উন্নয়ন আলোচনা পর্ব-২০

ndicia24

একুয়াকালচারে প্রযুক্তির ব্যবহারঃ ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা

এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD) লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ একুয়াকালচারে প্রযুক্তির ব্যবহারঃ ভবিষ্যতের পথনির্দেশনাআলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন পিএইচডি, অধ্যাপক, ফিশারিজ এন্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ড. মো. আসাদুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক, মেরিন বায়োরিসোর্স সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয় আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ০৮/০৫/২০২৫ তারিখ রাত ০৮:০০ টা থেকে ৯.০০ মিনিট।

মাসুদ সিদ্দিকঃ অনেকেই “অ্যাকুয়াকালচার” শব্দটির সঙ্গে হয়তো এখনো পরিচিত নন। ড. মামুন, আপনি কি আমাদের একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন, অ্যাকুয়াকালচার কী? এটি কি শুধুই মাছচাষ, না কি এর আওতা আরও বিস্তৃত?

. আব্দুল্লাহ আল মামুনঃ আসলে, মাছচাষ,বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি তুলনামূলকভাবে নতুন ধারণা। যদিও “মাছে ভাতে বাঙালী” কথাটি আমাদের সংস্কৃতির একটি চিরচেনা উপাদান, তবে মাছ চাষ করে মাছ খাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে অতীতের তুলনায় অনেক পরবর্তীকালে বিস্তার লাভ করেছে। মনে হয়, দুই প্রজন্ম আগেও এটি খুব পরিচিত ধারণা ছিল না। ১৯৯০ সালের দিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) অ্যাকুয়াকালচারের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়। তাদের মতে, অ্যাকুয়াকালচার হলো ‘জলজ পরিবেশে বাস করা প্রাণী যেমন মাছ, চিংড়ি, কুঁচিয়া ইত্যাদির পরিকল্পিত চাষ, ব্যবস্থাপনা এবং কর্তৃত্বাধীনভাবে আহরণ’। এখানে “কর্তৃত্ব” শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, আপনার পুকুরে মাছ ছাড়লেন, খাবার দিলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো আহরণ করলেন, এটি অ্যাকুয়াকালচার। কারণ এখানে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব আপনার। কিন্তু যদি আপনি খাল বা নদীতে মাছ ছাড়েন এবং পরে তা আহরণ করতে যান, সেখানে হয়তো কমিউনিটির অন্যান্য সদস্যরাও একই মাছের ওপর অধিকার দাবি করবে। সে ক্ষেত্রে এটি আর ‘অ্যাকুয়াকালচার’ থাকছে না, বরং ‘ফিশারিজ’-এর আওতায় পড়ে। তাই, অ্যাকুয়াকালচার ও ফিশারিজের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো ‘নিয়ন্ত্রণ’ বনাম ‘প্রাকৃতিকতা’। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে-, অ্যাকুয়াকালচার হলো, যেমন: আপনি গরমকালে এসি চালিয়ে ঠান্ডা নিচ্ছেন, মানে আপনি ইনপুট দিচ্ছেন এবং তার বিনিময়ে সুনির্দিষ্টভাবে আউটপুট পাচ্ছেন। আর ফিশারিজ হলো, আপনি জানালা খুলে রেখেছেন- মুক্ত বাতাস আসবে, তবে কখন আসবে, কতটুকু আসবে, সেটি আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা মূলত  খাল-বিল, নদী, হাওর, বাওর ও সমুদ্র থেকে প্রাকৃতিকভাবে মাছ আহরণ করতেন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের প্রথম জীবিকার পদ্ধতি ছিল “হান্টিং” অর্থাৎ শিকার বা আহরণ। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই হান্টিং বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু মাছ আহরণের হান্টিং এখনো চলছে। নিম্নপর্যায়ে কেউ হাত দিয়ে মাছ ধরে, আবার উচ্চপর্যায়ে কেউ আধুনিক প্রযুক্তি, বিশাল ফিশিং বোট ও রাডার ব্যবহার করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিং করে থাকে।

ড. মো. আসাদুজ্জামানঃ যেহেতু আমরা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত, তাই বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা উপস্থাপন করে থাকি। তবে যেটা আগেই বলা হলো,জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (FAO) দেওয়া সংজ্ঞাটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য। FAO এর মতে “Aquaculture is the farming of aquatic organisms”। এখানে “aquatic organisms” বলতে শুধুমাত্র মাছকে বোঝায় না, এর মধ্যে বিরাজমান মাছ, শামুক-ঝিনুক (mollusks), কাঁকড়া, শৈবাল ইত্যাদি সকল জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ অন্তর্ভুক্ত। এমনকি একটি বিষয় আমরা প্রায়ই দেখি যে, বাংলাদেশে একুয়াকালচারকে কেন্দ্র করে মৎস্য মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনেক সময় একটি নীতিগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে সিড (seed) বা প্রজনন উপকরণ নিয়ে। কারণ, একুয়াকালচারে যদি ফার্মিং বা চাষের উপাদান থাকে, যদি নিয়মিত পরিচর্যা এবং নিয়ন্ত্রণ থাকে, এবং যদি মালিকানা ব্যক্তি বা সমবায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে,তাহলে এটি আর পাবলিক প্রপার্টি নয়, এটি হয়ে যায় কৃষিকাজের অংশ। অর্থাৎ, তখন এটি এগ্রিকালচারের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে। সুতরাং, একুয়াকালচার শুধু মাছচাষ নয়, বরং এটি একটি সুসংগঠিত, পরিকল্পিত জলজ প্রাণীর চাষাবাদ ব্যবস্থা, যেখানে স্বত্বাধিকার, নিয়ন্ত্রণ এবং যত্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মাসুদ সিদ্দিকঃ “অ্যাকুয়াকালচারে প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের দেশে কীভাবে শুরু হলো? কিসের ভিত্তিতে এই প্রযুক্তিগুলো এসেছে? কিছু এলিমেন্টারি টেকনোলজি নিয়ে বলুন, কোথায় এগুলো ইন্ট্রোডিউস করা গেছে, এবং কীভাবে কাজ করছে?

. আব্দুল্লাহ আল মামুনঃ অ্যাকুয়াকালচার করতে গেলে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে খনন করে একটা পুকুর সৃষ্টি করতে হয়। বাংলাদেশে এই পুকুর খননের শুরুটা কিন্তু মাছ চাষের জন্য হয়নি। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ছোট ছোট পরিবারে বিভক্ত হয়ে নতুন বাড়ি করেছে, বাস্তব ভিটা তৈরি করতে গিয়ে পুকুর খনন করেছে। এই পুকুরগুলো মূলত ব্যবহার হয়েছে গোসল, থালা-বাসন ধোয়া, পশুপাখির পানি খাওয়ানোর কাজে। অনেক সময় কয়েকটা পরিবার মিলে বড় সড় পুকুর খনন করতো, এগুলোকেও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হতো। তখন কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে ‘ঝান’ নামে পরিচিত এক ধরনের খোলা অংশ থাকতো পুকুরে, বর্ষাকালে সেখান দিয়ে কৃষিজমির পানি পুকুরে আসত, আবার পুকুরের মাছ বের হতো। এই প্রক্রিয়ায় মাছের উৎস ছিল প্রকৃতি। শ্যালো ও লিটারাল জোনগুলোতে।ব্রিডিংও হতো স্বাভাবিকভাবে। একে বলা যেত ফিশারিজ আর অ্যাকুয়াকালচারের সংমিশ্রণ। ছোটবেলায় দেখেছি, ঈদের সময় জাল টেনে মাছ ধরার লোক ডাকা হতো। তখন একেকটা পুকুরে ৩০-৪০ কেজি মাছ উঠতো, ভাগ হয়ে যেত ভাইদের মধ্যে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বেড়েছে, আরবানাইজেশন হয়েছে, জমি ছোট হয়েছে, ফলে পুকুরগুলো ক্লোজড সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাকৃতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন একটা মজার কথা বলি, আজকে বৃষ্টি পড়ছিল, আমি বৃষ্টি কামনা করেছিলাম। কারণ পূর্ণিমার সময় যদি বজ্রসহ বৃষ্টি হয়, পদ্মা, মেঘনা, হালদা নদীগুলোর মাছ ডিম দেয়। এই ঘটনাটা দেখে বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, যদি আমরা কৃত্রিমভাবে নদীর মত পরিবেশ তৈরি করি, তাহলে মাছগুলো হ্যাচারিতে ডিম দিতে পারবে। তখন শুরু হলো হ্যাচারি প্রযুক্তি। প্রথমে কারেন্ট তৈরি করা হলো, তারপর হরমোন সংগ্রহ করে ইনজেকশন দিয়ে ইনডিউসড ব্রিডিং শুরু হলো। এই পুরো ব্যাপারটা বাংলাদেশে প্রথম শুরু হয় যশোর অঞ্চলে। এইভাবে আমরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হ্যাচারি নির্ভর পোনা উৎপাদনে যাই। এরপর সেই পোনা মানুষ সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের পুকুরে ছাড়ে। শুরুতে কোনো খাবার প্রয়োগ হতো না,বাসার উচ্ছিষ্ট, চালের গুঁড়া এসবেই মাছ বড় হতো। এরপর আমরা দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করি,মাছে পরিপূরক খাবার দেওয়ার ধাপ। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, মাছের নির্দিষ্ট পুষ্টির চাহিদা মেটাতে হবে। তখন তৈরি হলো ফর্মুলেটেড ফিড বা সম্পূরক খাবার। এর মাধ্যমে মাছ প্রাকৃতিক খাবার ছাড়াই বড় হতে পারছে। এই সবকিছুই প্রযুক্তির ব্যবহার, আর এগুলোর মাধ্যমেই আমাদের দেশে অ্যাকুয়াকালচারের উন্নয়ন হয়েছে।”

মাসুদ সিদ্দিকঃ তার মানে টেকনোলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা বলি, তাহলে আমাদের প্রথম মাইলস্টোন ছিল ইনডোর বিল্ডিং এর প্রযুক্তির ব্যবহার। আমরা ব্রিডিং সার্কুলার ট্যাংকে পোনা ও ফিঙ্গারলিং উৎপাদন করেছি। এরপর আমরা মাছ চাষ নিয়েছি, এবং সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার শুরু করেছি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, ওয়াটার কোয়ালিটি মেইন্টেন করার জন্য আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি। আসাদ ভাই, আপনি যদি সংক্ষেপে বলেন, এরেটর ইত্যাদি যে সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে?

ড. মো. আসাদুজ্জামানঃ বিষয়গুলো ধাপে ধাপে যদি বলি, তাহলে দেখা যায় শুরুতে মানুষ মাছ স্টকিং করত। তারপর তারা বুঝে গেল, যদি মাছকে খাবার দেওয়া হয়, তাহলে মাছের উৎপাদন বাড়ে। ২০০২ সালেও পাবনায় মানুষকে বলতাম, “পুকুরে খাবার দিতে হবে”, কিন্তু তারা বিশ্বাসই করত না। আমি নিজে ১০-১২ বছর দেশের বাইরে ছিলাম, আবার যখন দেশে ফিরে এলাম, তখন দেখলাম, মানুষ ওভারফিডিং করাচ্ছে! যেখানে ১০ কেজি খাবার দরকার, সেখানে তারা ১২-১৪ কেজি দিচ্ছে, ফলে পানি নষ্ট হচ্ছে। এর কারণ, তারা দেখেছে খাবার দিলেই মাছের উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু তাদের সঠিক পরিমাণের জ্ঞান ছিল না। ধাপে ধাপে টেকনোলজি উন্নয়ন হয়েছে। পাশের একজন মাছচাষে লাভবান হলে, অন্যরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এমনকি যাদের নিজস্ব পুকুর নেই, তারাও পুকুর লিজ নিচ্ছে।
লিজ ভ্যালু বাড়ছে, ফলে প্রফিট মেকিং এর জন্য ফার্মাররা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছে, স্টকিং রেট বাড়াচ্ছে, খাবার বেশি দিচ্ছে। কিন্তু এখানে একটা বিষয় হলো, প্রতিটি পরিবেশের একটি ধারণক্ষমতা (Carring Capasity) থাকে। যখন সেটা অতিক্রম করে, তখন আপনাকে এক্সট্রা সাপোর্ট দিতে হয়—যেমন এরেটর ব্যবহার করতে হয়, নতুন পানি দিতে হয়। এর ফলে পানির মান নিয়ন্ত্রণ (Water Quality Management) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। খাবার দিলে-অর্গানিক ডিকম্পোজিশনের কারণে পুকুরে অ্যামোনিয়া গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি ইত্যাদি  হয়,যার ফলে অক্সিজেন কমে যায়, এর ফলে মাছ মারা যেতে পারে। ক্রমে ক্রমে ফিডের উন্নয়নও হয়েছে।
বর্তমানে ফ্লোটিং ফিড বেশি প্রচলিত হয়েছে। তো এরেটরের প্রয়োজন হলো, ডিকম্পোজিশনের ফলে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি মেটানো। এরেটর অক্সিজেন সাপ্লাই করে, ফলে পানির মান ঠিক থাকে। আর একটা উন্নত প্রযুক্তি হলো বায়োফ্লক টেকনোলজি। আমি আমার পিএইচডি করেছি Water Quality Management নিয়ে। বায়োফ্লক এই বিষয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রযুক্তি। বায়োফ্লকে ব্যাকটেরিয়া গুলো ডিকম্পোজিশনের মাধ্যমে ফ্লকের মতো গুচ্ছ তৈরি করে, যেগুলো মাছ খেতে পারে। এগুলো প্রোটিন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বায়োফ্লক বাংলাদেশে কিছুদিন আগে চালু হলেও তেমন সফলতা পায়নি। অনেক সময় আমরা গবেষণা শেষ না করে প্রচার করে দেই, ফলে কৃষক প্রয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসলে এটা একটা স্থিতিশীল প্রযুক্তি, কিন্তু এটি ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান, অবকাঠামো, এবং ২৪ ঘণ্টার পাওয়ার সাপ্লাই প্রয়োজন। অনেক সময় আমরা ফার্মারদের না বুঝেই এই প্রযুক্তি দিই, ফলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এখন পর্যন্ত ফার্মার পর্যায়ে সর্বাধিক ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তি হলো এরেটর। আরও কিছু উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে, তবে বাংলাদেশে তা এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ এই যে বায়োটেকনোলজিক্যাল ইভলিউশন বলবো আমি, বা মাছ চাষে স্পেসিস ডেভেলপমেন্ট কিংবা ডিজিজ কন্ট্রোলের জন্য জেনেটিক প্রযুক্তি, এটা কি আমাদের দেশে এসেছে? আর এ ধরণের প্রযুক্তিগুলো কী কী?

. আব্দুল্লাহ আল মামুনঃ এই প্রশ্নটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা যদি পুকুর চাষ বা পন্ড ফার্মিং সিস্টেম দেখি, তাহলে এটা মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়, একটা হলো হোমস্টেড পন্ড এবং আরেকটা হলো এন্টারপ্রাইজ পন্ড। আগে যেই পুকুরগুলো ইউটেনসিল ধোয়া, গোসল করার কাজে ব্যবহৃত হতো, সেই পুকুরগুলো এখন পুরোপুরি অ্যাকুয়াকালচারে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ ১৯৮০ সালের দিকে শুরু হয়েছিল এবং তখনই আমরা চিংড়ি রপ্তানি শুরু করি। সেই সময় থেকেই মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারায় আমরা আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোর সহযোগিতা পেতে শুরু করি। সাবিনকো সহ অনেক প্রতিষ্ঠান তখন এগিয়ে আসে, এবং ইন্টেনসিফাইড অ্যাকুয়াকালচারের দিকে আমরা ধাবিত হই। এভাবে চিংড়ির মাধ্যমে এ্যারোশনের প্রভাবও দেশে প্রবেশ করে। এই সময়েই উন্নত জাতের মাছ, উন্নত ফিড, পরিচালনার জন্য প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সংমিশ্রণ ঘটে। আমরা যদি সিড প্রোডাকশনের দিক থেকে দেখি, যশোর ছিল এই ক্ষেত্রে অগ্রণী। পরে এমএইপি ও অন্যান্য অ্যাকুয়াকালচার এক্সপ্রেশন প্রজেক্টগুলোর মাধ্যমে ময়মনসিংহ হয়ে ওঠে মাছ চাষে এক বিপ্লবী জেলা। আজকে ময়মনসিংহে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়, তা পুরো ইউরোপের কিছু অংশকেও হার মানায়। এই উন্নয়নের পেছনে ডিপার্টমেন্ট অফ ফিশারিজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, রিসার্চাররা, এফআরআই এবং এনজিওগুলো অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে স্কিলড হ্যান্ড বা দক্ষ জনশক্তি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। আপনি যেই প্রজাতির কথা বললেন, চাইনিজ কার্প, যেমন: গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, কর্পিও এগুলো আমাদের একুয়াকালচারে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ২০০৭-০৮ সালের দিকে সিলভার কার্প ছিল প্রায় ১/২/৩ নম্বর প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত, উৎপাদনের দিক থেকে। পাশাপাশি তেলাপিয়া মাছের উত্থান হয়েছে।
ডিজেট্রা নামের একটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-ভিত্তিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে “গিফট তেলাপিয়া” (Genetically Improved Farmed Tilapia বা GIFT) এসেছে। জেনেটিক্যাল ইম্প্রুভমেন্ট মানে এটা নয় যে এর জিন পরিবর্তন করা হয়েছে। বরং সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে উন্নত গুণাবলী যুক্ত করা হয়েছে। যেমন, মোল্লা বাড়ির সুদর্শন ছেলেটার সাথে চৌধুরী বাড়ির সুশ্রী মেয়ের বিবাহ দিলে যেমন তাদের সন্তান হবে রিষ্টপুষ্ট, মাছের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই। সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে উন্নত প্রজাতি তৈরি হয়েছে এবং তা সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে। আজকের দিনে আমরা আলোচনা করছি যখন চাঁদপুরের বি.এফ.আর.আই এর নদী গবেষণা কেন্দ্রে বাংলাদেশের প্রথম থাই পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদিত হয়েছিল। এই প্রজাতি থাইল্যান্ড থেকে আনা হয় এবং এখন এটি ও তেলাপিয়া-এই দুই প্রজাতি একত্রে দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ অবদান রাখছে। অনেকে বলে এগুলো গরিবের মাছ, দাম কম। কিন্তু পুষ্টির দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অনেক। আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে মাছ এক অনন্য উৎস। এতে রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (EPA ও DHA), যা হৃদরোগ ও অন্যান্য অসুখ থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও এই মাছগুলোতে আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক যা দেহের ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মেটায়। আপনার প্রশ্ন ছিল জেনেটিক্যাল ইম্প্রুভ্ড  স্পিসিস কি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে? আমি বলবো,অবশ্যই রেখেছে। শুধু তেলাপিয়া আর পাঙ্গাশ নয়, আরও ২০-২৫টি প্রজাতি এখন আমাদের অ্যাকুয়াকালচারে যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১২-১৩টি এক্সজোটিক প্রজাতি। ইউরোপের কার্প পর্যন্ত আমরা এনে নিজেদের ব্যবস্থায় মানিয়ে নিয়েছি।

