শিল্পাঞ্চলে নদী দূষণ
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD) লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ শিল্পাঞ্চলে নদী দূষণ। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন জনাব হিমাংশু শেখর সূত্রধর, সহকারী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ , বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, এবং জনাব মোঃ মাহবুবুর রহমান, প্রভাষক, রসায়ন বিভাগ, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মোস্তাফিজুর রহমান, পরিচালক, এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ১৫/০৫/২০২৫ তারিখ রাত ০৮:০০ টা থেকে ৯.০০ মিনিট।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ আজকের আলোচনার বিষয় হল শিল্পাঞ্চলে নদী দূষণ। আমি প্রথমে হিমাংশু সাহেবের কাছে আসবো। আপনার কাছে আমি জানতে চাচ্ছি, বাংলাদেশের নদী দূষণ সম্পর্কে আপনি সংক্ষিপ্ত করে কিছু বলবেন?
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ চলতি ২০২৫ সালে ৪৬তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ চলছে। আমাদের একটি বিজ্ঞানমেলায় আমাকে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, আমরা আমাদের জুনিয়র সহকর্মী জনাব মাহবুব সহ আমরা ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে একটি সমীক্ষা করেছিলাম। আমাদের মফস্বল ভিত্তিক শিল্পায়ন অর্থাৎ আমাদের হবিগঞ্জ জেলার ওলিপুর অঞ্চলে যে সব ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে সেখানকার বর্জ্যগুলো পরিবেশের সাথে মিশে যাচ্ছে, বিশেষ করে ঐ অঞ্চলের একটি নদী সুতাং নদীতে, আরেকটি সংযুক্ত খাল শৈলজোড়া খালে।
যারা পরিবেশ আন্দোলনে জড়িত আছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছেন। আমাদের হঠাৎ ইচ্ছা হল, ওই অঞ্চলে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে কিছু নমুনা সংগ্রহ করি। ভূমিকা একটু দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে হয়তো, তবে বলছি, সরকারি কলেজ হিসেবে আমাদের যে ল্যাব, সেখানে রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করার মত আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। তারপরও আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে আমরা নদী দূষণের কিছু প্যারামিটার নিয়ে কাজ করেছি।
বিশ্বব্যাপী কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক প্যারামিটার আছে , তার মধ্যে ৪/৫টি গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে থেকে ২/৩টি প্যারামিটার নিয়ে আমরা কাজ করেছি, যেমন:
- পানির pH
- পানির কন্ডাক্টিভিটি
- TDS (Total Dissolved Solids)
- DO (Dissolved Oxygen)
মূল ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিভিন্ন দূরত্বে তিনটি সেম্পল সংগ্রহ করেছিলাম। একটি ৫০০ মিটার দূরে, একটি ১০০০ মিটার, এবং একটি ১৫০০ মিটার দূরে। ওই স্যাম্পলগুলো রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করে যে রেজাল্ট পেয়েছি, তা অত্যন্ত ভয়াবহ।
বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই “ডিজল্ভ অক্সিজেন” (DO) নিয়ে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ যদি WHO-এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী না থাকে, তাহলে সেখানে জলজ প্রাণী টিকে থাকার কথা নয়। WHO অনুযায়ী DO-এর মান হওয়া উচিত ৬.৫ থেকে ৮.৫ ppm। যদি ৪ থেকে ৬ ppm হয়, তখন মাছের টিকে থাকা কঠিন হয়। আর যদি ২ থেকে ৩ ppm হয়, তাহলে মাছের বেঁচে থাকা, বৃদ্ধি, প্রজনন একেবারেই কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের নমুনা বিশ্লেষণে যা পেয়েছি:
- একটি স্যাম্পলে DO = ১.৪ ppm
- আরেকটিতে DO = ২.১ ppm
- তৃতীয়টিতে DO = ২.৭ ppm
