক্রমে সৈযদ সাহেবের আধ্যাত্বিকতা ও গুণ-জ্ঞানের কথা চতুর্দিকে ছড়াতে থাকে এবং দলে দলে লোকজন তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। ঐ সময় ঈশা খাঁর বংশধরগণ জংগলবাড়ী এবং হয়বতনগরে জমিদারী করছিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই উভয় জমিদারবৃন্দ সৈয়দ সাহেবকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে উভয় জমিদারবৃন্দ সৈয়দ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এমনি এক পর্যায়ে তাহাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় সৈয়দ আহম্মদ (স:) সাহেব ইসলাম প্রচারে নিজেকে আত্বনিয়োগ করেন। এরই মধ্যে সৈয়দ সাহেব শহীদ শাহ্ ময়েজ উদ্দিন মজনু মতন্তরে শাহ্ মন্নুন (রঃ) এর মাজারের চতুর্পাশ্বের ভূমিসহ কিশোরগঞ্জের বেশ কয়েকটি তালুকের মালিক হন।

চিত্র ২ ও ৩. ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ও মাঠে নামাজের জন্যে আগত মুসল্লীবৃন্দের একাংশ

উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে এতদঅঞ্চলে কোন মসজিদ ছিল না। তাই তিনি জঙ্গলের গাছপালা দিয়ে তৈরি একটি অস্থায়ী অবকাঠামো স্থাপন করে ১৮ শত শতকের প্রথম দিকে একটি মসজিদ তৈরি করে পাঁচওয়াক্ত নামজ মসজিদে পড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে সৈয়দ সাহেব স্বীয় প্রচেষ্টায় নিজ বাড়ীতে ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে একটি স্থায়া অবকাঠামো স্থাপন করে

চিত্র ৪ ও ৫. ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে নামাজরত মুসুল্লীবৃন্দ

স্থায়ীভাবে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাহার লিখিত দলিল মোতাবেক উক্ত মসজিদ এতদঅঞ্চলের সর্ব প্রথম মসজিদ বলে জানা যায়। তাঁর লিখিত দলিল মতে এও জানা যায় যে, তিনিই এ অঞ্চলের জুমার নামাজের প্রথম প্রবর্তন করেন বা তিনিই সর্ব এ অঞ্চলে প্রথম জুমার নামাজ শুরু করেন এবং ১০ জন মুসল্লী বিভিন্ন স্থান থেকে এই মসজিদে এসে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। এরই মধ্যে সৈয়দ সাহেব গুজাদিয়ার জনৈক হিন্দু জমিদারের নিকট থেকে “চন্দ্র নারায়ন” নামের একটি তালুকি সম্পত্তি ৪ (চার) আনা হিস্যা ক্রয় করেন। এদিকে সৈয়দ সাহেবের শিষ্য সংখ্যাা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সৈয়দ সাহেব ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায়ের প্রয়োজন অনুভব করেন এবং মসস্থির করেন যে তাহার ক্রয়কৃত তালুকি সম্পত্তিকে ঈদগাহ মাঠে রূপান্তর করবেন। বিষয়টি হয়রবতনগর এর তৎকালীন জমিদার সাহেবকে জ্ঞাত করেন এবং তাহার নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা চান। এ ব্যাপারে হয়রবতনগর এর জমিদার প্রস্তাবটি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং জংগলবাড়ীর জমিদার সাহেবকে এতে সহায়তা দানের জন্য অনুরোধ জানান। সৈয়দ সাহেব উভয় জমিদার সাহেবকে প্রস্তাবিত ঈদগাহে আসন্ন ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাতে শরিক হওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। উভয় জমিদার মহোদয়বৃন্দ দাওয়াত কবুল করেন। হয়বতনগরের জমিদার সাহেবও আসন্ন ঈদের জামাতে শরীক হওয়ার জন্য জংগলবাড়ীর জমিদার সাহেবকে দাওয়াত করেন। উভয় জমিদার মহোদয়গণ এই অঞ্চলের অধিকাংশ লোকজন সহ প্রস্তাবিত ঈদাহে উপস্থিত হন। ১৮২৮ খৃষ্টাব্দের ঈদুল ফিতরের সেই দিনেই উভয় জমিদারবৃন্দের উপস্থিতিতে সৈয়দ সাহেব প্রতিষ্ঠিত করলেন এই উপ-মহাদেশের সর্ব বৃহৎ ঐতিহাসিক “শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ” এবং সৈয়দ সাহেবের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হল ঈদের প্রথম জামাত।
(চলবে)…..

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন