বাংলাদেশের ইলিশঃ বর্তমান ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন ভাবনা শীর্ষক আলাপচারিতা
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ মূলত একটি গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। এআইআরডি-এর একটি ওয়েভ পোর্টাল হচ্ছে এনডিসিয়া (Ndicia)। মূলতঃ এনডিসিয়ার উদ্যোগে উন্নয়ন আলোচনা শীর্ষক এই আলাপচারিতাটি (টকশো) আয়োজিত হয়েছে। আলোচ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশের ইলিশঃ বর্তমান ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন ভাবনা। আলোচনায় অতিথি হিসেবে জুম লিংকে যুক্ত ছিলেন ড. আনিছুর রহমান, ইলিশ গবেষক ঢাকা বাংলাদেশ এবং ড. মো. নিয়ামুল নাসের, অধ্যাপক ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলোচনাটির সঞ্চালনায় ছিলেন মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এআইআরডি লিঃ। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয় গত ১৪ই নভেম্বর ২০২৪ রাত ৮ টায়।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ সম্পর্কে দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রাথমিক তথ্য শেয়ার করুন?
ড. আনিছুর রহমানঃ ইলিশ বাংলাদেশের ঐতিহ্যের প্রতীক। এটা শুধু জাতীয় মাছ নয়, এটা ফ্ল্যাগশীপ অব দ্য কান্ট্রি। একক প্রজাতি হিসেবে এটা বৃহত্তর। এর অবদান যদি এভাবে চিন্তা করা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ১০০টি পিলারের উপর দাড় করানো আছে সেখানে ১টা পিলার হবে এই ইলিশ। অর্থ্যাৎ ১% এর বেশী এই ইলিশ জিডিপিতে অবদান রাখে এবং ১২% এর অধিক মানুষ তাদের জীবন জীবিকার জন্য ইলিশের সাথে জড়িত। বলা যায় ইলিশ বাংলাদেশের একটা বিশাল ইন্ড্রাষ্ট্রি। বাংলাদেশের জলসীমাকে তারা আবহমানকাল হতে পছন্দ করে আসছে। সাগরে এদের বসবাস হলেও তারা মূলত প্রজননের উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে উপকূল বেয়ে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোতে চলে আসে। এদের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। ইলিশের প্রজাতির কথা বললে বলতে হয় বিশ্বব্যাপী এদের মোট পাঁচ প্রজাতি আছে। তবে বাংলাদেশে এর ৩টি প্রজাতি যেমন টেনোয়ালোসার ২টি এবং হিলশা ক্যালী বা কানাগুর্তার ১টি পাওয়া যায়। যেকোনো মিঠাপানির মাছকে সাগরের লোনাপানিতে বা সাগরের লোনাপানির মাছকে মিঠাপানিতে ছেড়ে দিলে তারা কিন্তু টিকতে পারবেনা। ইলিশ এর ক্ষেত্রে তাদের বায়োলজিটা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, শক্তিশালী অভিপ্রায়ণ সক্ষমতা ইলিশের অন্যতম বৈশিষ্ট।তারা ডিম ছাড়ার সময় প্রণোদনা অনুভব করে এবং সাগর থেকে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোতে আসে।
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ ইলিশ সামুদ্রিক মাছ। ইলিশ মাছের এই যে একটা প্রক্রিয়া সে সমুদ্রে থাকে কিন্তু সে এই বঙ্গভূমিতে হাজার হাজার বছর ধরে প্রজননকালে মিঠাপানিতে চলে আসে। এক কথায় বলতে গেলে ইলিশের এই বায়োলজিক্যাল মাইগ্রেশনের কারনে ইলিশ বাংলাদেশে ফিশারি হিসেবে দেখা গেছে, মানে এই দেশে ইলিশ একটা ইন্ড্রাষ্ট্রি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যে, ধ্যান-ধারণায় ইলিশ একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে আরো ২টি দেশ আছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও মিয়ানমার। দুটোতেই একই সাগর ও মোহনা রয়েছে কিন্তু অধিকাংশ ইলিশ মাইগ্রেট হয়ে বাংলাদেশেই কেন আসে?
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ ২০০৮-২০১০ পর্যন্ত ভারত এবং বাংলাদেশে একটা গবেষণা করা হয়েছিলো তখন একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় পাওয়া গিয়েছিলো যে এই ইলিশগুলো কিন্তু একত্রে বঙ্গোপসাগরেই আছে। সুন্দরবনের ঠিক নিচের অংশে বিভিন্ন জায়গায় তাদের দেখা যায় কিন্তু বর্ষাকালে মেঘনা দিয়ে যখন পানি নামে তখন দেখা যায় ইলিশ মেঘনা নদী হয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ শুরু করে। যেটা ধারণা করা হয় এখানকার পানির গুণাগুণ – ওরা তো এটা উপলব্ধি (সেন্স) করে। পানির দূষণ, পানির স্রোত, পানির লবণাক্ততা থেকে ওদের মিঠাপানিতে চলে যাওয়ার একটা পর্যায়ে ফিজিক্যালি বিষয়টার সাথে মিলে যায় বাংলাদেশের নদীর সাথে – আর এটাই মূল কারণ। ইলিশের শারীরবৃত্তীয় যে চাহিদা সেটা বাংলাদেশের নদীগুলোই বেশী দিতে পারছে আর এ কারণেই ইলিশগুলো বাংলাদেশের নদীতে ঢুকে পড়ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে পদ্মা এবং মেঘনার অববাহিকায় ইলিশের বিচরণ ও প্রাপ্যতা আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে। ড. আনিছ আপনি কি মনে করছেন কেন কমে যাচ্ছে?
ড. আনিছুর রহমানঃ পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কমে যাওয়া, পদ্মায় তো অন্যান্য মাছ ও কমে যাচ্ছে শুধু ইলিশ নয়। ইলিশ মাছ তো খুব সেনসিটিভ প্রজাতির মাছ। এর যে একটা বিশেষত্ব আছে এটার জন্য, আর পরিবেশটাও তারা পেয়েছে বলেই বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে আসছে। কিন্তু সেই পানি যদি সঠিক গুণাগুণ নিয়ে না থাকে, পানির গভীরতা যদি ঠিক না থাকে, পানিতে যদি সঠিক স্রোত না থাকে যা তাদের জন্য প্রযোজ্য, যেটি তাদের বাড়িঘর এটা যদি ঠিক না থাকে তাহলে তাদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে। সেই পদ্মা তো পদ্মার জায়গায় নেই, শুধু পদ্মা নয় মেঘনাতেও কমে গেছে, তাদের পরিবেশ যেন ক্রমশই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। চর, ডুবো চর, দূষণ এবং সেই সঙ্গে বর্তমানকালে বালু উত্তোলন বিভিন্ন কারণে কমে আসছে যা চিন্তার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টাও এর সাথে জড়িত।
মাসুদ সিদ্দিকঃ নির্বিচারে মৎস্য নিধন, বে-আইনি মাছ ধরার জাল বা ক্ষতিকর জালের ব্যবহার এসবেরও কি ভূমিকা আছে?