অর্থাৎ, সবগুলোই মাছের জন্য মারাত্মক। সেই অঞ্চলের পানিতে এখন আর মাছ পাওয়া যাবে না, পাওয়া গেলেও তার বর্ণ, গন্ধ কিছুই স্বাভাবিক নয়।
আমরা প্রবন্ধের শেষে বলেছি যে, একটা নদীর পানি দূষিত কিনা, তা বুঝতে বিজ্ঞানীর দরকার নেই। একজন সাধারণ মানুষও যদি নদীর পাশে দাঁড়িয়ে তার গন্ধ সহ্য করতে না পারে, তার রঙ দেখে যদি অস্বস্তি হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে নদীটি বিষাক্ত। তার ভেতরে থাকা জলজ প্রাণীদের অবস্থা কতটা খারাপ, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মাহবুবুর রহমানঃ বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে প্রায় ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শাখা-প্রশাখাসহ মোট নদীর সংখ্যা ২০০ থেকে ৪০০-এরও বেশি। একটি নদীমাতৃক দেশের টিকে থাকার জন্য এর নদীগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। নদী রক্ষা না করতে পারলে, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
নদী দূষণ রোধে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। আমরা আমাদের গবেষণায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার বিশ্লেষণ করেছি, যেমন:
- pH এর মান:
শিল্পাঞ্চল-ঘেঁষা এলাকাগুলোর নদীর PH এর মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এর জন্য দায়ী দুটি প্রকারের কারণ রয়েছে, যথা:- প্রাকৃতিক কারণ
- শিল্পায়নজনিত কারণ
শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরণের অ্যাসিড জাতীয় বর্জ্য কোনও ধরণের ট্রিটমেন্ট ছাড়াই সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর পানির PH মান হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়াও, বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত গ্যাস যেমন:
- ফ্রিজ, এসি, যানবাহনের ধোঁয়া
- কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং CFC গ্যাস
এই গ্যাসগুলো গ্রীনহাউস ইফেক্ট তৈরি করে, যার ফলে এসিড বৃষ্টি (Acid Rain) হয় এবং এর প্রভাবে নদীর PH আরও কমে যায়। pH কমে যাওয়ার ফলে নদীতে থাকা জলজ প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ এখন হুমকির মুখে। তাদের জীবিত থাকার পরিবেশ ক্রমাগত নষ্ট হচ্ছে।
- DO (Dissolved Oxygen):
DO হচ্ছে এমন একটি উপাদান যা জলজ প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এটি পানি থেকে প্রাণীরা অক্সিজেন গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। DO-এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে জলজ প্রাণীগুলোর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। - TDS (Total Dissolved Solids):
আমরা গবেষণায় TDS নির্ণয় করেছি। যদি TDS-এর মান খুব বেশি হয়, তাহলে নদীর পানির মান খারাপ হয় এবং দূষণ বেড়ে যায়। - BOD (Biological Oxygen Demand) এবং COD (Chemical Oxygen Demand):
এই দুটি প্যারামিটার পরিবেশ রসায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি আমরা এই দুটি বিষয় আমাদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারতাম, তাহলে গবেষণাটি আরও ফলপ্রসূ ও সম্পূর্ণ হত।
আমরা দেখতে পেয়েছি, ঢাকার আশে পাশের নদীগুলো, যেমন বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে সেখানে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে। এমনকি এই নদীর পাশে দাঁড়ানোও এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ আমরা ভাবি, শিল্পের কারণেই নদী দূষণ হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো শুধুমাত্র শিল্প নয়, গৃহস্থালি বর্জ্যও বড় কারণ।ঢাকার চারপাশের নদীগুলো, যেমন: তুরাগ, বুড়িগঙ্গা নদী সবগুলোই প্রায় প্রাণহীন হয়ে গেছে। মূলত কোন শিল্প বেশি দায়ী? ট্যানারি, টেক্সটাইল, নাকি প্লাস্টিক?