মাসুদ সিদ্দিকঃ শুধু ব্রিডিং করেই তো আর জাত উন্নয়ন করা যাবে না। আমাদের আরও উচ্চ পর্যায়ের দিকে যেতে হবে। রিসার্চে অনেক কিছুই হচ্ছে, কিন্তু আমরা এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ছাড়তে পারিনি। এতে তো সময় লাগবে, তাই নয় কি?

. আব্দুল্লাহ আল মামুনঃ যদি আমি এখন সিড ও ফিড নিয়ে কথা বলা হয়, এরপর কিছু স্পেসিফিক ইমপ্রুভ্ড প্রজাতির কথা বলা হয়, তাহলে বাংলাদেশের অ্যাকুয়াকালচারাল প্রযুক্তিতে ‘থার্ড মাইলস্টোন’ হিসেবে আমি “মেকানাইজেশন এবং মাইক্রোবস”-এই দুটোকে বিবেচনায় নিতে চাই। যখন পুকুরে মাছ চাষের ক্যারিং ক্যাপাসিটি ছাড়িয়ে যাবে, তখনই অতিরিক্ত কিছু যোগ করতে হবে। এই “অতিরিক্ত” বলতে শুধু খাবার না, পানির মান, অক্সিজেন, ব্যাকটেরিয়া সবই বুঝায়। আমরা যদি আশেপাশের দেশগুলো দেখি, যেমন: মিয়ানমার, আমরা এক সময় সেখান থেকে প্রচুর রুই মাছ আনতাম। এখন কমেছে, কারণ বাংলাদেশে বড় সাইজের কার্প উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে, বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে। রাজশাহীতে গত দশ বছরে ল্যান্ড ইউজ অনেক বদলেছে ,অ্যাকুয়াকালচার এন্টারপ্রেনারদের দখলে গেছে। এখান থেকেই বড় সাইজের রুই-কাতলা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ হচ্ছে। পাঙ্গাসের কথাও বলি, আমরা থাইল্যান্ড থেকে এনেছি, কিন্তু ময়মনসিংহে অন অ্যান্ড অ্যাভারেজ ৫০-৬০ টন পার হেক্টর প্রোডাকশন হয়। অথচ ভিয়েতনামে একই পরিবেশে তারা উৎপাদন করে ২০০-৩০০ টন। এখানে প্রযুক্তির ব্যবধান বোঝা যায়। আমার একজন পিএইচডি ছাত্র বলেছিল, “স্যার, আমি মানুষকে বলি মাছ না চাষ করে পানি চাষ করতে।” মানে হলো-পানির পিএইচ, অ্যামোনিয়া, অক্সিজেন এসব অপ্টিমাম রাখতে পারলে মাছ এমনিতেই ভালো হবে। আমরা যাকে বলি ‘বায়োফ্লক’, সেখানে আসলে হয়েছে তাই। কেউ মাছ চাষ না করে শুধুই ইউটিউব দেখে শুরু করেছে। কিন্তু পানির গুণাগুণ রক্ষা করতে না পারায় অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা গাজীপুর এবং নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটা গবেষণা করেছি, কে.জি.এফ ফান্ডে। দেখা গেছে , ৯০-৯৫% তরুণ, যারা বিদেশে না গিয়ে বায়োফ্লকে বিনিয়োগ করেছে, তারা স্কিলড না থাকায় ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই প্রযুক্তির ইন্ট্রোডাকশন যাদের মাধ্যমে হয়েছে, তারা শুধু কনটেন্ট বানিয়ে প্রোডাক্ট বিক্রি করেছে, ফলে তরুণরা স্কিলড না হয়েই নেমে পড়েছে। তাই আমি বলব, থার্ড মাইলস্টোন হিসেবে “মেকানাইজেশন এবং মাইক্রোবস” গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, সঠিকভাবে এয়ারেশনের মাধ্যমে মাছের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ, ওয়াটার ও সয়েল প্রোবায়োটিক্সের ব্যবহার, গাট মাইক্রোবায়োটার উন্নয়ন। ফার্মার যেন বুঝে মাছ ছাড়বে, খাবার কতটুকু দেবে, সিএন রেশিও কেমন হবে, পানির প্যারামিটার কীভাবে ঠিক রাখবে-সব জানতে হবে। এই জ্ঞান ছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব নয়। ভিয়েতনামের উদাহরণ দিচ্ছি, তারা ২০০-৩০০ কেজি পাঙ্গাস উৎপাদন করছে। সেই মাছ আজ ব্রিটিশ মার্কেট, ইউএস মার্কেট এমনকি ঢাকার সুপারশপে “ডরি ফিশ” নামে বিক্রি হচ্ছে। তাই প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হতে হলে আমাদের আইইউওটি, আইপিআরএস, ক্লাউড