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ বাংলাদেশের সমুদ্রে কিন্তু ফিশিং এপ্রোচটা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রলার দিয়ে আরো ভিতরে গিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরা হয়। এই জায়গা কিন্তু মাদার স্টক আর মাদার স্টকেও কিন্তু এই প্রভাবটা পড়ছে যেটা ধারণা করা হচ্ছে। একটা প্রকাশনায় দেখা যায় বাংলাদেশের নদীগুলোতে ২০১০ এ কাজ করা হয়েছিল কিন্তু ২০২০ এ গিয়ে দেখা গেছে অনেকগুলো নদীর গভীরতা কমে গেছে বা চর পড়েছে ফলে সেখান দিয়ে আগের মত ইলিশের আর চলাচলের পরিবেশ নেই। ওদের চলাচলের জন্য যে ২-৩ মিটার গভীরতা প্রয়োজন তাও নেই। আর ইলিশ শিশু বা জাটকা যেটা তাদের জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার তাও কিন্তু নেই। চর বা সেডিমেন্টেশনের ফলে নদীর মধ্যে এদের যেরকম বিস্তার হওয়া দরকার এগুলো কিন্তু কমে যাচ্ছে। এদের ফেরত যাওয়ার পথে তারা জালে ধরা পড়ছে অথবা ওই জায়গাগুলোতে আটকে যাচ্ছে। এই সামগ্রিক বিষয়গুলোর কারনে তারা কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত হতে পারছেনা। এদের জীবনচক্রে একটা বিঘ্ন ঘটছে এটাই ইলিশের বিচরন কমে যাওয়ার কারন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মা মাছের প্রজনন মৌসুমে নিষিদ্ধকালীন সময়সীমা ৬৫ দিন, ২২ দিন ও ৬০ দিন যে থাকছে এটা কতটুকু বিজ্ঞান সম্মতভাবে নির্ধারণ করা হয়ছে? আনিছুর রহমান বিষয়টা একটু সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. আনিছুর রহমানঃ প্রথমত হলো ইলিশের পোনা দরকার ২২ দিনের অক্টোবরে যেটা বাচ্চা হল, তারপর সেটাকে নার্সিং করতে হয় যেটা হলো নার্সারি গ্রাউন্ড। বাংলাদেশে নার্সারি গ্রাউন্ড ঘোষণা করা হয়েছিল পাচঁটির পরে ষষ্ঠ নার্সারি গ্রাউন্ড। একটা অমাবস্যা আর একটা পূর্ণিমাকে ঘিরে কিন্তু এই ২২ দিন। দ্বিতীয়ত ১লা নভেম্বর থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত ২৫ সেন্টিমিটারের নীচে একটা ইলিশেও হাত দেওয়া যাবে না। তারপর আরো দুইটা মাস কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো ১লা মার্চ থেকে ৩০শে এপ্রিল। তারা এই সময়টাতে খেয়ে বড় হয়। এখন তৃতীয়ত হলো ২০শে মে থেকে ৩০শে জুলাই ৬৫ দিনের সময়টাও ইলিশের জন্য খুব সেনসিটিভ। এই যে ২২ দিন, ৬০ দিন এবং ৬৫ দিন এটা খুবই বিজ্ঞানসম্মত। শুধু ইলিশ নয় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদসমূহের জন্যও। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগকে মৎস্যের বিরাট ভান্ডার বলা যায়। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ণিমাতে তারা যে হারে ডিম ছাড়ে অমাবস্যাতেও সেই একই হারে ডিম ছাড়ে। এই যে কয়েক মাস ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এটা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে করা হয়েছে। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ নিষিদ্ধকালীন এই সময়টাতে ইলিশ নির্ভর জেলে যারা ইলিশ ধরে জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে, কিভাবে তাদের জীবিকার উন্নয়ন করা যায়, সরকারি প্রণোদনার বিষয়ে ড. নাসের আপনি একটু বলুন?
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ ইলিশের জন্য ইনভেস্টমেন্ট বাড়ানো দরকার বাংলাদেশের জেলেদের একটা বড় অংশই কিন্তু ইলিশ নির্ভর। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়টাতে টাকা-পয়সা দিয়ে জেলেদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এই ম্যানেজমেন্টটা রাখতে পারলে জেলে ভাইরা কিন্তু নিষিদ্ধকালীন সময়ে ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাবে না। বাংলাদেশের ন্যাশনাল বাজেটের একটা অংশ ইলিশের জন্য রাখতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে। ইলিশের পেছনে যদি ১০০০ কোটি টাকা খরচ করা হয় তাহলে কত হাজার কোটি টাকা যে ফেরত (রিটার্ণ) পাওয়া যাবে তা কিন্তু কল্পনাতীত। তাই জাতীয় মাছ, জাতীয় সম্পদ ইলিশের স্বার্থে ইনভেস্টমেন্ট করতেই হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ইলিশ আহরণে জেলেরা দাদনের ফাঁদে বন্দী এ বিষয়ে আপনাদের অভিমত ব্যক্ত করুন।
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ জেলে ভাইয়েরা এমন একটা জায়গায় থাকেন সেখানে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যাংক বা লোন দেওয়ার কোন জায়গা নেই। এত রিমোট এরিয়ায় তারা থাকেন সেখানে কোন উন্নয়ন সংস্থা যেতেও ভয় পায়। মূলত এ কারণেই এখানে তাদের ব্যবসা চালু হয়ে গেছে। এই দাদনের ফাঁদ থেকে জেলেদের রক্ষা করতে হবে এবং এ বিষয়ে সরকারি এবং বেসরকারি এজেন্সিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