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ মূলত দূষণের ধরণ দুই রকম:
- BOD (Biochemical Oxygen Demand): গৃহস্থালির জৈব বর্জ্য, যেমন:মানুষের মলমূত্র, রান্নাঘরের ময়লা ইত্যাদি।
- COD (Chemical Oxygen Demand): রাসায়নিক বর্জ্য ট্যানারি, যেমন: টেক্সটাইলের বর্জ্য ইত্যাদি।
COD সবসময় বেশি হয়: কারণ রাসায়নিক দূষণ বিশুদ্ধ করতে অক্সিজেনের চাহিদা বেশি। উদাহরণস্বরূপ: ট্যানারি বর্জ্যে ক্রোমিয়াম সালফেট ব্যবহার হয় যা একটি ভারী ধাতু।
ভারী ধাতুর প্রভাব:
- ল্যাড, ক্রোমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক ইত্যাদি পানির মাধ্যমে জমিতে পৌঁছায়।
- কৃষকরা দূষিত নদীর পানি দিয়ে ফসল উৎপাদন করছে, ফলে ফসলের মধ্যে এই বিষাক্ত ধাতুগুলো ঢুকে যাচ্ছে।
- এগুলো মানবদেহে গিয়ে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ সৃষ্টি করছে।
একটি বাস্তব উদাহরণ: ওলিপুরের শিল্প এলাকা অন্তর্ভুক্ত রাজিউরা ইউনিয়নে উৎপাদিত ২৫% সবজি স্থানীয় বাজারে যাচ্ছে। সেই ফসল সুতাং নদীর দূষিত পানি দিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে যার প্রভাবে স্থানীয় জনগণ স্বাস্থ্যে ঝুকিতে পড়ছে।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, বিশেষত হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিজ উৎপাদনে পরিবেশগত দূষণের প্রভাব কীভাবে পড়ছে, এটা গবেষণার দাবি রাখে। এই প্রভাব কাঁচা পণ্যের উপর কতটা, সেটা আমাদের জানতে হবে।
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ আপনার এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন সিলেট থেকে ঢাকার দিকে যাত্রা করি এবং নরসিংদী এলাকায় পৌঁছাই, তখন সড়কের পাশে থাকা কল-কারখানাগুলো থেকে যে গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে তা সহ্য করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এই গন্ধ শুধু অস্বস্তিকরই নয়, এটি এক ধরণের বিপদ সংকেত। আমরা জানি যে শিল্পায়ন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ, কিন্তু একই সঙ্গে যদি সেই শিল্প কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক না হয়, তাহলে তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যাবে না, তাই আমাদের আজকের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত “সবুজ শিল্পায়ন” অর্থাৎ গ্রীন কেমিস্ট্রি ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিল্প মালিক, শ্রমিক, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ মানুষ সবার অংশগ্রহণ ও সচেতনতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ এটা সরকার এবং শিল্পপতিদের যৌথ দায়িত্ব যে, তারা যেন পরিবেশবান্ধব ও জনস্বাস্থ্য সম্মত উৎপাদন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সাধারণ জনগণেরও জানার অধিকার আছে, আমাদের খাদ্যপণ্য কীভাবে উৎপাদিত হচ্ছে, এবং তাতে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কিনা। যেমন, আমরা প্রায়ই শুনি ফার্মের মুরগি খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু কী ধরনের ক্ষতি? সেটি নিয়ে গবেষণা ও তথ্য সরবরাহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনাব মাহবুব সাহেব, এই দূষণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর কী ধরণের ঝুঁকি তৈরি করছে?