বেসড সিস্টেম, বোটম ক্লিনিং, একুয়াফনিক্স এসব নিয়েও চিন্তা করতে হবে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ অ্যাডভান্স টেকনোলজি যেটা এতক্ষণ আলোচনা করলেন, এটা রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি বা গবেষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে এখন পর্যন্ত। বাংলাদেশে এটা কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর উপায় কি? আমাদের দেশের সাধারণ মাছ চাষি, একজন হোমস্টেড ফার্মার, যার হয়তো একটা বা দুইটা পুকুর আছে, বাড়ির সামনে একটা, পিছনে একটা,  ওর কাছে কিভাবে পৌঁছানো যায়? আমাদের ডিপার্টমেন্ট অফ ফিশারিজ বা বি.এফ.আর.আই-এদের ভূমিকার ব্যাপারে আপনাদের ব্যাখ্যা কী?

ড. মো. আসাদুজ্জামানঃ আসলে সত্য কথা যেটা আমি এখন পর্যন্ত দেখি, যেটা আমাদের প্রথম আলোচনায় বলা হয়েছে, আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মী ডঃ মামুনও যথেষ্ট ভালো বলেছেন  যে অ্যাকোয়াকালচার বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নতুন। বলতে চাই যে মাত্র ৩০ বছর হলো এই খাতে উন্নয়ন শুরু হয়েছে। ৩০ বছর আগেও এতটা উন্নয়ন বা প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না। এখন যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে, অনেক কিছুই হয়েছে, আর এই উন্নয়নের পেছনে যারা বিভিন্ন জায়গায় সাইন্টিস্ট, ডিপার্টমেন্ট অফ ফিশারিজ, বি.এফ.আর.আই, এনজিও, পার্টনার, ডোনার এজেন্সি আছেন, প্রত্যেকের নিজস্ব অবদান আছে। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে, আমাদের একুয়াকালচার প্রোডাকশন এখনো দু-তিন গুণ বাড়ানোর সুযোগ আছে। উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই আমরা এই বৃদ্ধি করতে পারি। বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার মতো হোমস্টেড পয়েন্ট খুব কম, ওখানে বেশি কমার্শিয়াল ফার্মার, কিন্তু আমাদের ৫০% মাছ চাষি হোমস্টেড ফার্মার। এখন প্রাইভেট সেক্টর অনেক দূর এগিয়ে গেছে টেকনোলজিতে, কিন্তু বড় একটা অংশ আছে যারা এখনও শুধুমাত্র এরেশন পর্যন্ত উন্নয়ন করেনি। কিছু সহজ মেজার নিলে উৎপাদন দিগুণ বা তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বি.এফ.আর.আই, ডিপার্টমেন্ট অফ ফিশারিজ প্রচুর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমি মনে করি, যদি আমরা ছোট ছোট পুকুরগুলোকে ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারি, তাহলে জাতীয় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আমাদের ছোট দেশের জন্য হরিজেন্টাল এক্সপানশন, অর্থাৎ নতুন পুকুর কাটার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত নয়, কারণ জমি সীমিত। যেমন: দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে, যেখানে লবণাক্ততা বেশি, সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই কম। জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে মাছ পোনা ঢুকছে, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপার্টমেন্ট, বি.এফ.আর.আই-এরা ছোটো চাষিদের জন্য এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পারেন যাতে ৩০-৫০% উৎপাদন বাড়ানো যায়। এটা খুব কঠিন কাজ নয়, কিছু মডিফিকেশন করলেই সম্ভব। এটাকে আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য করতে হবে।