ড. আনিছুর রহমানঃ জিনিসটা খুব পীড়াদায়ক। আবহমান কাল থেকে দেখা যাচ্ছে তারা হতদরিদ্র, শিক্ষায় পিছিয়ে আছে। তারা খারাপভাবে আষ্টেপিষ্টে দাদনের ফাঁদে, মহাজনদের চক্রের জালে বাধা আছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। তারা এত কষ্ট করে মাছ ধরে আনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অথচ সেই লাভটা তারা পায় না। কষ্টের জায়গা এটাই যে, ইলিশ মাছের এত দাম এটা কিন্তু জেলেদের কোন লাভই হচ্ছেনা। দাদন ব্যবসায়ীরা মাঝখান থেকে ভোগ করে। এখন জেলেরা নৌকা বানানোর জন্যই হোক আর জাল কেনার জন্যই হোক বা যখন ইলিশের মৌসুম থাকে না তখন তাদের সংসার চালানোর জন্যই হোক তারা কিন্তু দাদন ব্যবসায়ীদের দারস্থ হয়। এ থেকে বাঁচতে তাদেরকে এই চক্র থেকে বের করে আনতে হবে, তাদেরকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে সরকারকে বিষয়টা কঠোরভাবে দেখতে হবে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটা জানাচ্ছি যে তাদেরকে অবশ্যই এই দাদন ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বলতে পারেন এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটা আমার একটা আপিল ।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ইলিশের এত দাম কেন ড. নিয়ামুল নাসের একটু বলুন?
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ এটাতো সার্বিক খরচ, তাদেরকে ট্র্রলার ভাড়া করতে হয়, খাবার নিয়ে যেতে হয় সাগরে, ছোট ট্রলার হলেও সর্বনিম্ন ৫-৭ লাখ টাকা খরচ হয়। আর এখন যেটা হচ্ছে সেখানে কিন্তু বড় বানিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা জেলেদের ধরা মাছগুলো সমুদ্র থেকেই নিয়ে যাচ্ছে। তখন ওই বানিজ্যিক ট্রলারগুলো ওই মাছগুলো নিয়ে যে লাভ করছে আর সেখানে যারা জেলে, যারা কষ্ট করে মাছ ধরে তাদের কিন্তু এই লাভের একটা ফারাক আছে। তারপর ওইখান থেকে আসতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হাত বদলের কারনে দামটা বেড়ে যায়।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এইযে হাত বদলের কথা বললেন বা সাপ্লাইচেন এটাকে কিভাবে ঠিক করা যায় এটা ঠিক করার বিষয়ে দুজনেই সুপারিশ করুন।
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ ইলিশ নির্ভর জনগোষ্ঠী যারা আছেন তাদের অর্ধেককে যদি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায় এবং অন্য কাজে নিয়োগ করা যায় তাহলে বাকি অর্ধেক ইলিশ নির্ভর জনগোষ্ঠী কিন্তু লাভবান হতে পারবে। কারণ তারা মাছ তখন বেশি পাবে আর কম দামে বিক্রি করতে পারবে। তখন যেটা হবে আমাদের নদীগুলোতে মাছের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর ওই যে বললাম ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে এটা করতে পারলে সম্ভব।
ড. আনিছুর রহমানঃ হঠাৎ করে দেখা যায় বাজারে চিনির দাম, পেঁয়াজের দাম, বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এটা কি আসলে হঠাৎ করে উৎপাদন কমে যায় এই জন্য? অবশ্যই না, তাহলে এর মধ্যে কারসাজি থাকে। আর ইলিশের ক্ষেত্রে কারসাজি নেই একথা কেউ বলতে পারবেনা। অনেকগুলো বিষয় মাথায় রাখা দরকার যেমন বাজার নিয়ন্ত্রন, ভোক্তা অধিকার আইন আছে তারা বাজারে গিয়ে থাকেন কিন্তু তারা কি সেইভাবে কোন জিনিসের দাম কমাতে পেরেছেন? কিন্তু শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রন করা তো জরুরী। আরেকটা কথা মৎস্যজীবীদের মধ্যে সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার বাড়াতে হবে তা মিডিয়ার মাধ্যমে হোক আর যেভাবেই হোক। আর উৎপাদন যদি যথেষ্ট থাকে, বর্তমানে ৭ লক্ষ ২০০০ মেট্রিক টন সর্বোচ্চ টেকসই ফলন (এমএসওয়াই) এটাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। আরেকটা যেটা ইলিশকে বড় হওয়ার সময় দিতে হবে। এভাবে করলে যেহেতু উৎপাদন বাড়বে তখন দাম কিছুটা কমবে। আর একই সঙ্গে বাজার সিন্ডিকেটের বিষয়টা দেখতে হবে তাহলে অবশ্যই ভালো ফল পাওয়া যাবে, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এটা সম্ভব।
মাসুদ সিদ্দিকঃ বাংলাদেশের হিলশা কনজারভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান আছে তবে এটা কি আরো যুগপোযোগী করা দরকার?