মাহবুবুর রহমানঃ পরিবেশ বলতে যা বুঝি, তা হচ্ছে আমাদের চারপাশের সবকিছু, যেমন: মাটি, পানি, বাতাস, প্রাণী, উদ্ভিদ এরা সবই পরিবেশের অংশ। শিল্পকারখানা থেকে বিশেষ করে ট্যানারি, প্লাস্টিক এবং ডাইং শিল্প থেকে যে বর্জ্য নির্গত হয়, তার মধ্যে রয়েছে হেভি মেটাল, যেমন: ক্রোমিয়াম। এই উপাদান যদি পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, তা ক্যান্সারসহ নানা রোগের জন্ম দিতে পারে, যেমন: চর্মরোগ, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ট। আমার মাস্টার্স থিসিসে আমি চিংড়ি বা কাঁকড়ার খোলস থেকে ‘কাইটোসিন’ এক্সট্রাক্ট করেছি এবং তার ব্যবহার করে ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধনের চেষ্টা করেছি। হাজারীবাগের ট্যানারির বর্জ্য নমুনা সংগ্রহ করার সময় আমি দেখেছি, সেই বর্জ্যের রঙ, গন্ধ ও রাসায়নিক গুণগত মান অত্যন্ত খারাপ, পানি ছিল গাঢ় নীল, দুর্গন্ধ এত বেশি যে, আমি দ্বিতীয়বার আর সেখানে যেতে পারিনি। আমার গবেষণায় দেখা গেছে, এই বর্জ্যে BOD (Biological Oxygen Demand) ও COD (Chemical Oxygen Demand) ছিল অত্যন্ত উচ্চমাত্রায়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্প কারখানা নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে, কারণ, পানি সহজলভ্য ও পরিবহন করা সহজ। কিন্তু এসব কারখানা যদি তাদের তরল বর্জ্য যথাযথভাবে পরিশোধন না করে নদীতে ফেলতে থাকে, তবে এটি শুধু পরিবেশ নয়, সামগ্রিকভাবে আমাদের জলবায়ুর জন্যও একটি বড় হুমকি।
বিশ্বে এখন ‘পরিবেশ বাঁচাও’, ‘নদী বাঁচাও’ আন্দোলন হচ্ছে, বাংলাদেশেও একইভাবে আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা এবং আইনের বাস্তবায়ন। ইটিপি (Effluent Treatment Plant) স্থাপন বাধ্যতামূলক হলেও অনেক কারখানাই তা মানছে না, বা সঠিকভাবে পরিচালনা করছে না। এই অনিয়মের ফলে আমরা প্রকৃতির ভারসাম্য হারাচ্ছি, নদীতে আগের মত মাছ নেই, অক্সিজেন স্বল্পতায় মাছ মরে ভেসে উঠছে। নারায়ণগঞ্জসহ অনেক জায়গায় এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। আমার মতে, পরিবেশ রক্ষায় সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, আইনের কঠোর প্রয়োগ, শিল্প মালিকদের দায়িত্ববান হওয়া, এবং জনগণের সচেতনতা। তাহলেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারবো।

মোস্তাফিজুর রহমানঃ জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রেক্ষাপটে আজ যে বিষয়গুলো আলোচ্য হচ্ছে, সেগুলোই আসলে বড় এলার্মিং সিগন্যাল হিসেবে কাজ করছে। শিল্পাঞ্চলগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু এর কারণে যেভাবে নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটি আমাদের জন্য বড় হুমকি। সুন্দর-সুন্দর নদীগুলোতে আজ অদ্ভুত এক অবস্থা, এ নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, নদীগুলো বাঁচাতে হবে, আবার একই সাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও বাঁচাতে হবে। তাহলে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখা যায়? আপনার এই বিষয়ে কি মতামত?
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ ভারসাম্য করার আগে অবশ্যই সদিচ্ছা থাকতে হবে। যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে সমাধান অনেক সহজ। আমি বলেছি, আপনি যদি একজন শিল্প মালিক হন, হয়তো এখন এটা আপনাকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু যদি আপনার মনের মধ্যে একটা বুদ্বুদ জাগ্রত হয় যে, এই দূষণের প্রভাব আপনার নিজের সন্তানদের ওপর পড়বে, দূষিত নদীর মাছ আপনি নিজের বাসায় খাচ্ছেন, তখন বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। দূষণ বা পরিবেশের ক্ষতি কোনো ধনী-গরিবের ফারাক করে না; এটি সবার ওপরই প্রভাব ফেলে। আমাদের উচিত মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে শ্রমিক, এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই সচেতন হওয়া। আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু নির্দেশনা ও আইন আছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন যথাযথ হচ্ছে না। কোথাও না কোথাও গাফিলতি, ঘাপটি পড়েছে। আমি এখানে একটি বিষয়ও তুলে ধরতে চাই যে, আমরা স্যাম্পল সংগ্রহ করেছি বর্ষাকালীন সময়ে। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানির প্রবাহের কারণে কিছু দূষণ স্বাভাবিকভাবেই নদীতে কমে যায়। তবে, যদি শুষ্ক মৌসুমে স্যাম্পল নেওয়া হয়, তখন দূষণের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
আমি নিজে একজন সাধারণ মানুষ, ছোট শহরে বাস করি। এখানে শিল্প রয়েছে যেগুলো কিছু কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ করে সেই শিল্প বন্ধ করা সম্ভব নয়, এবং তাও আমরা চাই না। তবে এর মানে এই নয় যে আমরা শিল্পের নামে সবকিছু চোখ বন্ধ করে দেখতে পারি। শিল্প মালিকদের অবশ্যই আরও সচেতন হতে হবে। যদি তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে, সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে তারা বর্জ্য পরিশোধনের জন্য যথাযথ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করুক। এটা ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু দেশের উন্নয়নের জন্য এটাকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতেই হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা আজ বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে নানা অবকাঠামো গড়ে তুলছি। কেন এই ঋণ থেকে একটি অংশ শিল্পাঞ্চলের পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা যাবে না?
বর্জ্যকে সঠিকভাবে পরিশোধন করে পরিবেশে ছাড়তে হবে বা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পুনর্ব্যবহার বা নতুন কোনো শিল্প গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করাও জরুরি। অর্থাৎ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে একটি নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে নিতে হবে।
ভারসাম্যের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে, আর সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ ‘Polluter Pays Principle’ অর্থাৎ যে দূষণ করে, সেই খরচ বহন করবে-এই নীতিমালা বা যুক্তির সঙ্গে আপনি কতটুকু একমত? মূলত, দূষণকারী ফ্যাক্টরির মালিককে কি এটার দায়ভার নিতে হবে এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য পে করতে হবে? এটা কতটুকু সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ মালিকপক্ষের মধ্যে বোধ এবং সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, আমরা এখানে স্কয়ার ইন্ডাস্ট্রি বা মেক্সিকো ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের কথা বলছি, যারা আর্থিকভাবে সক্ষম। তাদের কাছে যথেষ্ট ক্ষমতা এবং সম্পদ আছে পরিবেশ রক্ষা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য। আপনি যেটা বললেন, যে আইন-কানুন, নিয়ম-কানুন এবং নৈতিকতার আওতায় যিনি দূষণ করছেন, তাকে তার দায়ভার বহন করতে হবে ,আমি এটাই বলতে চাই। কিন্তু শুধু মালিকদের দায়িত্ব দিয়ে সমাধান হবে না। আমি চাই শ্রমিকদের কথাও বলা হোক। যারা ওই শিল্পের মাধ্যমে তাদের সংসার চালাচ্ছে, যারা নদীর পার্শ্বে বসবাস করছে, তারাও এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত। শ্রমিকরাও নদী দূষণের বিরূপ প্রভাবের শিকার। তাই তাদের মধ্যে অবশ্যই এই বিষয়ে সচেতনতা থাকা উচিত। যেন তারা বুঝতে পারে, যে বিপদ ও ভয়াবহতা আমরা আলোচনায় আনছি, তা শুধু মালিকদের নয়, তাদেরও মাথায় বসে। আমাদের সবারই কিছুটা দায়িত্ব রয়েছে, কারণ আমরা সবাই এই শিল্পে শ্রমিক হিসেবেই যুক্ত আছি। তাই মালিক থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যায় পর্যন্ত সবাইকে একসাথে নিয়ে আসা দরকার। আর্থিক প্রণোদনা হোক বা সদিচ্ছা, সবকিছুই যেন জাগ্রত হয় এবং সবাই কাজ করে। যদি আন্তরিক সদিচ্ছা থাকে, তাহলে অর্থায়ন বা অর্থসংস্থানের কোনো অভাব হবে না। অর্থাৎ, মালিক এবং শ্রমিক উভয়ের মধ্যেই সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ তৈরির মাধ্যমে নদী দূষণ রোধ করা সম্ভব।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ জনাব মাহবুব একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি কী ভাবছেন, আপনার কি মনে হয় নদী এবং পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা স্কুল এবং কলেজ লেভেল থেকে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন?
মাহবুবুর রহমানঃ অবশ্যই, নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক শিক্ষা স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বাধ্যতামূলক করা উচিত। পরিবেশের মধ্যে নদী, বায়ু, শব্দ দূষণসহ বিভিন্ন দূষণের প্রকৃতি এবং দূষণ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা যত তাড়াতাড়ি জানবে, তাদের মধ্যে তত দ্রুত সচেতনতা তৈরি হবে। সচেতনতা শুধু শিক্ষিত সমাজেই নয়, সমাজের নিম্নবিত্ত ও কম শিক্ষিত অংশেও সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ অনেক সময় সচেতনতা ও শিক্ষা না থাকার কারণে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পায়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং একই সাথে আমাদের সবার দায়িত্ব।
এখানে মূলত তিনটি বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়েছে:
১. পরিবেশ শিক্ষাকে সব শিক্ষার স্তরে বাধ্যতামূলক করা,
২. দূষণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা প্রদান,
৩. সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া যেন সমাজের সব স্তরে পৌঁছে যায়, বিশেষ করে কম সুবিধাপ্রাপ্তদের মধ্যে।
যে কোনো জাতির দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ আমি আসলে আমার আগের প্রশ্নের কথা তুলে ধরেছি, যেখানে বলেছিলাম যে শুধু স্কুল-কলেজ পর্যায়ে সচেতনতা নয়, স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণও দরকার। কারণ পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় জনগণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ অনেক সময় স্থানীয় জনগণের মধ্যেও নেতাদের দায়িত্বহীনতা ও স্বার্থান্বেষণ থাকে। যেমন: হোমরা- চুমড়া প্রতিনিধি আছেন, যারা নিজের এলাকায় দূষণ ঘটাতে পারে। যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এবং সৎ নেতৃত্ব থাকতো, তাহলে এই দূষণ রোধ করা সম্ভব হতো। এটা অনেক সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ঘটে, যেখানে কেউ কেউ নিজের স্বার্থ পূরণে দ্রুত এগিয়ে যায়।
মাহবুবুর রহমানঃ সচেতনতা ছড়ানোর ব্যাপারটি ছোট থেকে বড়, সমস্ত মহলে ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র একাডেমিক পদ্ধতিতে নয়, বিভিন্ন সমাবেশ, পরিবেশ বিষয়ক সভা, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা উচিত। এসব প্রোগ্রাম মানুষকে জানান দেয়, নদী কীভাবে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে, কেন আগের মতো মাছ আর প্রাণবন্ততা নেই-এই সচেতনতা বাড়ানো সবচেয়ে বড় কাজ। সচেতনতা বৃদ্ধি করাই পরিবেশ রক্ষায় প্রথম ধাপ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আইনগত ব্যবস্থা। আমরা যে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুপারিশ করেছি তা যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে ব্যাপক সুফল আসবে। বিশেষ করে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে:
- দূষণমুক্ত পানির ভাণ্ডার সংকুচিত হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে।
- বিশ্বের অনেক দেশে পানির দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন আছে, বাংলাদেশেও তা থাকা প্রয়োজন।
- পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া কেউ জলজ পরিবেশে তরল বা কঠিন বর্জ্য ফেলতে পারবে না।
- প্রযুক্তিগতভাবে বর্জ্য বিশোধন করা সম্ভব, ইনফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপন করে বর্জ্য পানি বিশোধন করা যায়, যা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা যায়।
- পৌরসভা, হাসপাতাল, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জ্য পানি কালবিল বা নদীতে ফেলার পরিবর্তে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্টে প্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
- ব্যক্তিগতভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ডিটারজেন্ট কম ব্যবহার এবং ময়লা-আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা উচিত।
- রাসায়নিক দ্রব্যের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দূষণ রোধ করা সম্ভব।
এই সব উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমরা পরিবেশ রক্ষায় এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারবো।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন কি ধরনের ব্যবহার আমাদের দেশে কার্যকর করা যেতে পারে? অর্থাৎ আমাদের এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে সুন্দর পানি আমরা কিভাবে পেতে পারি, নদীরা কিভাবে বাঁচতে পারে?
মাহবুবুর রহমানঃ মাহবুব, যেটা বললেন, ইটিপি—যা শিল্প বর্জ্য পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়—সেটা আধুনিক প্রযুক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে অবশ্যই আর্থিক বিষয়গুলো আছে, আমি জানি না কতটুকু অর্থের ব্যবস্থা দরকার হবে। মূল কথা হচ্ছে, বর্জ্য বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট গুলো ঠিক সেই শিল্পের পাশে বা এলাকায় স্থাপন করতে হবে, যাতে দূষিত পদার্থগুলো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধ করা যায়। প্রক্রিয়াকরণের পরে যে নির্যাস থাকে, সেটাকে আমরা নদীতে ফেলা যেতে পারে অথবা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারি। এতে নদীর দূষণ অনেক কমে যাবে।
তবে সমস্যা হলো, অনেক শিল্প এখনো নামমাত্র ইটিপি ব্যবহার করে, এবং পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সার্টিফিকেট নিয়েও অনেক সময় নিয়ম ঠিকমতো মানা হয় না। একটা সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, যার কারণে দূষণ রোধে কার্যকর কাজ হচ্ছে না। বুড়িগঙ্গা নদীতে নতুন ধরনের মাছ “সাকার” দেখা যায়, যা অন্যান্য দেশীয় মাছের পরিবর্তে টিকে আছে। কিন্তু এই মাছটা দূষিত পরিবেশে থাকার কারণে মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। আর্থিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং উন্নত বিশ্বের বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্রযুক্তি অনুসরণ করে আমাদের দেশে মানসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ নদীর বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) ও দূষণ প্রতিরোধে সরকারের করণীয় কী হওয়া উচিত বলে আপনারা মনে করেন?
মাহবুবুর রহমানঃ আমি যে সুপারিশগুলো করবো সেগুলো হলে-
- দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, শুধু মুখে নয়, বাস্তব একশন নিতে হবে।
- যেসব শিল্প কারখানায় ইটিভি (Effluent Treatment Plant) নেই এবং যাদের থেকে দূষণ সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে, তাদেরকে আল্টিমেটাম দিতে হবে।
- নতুন কোনো শিল্প কারখানাকে অনুমোদন দেওয়ার আগে বাধ্যতামূলক করতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপন।
- এই পদক্ষেপগুলো যদি সরকার কার্যকরভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করে, তাহলে অনেকাংশে নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
হিমাংশু শেখর সূত্রধরঃ
- শুধু আইন থাকা বা পদক্ষেপ নেওয়া যথেষ্ট নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে সততা (অনেস্টিটি) থাকা অত্যন্ত জরুরি।
- দুর্নীতি এবং অসৎ আচরণ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, তাই এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; কারণ প্রকৃতি রক্ষা করা জনগণের স্বার্থে, আর জনগণেরই প্রকৃত প্রতিনিধি হওয়া উচিত।
- পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সততা বজায় রেখে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি।
মোস্তাফিজুর রহমানঃ দেশের নদীগুলো আমাদের সবারই অমূল্য সম্পদ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেগুলোকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। যদিও বাংলাদেশে প্রতিবেশী দেশ থেকে অনেক নদী প্রবাহিত হয়, তবুও নদীর দূষণের মূল উৎস আমাদের দেশের ভিতরেই সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় বড় বড় শিল্প কারখানা বা ফার্মগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুমোদন গ্রহণের চেষ্টা করে এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি বা অনিয়মের কারণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতে নদীর বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আমরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার হরণ করছি। নদীগুলোর দূষণ শুধু শিল্প কারখানার কারণে নয়, অনেক ক্ষেত্রে মানুষের গৃহস্থালী বর্জ্য ও আবর্জনার কারণে হচ্ছে। তাই পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের সততা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনগণের সচেতনতা একসঙ্গে জরুরি। যদি এসব বিষয় যথাযথভাবে পরিচালনা না করা হয়, তাহলে আমাদের দেশের নদী ও পরিবেশের জন্য একটি অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করবে। আপনাদের দুজনকে অনেক ধন্যবাদ।