মাসুদ সিদ্দিকঃ আমি কিভাবে একটা গ্রামের মাছ চাষী বা কৃষকের কাছে পৌঁছাব? তাকে কিভাবে প্রশিক্ষিত করব? কোন প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর ফল দিবে? চাষীর কাছে পৌঁছানোর সেরা উপায় কী? আপনারা গবেষক হিসেবে এটা করতে পারবেন? কারা কিভাবে এগুলো করবে?

ড. মো. আসাদুজ্জামানঃ এটা খুব কঠিন কাজ না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু উন্নয়ন এজেন্সি, এনজিও, ডিপার্টমেন্ট অফ ফিশারিজ কাজ করছে। বর্তমানে ডিজিটালাইজেশনের যুগ, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ফার্মাররা অনেক কিছু শিখতে পারছে। অনেক ভিডিও আছে, কিন্তু সেগুলো পৌঁছানো দরকার। ডিজিটালাইজেশন আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ। বিশেষ করে তরুণরা এই প্রযুক্তি গ্রহণ করছে। আমাদের এন্টারপ্রেনারদের নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে, কিভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দিতে পারি। সরাসরি প্রশিক্ষণ হয়তো সবসময় সম্ভব না, কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব। এটা করলে সাফল্য আসবে আমার বিশ্বাস।

মাসুদ সিদ্দিকঃ আমাদের উদ্দেশ্য এরকম যারা বিশেষজ্ঞ আছেন বিভিন্ন বিষয়ে তাদের লার্নিং, তাদের নলেজ, এগুলো যাতে আর্কাইভ করে রাখি আমরা। একটা স্টুডেন্ট, একটা রিসার্চার, ওরা যাতে এটা দেখে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয় বলে আমরা মনে করি। আপনারা কি মনে করেন যে এটাও ডিসিমিনেট করার আরো কোন ভিন্নতর উপায় আছে?