ড. আনিছুর রহমানঃ ২০৩১ সালে হিলশা ম্যানেজমেন্ট কোন পর্যায়ে যেতে পারে ২০৪১ সালে কোন পর্যায়ে যেতে পারে এজন্য ৪ সদস্যের একটা কমিটি করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে এই কমিটির দুজনই ইন্তেকাল করেছেন, আমিসহ দু’জন আছি এই কমিটিতে। এখন অনেকেই আছেন যারা এ বিষয়ে আস্তে আস্তে সম্পৃক্ত হবেন। হিলশা কনজারভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান সংশোধনের বিষয়ে বলতে গেলে অবশ্যই তার সংশোধন করা প্রয়োজন। আর ২০০১ সালে হিলশা ম্যানেজমেন্টের প্রথম ড্রাফটা আমার হাতে লেখা হয়েছিল এখন অবশ্যই সংশোধন করা দরকার আছে। সংশোধন মানে আপডেটের প্রয়োজন। এগুলো পরিবর্তন করে নয় তবে নতুন করে কিছু সংযোজন করা যায়। কারণ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে।
ড. নিয়ামুল নাসেরঃ একটু একটু করে মডিফাই করে, যেমন ব্রীডিং গ্রাউন্ড চেঞ্জ হতে পারে, কনজারভেশন স্যাংকচুয়ারীগুলো চেঞ্জ করা যেতে পারে যেহেতু জলবায়ুু পরিবর্তনটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন এটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে কোন নদীতে হলে ভালো হয়। এমন একটা নদীতে হচ্ছে যেখানে দেখা যায় যে পানি নেই বা গভীরতা কমে গেছে তো এসব জায়গা থেকে উইথড্রো করে আরেক জায়গায় নিতে হবে। তো এভাবেই কিন্তু আমাদের হিলশা ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানটাকে মেইনটেন করতে হবে। ভবিষ্যতে যারা আসবে ইলিশ নিয়ে কাজ করবে তাদেরকে কিন্তু এভাবেই চিন্তা করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ইলিশের কূটনীতি সম্পর্কে একটু বলুন?
ড. আনিছুর রহমানঃ কূটনীতি মানে তো একটা রাষ্ট্রের সাথে আরেকটা রাষ্ট্রের পরিচয় ঘটানো। ইলিশ কিন্তু বাংলাদেশের কূটনীতির একটা অংশ। ইলিশের কারনে কিন্তু বাংলাদেশকে অনেকে চিনে, জানে। চাদপুরের ইলিশ এতই বিখ্যাত যে বাংলাদেশের চাঁদপুর ছাড়া এটা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবেনা। ইলিশ এখন বাংলাদেশের জিআই পণ্য। এটা যে কত বড় কূটনীতির প্রসঙ্গ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আলোচনা আসলেই শিক্ষণীয় ও প্রানবন্ত ছিল, ইলিশ সংরক্ষণ ও এর উৎপাদন বাড়াতে দু’জনেই অত্যন্ত মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং অনেক চ্যালেঞ্জও রযেছে। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।