. আব্দুল্লাহ আল মামুনঃ যদি দেখি বাংলাদেশ কন্টেস্টে যে অ্যাকোয়াকালচারের ভ্যালু চেনের ব্যাক ওয়ার্ড লিংকেজ, অর্থাৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া, সেখানে যারা ইনপুট দিচ্ছে, গভমেন্ট ডিপার্টমেন্ট অফিসার, বি.এফ.আর.আই, ইউনিভার্সিটি, এনজিও, সবার অক্লান্ত পরিশ্রম, এবং ফার্মাররা সহ আজ এ সেক্টরটা একটা ভালো পর্যায়ে আসছে। এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষ কখন হবে? যদি আমি কাস্টমার বা কনজিউমারকে প্রপারলি লিড না করতে পারি, তাহলে উৎকর্ষতা আসবে না। সকল কনজিউমারের মধ্যে যদি একটা মিসিং জায়গা থাকে, তার বিজনেসকে যদি আমি দেখি না, তার রিকোয়ারমেন্ট স্টাডি না করি অর্থাৎ ভ্যালু চেইনের ফরওয়ার্ড লিংকেজ যদি আমি প্রপারলি স্টাডি না করি তাহলে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন সম্ভব নয়। একুয়াকালচারের প্রযুক্তি মানে এই নয় যে শুধু এরেশন যুক্ত হলো, বায়োফ্লক যুক্ত হলো, আইপে যুক্ত হলো। প্রযুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে কনজিউমারকে লিড করা; কনজিউমারের ডিমান্ড কেউ ফুলফিল করবে। আজকের সবাই আরবানাইজেশন এর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, বিজনেস বেড়ে যাচ্ছে এবং কম্পিটিশনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাকে রেডি টু ইউজ, রেডি টু কুক প্রোডাক্ট এবং সারাজীবন নিউট্রিশনাল রিকোয়ারমেন্ট দিতে হবে, যা অ্যাকুয়াটিক এনিমেল দিতে পারে। যদি আমি নিউট্রিশন সেনসিটিভ অ্যাপ্রোচ না নিয়ে আসি, কনজিউমার যদি ট্রাস্ট ফেরত আনতে না পারে, তাহলে প্রযুক্তির কথা যতই বলি, ইউজার গ্রহণ করবে না। প্রোডিউসারকে কাস্টমারকে বুঝতে হবে, কাস্টমারের আস্থা প্রোডিউসারের উপরে থাকতে হবে। অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিগুলো দেখি, চানাচুর, বিস্কিট, মিটার, এগুলোতে ট্রাস্টেড ব্র্যান্ড আছে। আমাদেরও এমন একটা অ্যাপ্রোচ আসতে হবে। ঢাকা শহরে প্রচুর মানুষ নদীর মাছের নাম শুনে দ্রুত খেতে চায়, বেশি দাম দিতে চায়। অনেক ভালো মাছ তারা কিনে খায়। সুতরাং আমাদের কাস্টমার, নিউট্রিশনালি ডেফিসিট কাস্টমার সবাইকে অ্যাকুয়াকালচারকে ফাইন টিউন করতে হবে। আমাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন প্রোডিউসার ক্লিনিক নিয়ে আসবে, আইপিআর অ্যাকটিভিটিস প্রোফাইলে এস্টাবলিশ করবে। ভিয়েতনামের মতো ৩০০ মেট্রিক টন ফ্লেভার বিহীন হোয়াইট পাঙ্গাসিয়াস মাছ আমরা এখানে এনে দিতে পারব।

মাসুদ সিদ্দিকঃ এসোসিয়েট ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট একটা ল্যাব, গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান, একটা কনসাল্টিং ফার্ম এবং তার ব্যানারে এনডিসিআর একটা ডিজাইন প্ল্যাটফর্ম। আমরা যে উদ্যোগটি নিয়েছি, এটা সম্পর্কে আপনাদের ভিউসটা যদি আমাদের বলতেন?

ড. মো. আসাদুজ্জামানঃ অবশ্যই, এটা খুব ভালো উদ্যোগ এবং যাতে এটা আরো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়, সেটা আমার করাটা জরুরি। আমার সাজেশন হচ্ছে, আমাদের যারা ইন্টারপ্রেনার আছেন, তাদের ডিমান্ড এবং সমস্যাগুলো কোথায় তারা ফেস করছে, কোথায় জানার ইচ্ছা আছে, সেটা জানতে পারা খুব দরকার। আপনারা যদি এসব ইস্যুতে কাজ করেন, আমার বিশ্বাস এটা অচিরেই খুব ভালো হবে। আজকের ডিজিটাল যুগে সবাই, এমনকি একজন কৃষকও এগুলো দেখতে পারে। আমার মনে হয় এটা সঠিকভাবে চালিয়ে গেলে সেক্টরে কিছু অবদান রাখবে।

. আব্দুল্লাহ আল মামুনঃ এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা মাছ চাষের প্র্যাকটিশনার হিসেবে নয়, মানুষকে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করার জন্য কাজ করছি। মাছ তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। যখন আপনারা এডভোকেসির মাধ্যমে প্রডিউসার থেকে কনজিউমার পর্যন্ত আলোচনা করবেন, তখন ভুল ধারণাগুলো মিটে যাবে। আমাদের একটি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও সুস্থ জাতি গঠনে এই প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমি এই প্ল্যাটফর্মের সফলতা কামনা করি এবং এই ইন্টারেকশনগুলো আমাদের গাইড করবে যে আমাদের রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্টের ওরিয়েন্টেশন কোথায় হওয়া উচিত।

মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনারা দুজনই অত্যন্ত সুন্দরভাবে তথ্যসমৃদ্ধ ও বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা করেছেন এবং অত্যন্ত মূল্যবান সময় দিয়ে আজকের ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো)কে স্বার্থক করেছেন। পাঠকবৃন্দ এই আলাপচারিতার বিষয়গুলা জেনে উপকৃত হবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস। এআইআরডি এর পক্ষ থেকে আপনাদের দুজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন