জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণঃ স্থানীয় জনগোষ্ঠী সম্পৃক্তকরণ
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD)লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণঃ স্থানীয় জনগোষ্ঠী সম্পৃক্তকরণ। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন অতিথিঃ ড. সৈয়দ আলী আজহার, ফিশারিজ এক্সপার্ট এবং ড. মো. রিয়াজ উদ্দিন সরকার, সাবেক উপপরিচালক (অ্যাকুয়াকালচার), মৎস্য অধিদপ্তর বাংলাদেশ, মৎস্য ভবন, ঢাকা। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ২৩/০১/২০২৫ তারিখ রাত ৮ টা থেকে ৮:৪৫ মিনিট।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনারা উভয়েই মৎস্যসম্পদ নিয়ে কাজ করেন এবং ওয়েটল্যান্ড বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিজ্ঞতা রয়েছে, বাংলাদেশের জলজ সম্পদের একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা (ওভারভিউ) দেন।
ড.আলী আজহারঃ বাংলাদেশের জলজ সম্পদ মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় একটি সামুদ্রিক সম্পদ এবং আরেকটি অভ্যন্তরীণ জলসম্পদ। অভ্যন্তরীণ জলসম্পদকেও দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায় একটি ক্লোজ ওয়াটার ফিসারিজ এবং অন্যটি ওপেন ওয়াটার ফিসারিজ বা ক্যাপচার ফিশারিজ। এই তিন ধরণের সম্পদ নিয়েই বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচে কাজ করা হয়। এ ছাড়াও উপকূলীয় জলজসম্পদ রয়েছে। ২০২১-২২ সালের মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের আয়তন ৩৮,৬০,৭৭২ হেক্টর, বদ্ধ জলাশয়ের আয়তন ৮,৪৫,৩৯৯ হেক্টর। অন্যদিকে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের মাত্র ১৪.৮৩ % আসে সামুদ্রিক মাছ থেকে এবং অবশিষ্ট ৮৫.১৭ % মৎস্য উৎপাদন অভ্যন্তরীল জলাশয় থেকে আসে। বর্তমানে, বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ সম্পর্কে জানি যে সর্বশেষ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি বিশাল সামুদ্রিক অঞ্চল অর্জন করেছে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ জলাশয় বা জলসম্পদের মধ্যে রয়েছে নদী, খাল, বিল, পুকুর, বিভিন্ন ডিচ এবং ওয়েটল্যান্ডসহ অন্যান্য জলাশয়। এসব জলাশয় জীববৈচিত্র্যের একটি বিশাল আধার। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ, ম্যাক্রো ও মাইক্রো অর্গানিজমসহ অন্যান্য প্রাণীরা বসবাস করে। এ কারণেই এই জলাশয়গুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ বাংলাদেশের জলজ সম্পদ প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত একটি হলো সামুদ্রিক এবং অন্যটি অভ্যন্তরীণ জলাশয়। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ও দুটি অংশে বিভক্ত একটি হলো বদ্ধ জলাশয়, যেখানে আমরা অ্যাকুয়াকালচার (চাষযোগ্য জলজ সম্পদ) পরিচালনা করি। বর্তমানে মাছের উৎপাদনের বড় অংশই আসছে অ্যাকুয়াকালচার থেকে। তবে আমাদের আরও একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে মুক্ত জলাশয়ে, যেমন হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি। এই মুক্ত জলাশয়ে জীববৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা কিছুটা সংকটাপন্ন। তাই মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে মুক্ত জলাশয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান সরকার, বিশেষ করে মৎস্য অধিদপ্তর, বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, এই প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করা দরকার।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমরা জানলাম যে জলজ সম্পদ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত সামুদ্রিক এবং অভ্যন্তরীণ জলাশয়। সামুদ্রিক জলজ সম্পদকেও আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায় হাই সি (গভীর সমুদ্র) এবং কোস্টাল এরিয়া (উপকূলীয় এলাকা)। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মধ্যে নদী, নালা, খাল, বিল, এমনকি সিজনাল ফ্লাডপ্লেইনও জলজ সম্পদের অংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১১০০ থেকে ১২০০টি নদী রয়েছে। আবার বিলের সংখ্যা আনুমানিক ১ লক্ষ ১৪ হাজার। এই বিপুল জলজ সম্পদের মধ্যে অ্যাকুয়াটিক বায়োডাইভারসিটির মূল উৎস কী? এবং এর প্রধান প্রধান প্রজাতিগুলো কী কী?
ড. আলী আজহার: বাংলাদেশে জলজ জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় একটি মৎস্য অধিদপ্তরের (DOF) এবং অন্যটি IUCN-এর। DOF-এর মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এর চেয়েও বেশী সংখ্যক মাছের প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের জলজ পরিবেশে কেবল মাছই নয়, আরও অনেক জলজ প্রাণীও রয়েছে, যেমন চিংড়ি। একসময় অভ্যসন্তরীণ জলাশয়ে ২৪ প্রজাতির চিংড়ি চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু এখন তা পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে গেছে। এর কারণ হলো অবৈধ ও নির্বিচার মৎস্য আহরণ এবং পরিবেশের বিরুপ প্রভাব। এছাড়া, জলজ জীববৈচিত্র্যের মধ্যে আরও রয়েছে কচ্ছপ, সাপ, ব্যাঙ, বিভিন্ন প্রজাতির জলচর পাখি (বিশেষ করে শীতকালে হাওর ও বিলগুলোতে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে), জলজ উদ্ভিদ, যা হাওরের বিলেসমূহের বাস্তুসংস্থানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর এবং হাইল হাওরে ২০০টিরও বেশি প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছিল। এছাড়া, প্ল্যাঙ্কটনও জলজ বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ২৫-৩০ ধরণের প্ল্যাঙ্কটন চিহ্নিত করেছি। পাখির প্রসঙ্গে বলতে গেলে, পরিযায়ী পাখির সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে শীতকালে হাওর ও বিলে প্রচুর পাখি আসে এবং আবার চলে যায়। কিছু স্থায়ী পাখিও রয়েছে, যেমন:বক, ডাহুক, গাঙচিল ইত্যাদি। আমাদের জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে, বিশেষ করে হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ কিছু জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন ডলফিন সম্পর্কে বলুন।
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ বাংলাদেশের নদীগুলোতে আগে কিন্তু ডলফিন খুব দেখা যেত, ইদানিং এর সংখ্যা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। ডলফিনের যে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সে পরিবেশও পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে এর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই এর সংরক্ষণের জন্য গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তবে বিশেষ করে কোনো প্রোগ্রাম বা কর্মসূচি আছে বলে আমার জানা নেই। ইদানিং কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে কিনা, সেটাও বলতে পারছি না। তাছাড়া কাছিমের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া দরকার, বিশেষ করে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী যাদের খাদ্য তালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত। কাছিম সংরক্ষণের বিষয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এটি নিয়ে আরও গবেষণা করা দরকার, যাতে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কাছিমের প্রজনন অবমুক্তকরণের জন্য কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে কিনা, মৎস্য অধিদপ্তর কিছু উদ্যোগ নিয়েছে কিনা, তা আমার জানা নেই।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মাছ ছাড়াও এখানে আরও অনেক জলজ প্রাণী আছে। উভচর প্রাণীও আছে বলা যায়। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ একটি জলজ জীববৈচিত্র্য রয়েছে। এটি কি এখন হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কেন?
ড. আলী আজহারঃ অবশ্যই কারণ রয়েছে, এবং মানুষের কিছু অসচেতন কার্যকলাপও দায়ী। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে বড় হুমকি হলো জলাশয় ভরাট, আবহাওয়াগত পরিবর্তনের প্রভাব। ২০০০ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ৫৪টি প্রজাতি বিপন্ন ছিল, ২০১৫ সালের রিপোর্টে বিপন্ন প্রজাতির সংখ্যা আরো বেড়েছে। কিন্তু মানুষের অব্যাহত কার্যকলাপ, যেমন: বিল ভরাট করে ধান ক্ষেতে রুপান্তর, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, পোণা মাছ ধরা, বেআইনী জাল ও মাছ ধরার সরঞ্জাম ব্যবহার করে মাছ আহরণ যার ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, টাকি মাছ (ফুল টাকি মাছ) সাধারণত নদীতে বসবাস করে, তবে ব্রিডিংয়ের জন্য মাত্র ১ ফুট গভীর পানিতেও তাঁরা চলে আসে। কই মাছ ব্রিডিং করে আড়ালজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে, একেবারে অল্প পানিতে, প্রায় ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট গভীর পানিতে। আরেকটি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, যা আমি নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেছি সম্ভবত ১৯৯৭ সালে, যখন আমি মিঠামইনে ছিলাম। তখন দেখলাম বোয়াল মাছ যেটি প্রায় ১৬-১৭ কেজি ওজন হবে যে মাছ নদী বা বিলের গভীর পানিতে বসবাস করে, কিন্তু ব্রিডিংয়ের জন্য চলে এসেছে একেবারে ৪-৬ ইঞ্চি গভীর পানিতে। এটিই তার প্রজনন চরিত্র। আবহাওয়া পরিবর্তন, তাপমাত্রার ওঠানামা, জল দূষণ, এবং শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যের কারণে এবং জলাশয় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাছের প্রজননের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ কারণে জলজ প্রাণী সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এর পাশাপাশি অবৈধ জালে মাছ ধরা কি কোনো প্রভাব ফেলছে? বাজারজাতকরণ এবং কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা কি বেশি জরুরি নয়?
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ অবশ্যই, অবৈধ জালের ব্যবহার জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। বর্ষা মৌসুমে মাছ যখন ডিম পাড়তে যায়, তখন নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। এর ফলে ডিমওয়ালা মাছ ধ্বংস হয় এবং নতুন প্রজন্ম জন্ম নেওয়ার সুযোগ পায় না। এটি আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য বড় সমস্যা। এ জন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়, কারণ মানুষকে মোটিভেট করা দরকার যে এভাবে মাছ ধরা জলজ সম্পদের ক্ষতি করছে। হ্যাঁ, বাজারজাতকরণ এবং কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং নিষিদ্ধ জাল ধ্বংস করা হয়। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এখনো এগুলো উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এজন্য বাজার মনিটরিং বৃদ্ধি করা দরকার।
মাসুদ সিদ্দিকঃ মৎস্য অভয়াশ্রম একুয়াটিক বায়োডাইভারসিটি সংরক্ষণে কতটা ভূমিকা রাখবে?
ড. আলী আজহারঃ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ রামসার কনভেনশন ২০০২ সালে সই করেছে এবং ১৯৯৬ সালের পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী জলজ প্রাণী সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং অভয়াশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ সরকারের জলমহল নীতিমালা কি বাংলাদেশের জলজসম্পদ নষ্ট করার জন্য দায়ী নয়?

ড. আলী আজহারঃ অবশ্যই। যারা নীতিমালা প্রণয়ন করেন, তাদের যথাযথভাবে জলজসম্পদের বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি, ২০০৯ সালে জলমহল নীতিমালা প্রণয়নের সময় আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষে। তখন আমি জলমহল সেকশনে ছিলাম। মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি নীতিমালার খসড়া সরকারের নিকট জমা দেওয়া হয়। পরে ভূমি মন্ত্রণালয়ে সভা হয়। সভায় আমিও ছিলাম। আমাদের ডিজি (Director General) মহোদয়ের পক্ষে জনাব মো: মহিউদ্দিন স্যার, ডাইরেক্টর,অ্যাডমিন ছিলেন। এখানে একটি খসড়া গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল এটি দেখে সংশোধন করতে হবে। দেখা গেলো বর্তমান জলমহাল নীতিমালার একটি অনুচ্ছেদে বলা আছে, জলমহালে কোনো প্রকার রাক্ষসী মাছ চাষ করা যাবে না। আমি তখন বললাম, এই কথাটা তো ঠিক না। জলমহালে তো মাছ চাষ হয় না, বরং বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট টুলস সরবরাহ করা হয়। কোনো ওয়াটার বডিতে কী ধরনের মৎস্য ব্যবস্থাপনা হবে, কি কি ব্যবস্থপনা টুলস ব্যবহার করতে হবে সেটি নির্ধারীত হবে ঐ জলমহালের অবস্থান ও এলাকার অবস্থা অনুযায়ী। তাই এখানে বলা উচিত ছিল, জলমহালে কোনো প্রকার রাক্ষুসে বা বিদেশি মাছ অবমুক্ত করা যাবে না এর বেশি কিছু না। কিন্তু একজন জুনিয়র কর্মকর্তা বললেন, না, জলমহালে কোনো রাক্ষুসে মাছ চাষ করা যাবে না। এরপর এই বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং এর পরও এটি নীতিমালায় এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমি একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম, কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার খামা বিলে এক সময় প্রচুর পাবদা, বেয়াল ইত্যাদি মাছ পাওয়া যেতো, কিন্তু পরে এগুলো বিল থেকে একেবারে উধাও হয়ে যায়, এটি ছিল আঞ্চলিক অনুপস্থীতি। পরে সিবিএফএম-২ প্রকল্প থেকে পাবদা ও বোয়ালের বড় পোণা এনে এই বিটিতে মজুদ করা হয়। ফলে এক বছর পর দেখা গেল, প্রচুর বোয়াল মাছ ও পাবদা মাছের উৎপাদন হয়েছে। গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, জলমহলে রাক্ষুসে মাছ থাকলেও সেটা মাছের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং মুক্ত জলাশয়ে প্রায় ৯৫% এর বেশী মাছই রাক্ষুসে শেণীর। এরা প্রকৃতিতে একটি ভারসাম্য রেখেও বেঁচে থাকে। এ ছাড়াও বর্তমান নীতিমালায় বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। যেমন, মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনের কথা বলা হয়েছে (Fish Sanctuary), ওপেন ওয়াটরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তর অভয়াশ্রম স্থাপন করতে পারবে বলা হয়েছে। আবার হয়েছে, অনুমতি নিয়ে উন্মুক্ত জলমহাল থেকে মাছ আহরণের কথাও বলা হয়েছে, তাই বিষয়টি পরস্পর বিরোধী। নীতিমালায় এ ধরণের অস্পষ্টতা থাকলে সমস্যার সৃষ্টি করে। তবুও, সারাবিশ্বে মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদর বৃদ্ধির জন্য মৎস্য অভয়াশ্রম (Fish Sanctuary) একটি ‘বেস্ট টুল’ হিসেবে প্রমাণিত।
মাসুদ সিদ্দিকঃ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পোণা অবমুক্তি (Stocking & Release) দরকার, নাকি জলাশয়ের ম্যানেজমেন্টটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ ম্যানেজমেন্টটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র রুই, কাতলা, ও কার্প জাতীয় মাছ অবমুক্ত করা হচ্ছে। তবে এগুলোর সংখ্যা কতটা হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হচ্ছে না। এসব নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ বেশি হারে অবমুক্ত করার ফলে সেটা অন্যান্য মাছের জন্য ক্ষতিকারক কিনা সেটা দেখা ও জরুরী। কারণ এতে জলাশয়ের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের (Ecosystem) ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে অবশ্যই গবেষণার প্রয়োজন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ জলজ জীববৈচিত্র্য বলতে শুধু মাছ নয়, বরং জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল সব ধরণের প্রাণীকেই বোঝায়। তাহলে এই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য কোন প্রক্রিয়াটি বেশি কার্যকর হবে? জনগণকে সম্পৃক্ত করার উপায় কী?
ড. আলী আজহারঃ প্রথমেই বলব, জলমহাল ব্যবস্থপনা নীতিমালা সংশোধন বা আপডেট করা প্রয়োজন। আমরা জানি, মৎস্য অধিদপ্তরে বেশ কটি প্রকল্প (MACH, CPFAM-1, CPFAM-2, WBRP, FFP ইত্যাদি, এলজিইডি এর হিলিপ, হেমলিপ ইত্যাদি এবং আরও অনেক প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় নদী বা বিল ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিল। তারা সংরক্ষণ ট্যুলস (Conservation Tools) ব্যবহার করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। তবে কিছু ব্যর্থতাও ছিল, যার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। মনে হয়, গ্রাসরুট লেভেলের জনপ্রতিনিধি, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করা উচিত। কারণ, ইউনিয়নের নিজস্ব বাজেট রয়েছে। যদি নীতিগতভাবে এই বাজেটের একটি অংশ জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নির্ধারণ করা হয়, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ বাধ্য থাকবে এ বিষয়ে কাজ করতে। স্থানীয় সরকার থেকে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেখানে বাধ্যবাধকতা থাকে না যে এই টাকার একটি অংশ জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ব্যয় করতে হবে। ফলে রাস্তা-ঘাট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ শেষ হয়ে যায়। যদি বাধ্যতামূলকভাবে ৫%- ৭% বাজেট জলাশয়ের সংরক্ষণে ব্যবহারের নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে সেটি কার্যকর হতে পারে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিকভাবে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ, জলজ সম্পদ শুধু মাছ নয়, বরং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও অন্যান্য সম্পদের উৎস। যদি শুধুমাত্র সংরক্ষণের জন্য আমরা মাছ ধরা বন্ধ করে দিই, তাহলে স্থানীয় জনগণের জীবিকায় বাধা সৃষ্টি হবে। তাই স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে জৈবিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এই দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় কী? কিভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়?
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ আমাদের যে জলাশয়গুলো আছে, সেগুলোর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও জীবিকাকে মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। যদি আমরা বলি, দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকবে, তাহলে সেই সময়ে স্থানীয় জনগণ কী করবে? এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের VGD, VGF, ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম রয়েছে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ করা হয়। যদি এই কর্মসূচির আওতায় জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে তারা সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হবে। এছাড়াও, কর্মসংস্থানের বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে, প্রশিক্ষণ ও আয়মূলক কার্যক্রম চালু করা গেলে, জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য স্থানীয় জনগণই উদ্যোগী হবে। এভাবে সংরক্ষণ ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে আমরা টেকসই সমাধানে পৌঁছাতে পারবো।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এই যে ডক্টর রিয়াজ যেটা বললেন বিকল্প কর্মসংস্থান বা বিকল্প জীবিকায়ন প্রসঙ্গে, পরিবেশবান্ধব কৃষি আর ইকো-ট্যুরিজম কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন, আজহার?
ড. আলী আজহারঃ প্রথমেই আমি বলি, বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন আমাকে করতে হবে, জনগণকেও করতে হবে। অর্থাৎ, স্থানীয় জনগণ যদি অন্য কোন জীবিকায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে এটি আরও কার্যকর হবে। অল্টারনেটিভ লাইভলিহুডের অপশন তো থাকবেই। পাশাপাশি আমি উদাহরণ দেই, যেমন: পানিফল, যেটা বাংলায় স্থানীয়রা ‘সিংরা’ বলে, পদ্ম, মাখনা- এই ধরণের কিছু জলজ উদ্ভিদ আছে। পানিফল কিন্তু এখন চাষ হচ্ছে জামালপুর অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপজেলায়। পদ্ম কিন্তু চাষ হয়, মাখনা ভারতে ব্যাপকভাবে চাষ হয় এবং মাখনা দিয়ে বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করে তারা মার্কেটিংও করছে। এগুলোকে আমাদের উৎসাহিত করা উচিত। আমরা যদি সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে এগুলো আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। একসময় এগুলো বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ ছিল, কিন্তু এখন প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। দ্বিতীয়ত, আমি যদি কনজারভেশন করি, তার মানে এই নয় যে সমস্ত হাওর, বিল থেকে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। কনজারভেশনের কিছু নিয়ম-নীতিমালা মানতে হবে। যেমন, টাকি মাছের পোনা ধরা যাবে না, শোল মাছের পোনা ধরা যাবে না, বোয়াল মাছের পোণা ধরা যাবে না, ঝাটকা ইলিশ ধরা যাবে না ইত্যাদি। প্রতি বছর ০১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন- এই নির্ধারিত আট মাস জাটকা আহরণ বন্ধ রাখতে হবে, জুলাই থেকে ডেসেম্বর-এ সময় নলা মাছ যাবে না ইত্যাদি। কনজারভেশন মানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, বরং নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মাছ ধরা যাবে। ছোট মাছ ধরার জন্য মশারি জাল সারা বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা উচিত, বর্তমানে কয়েক মাসের জন্য এটি নিষিদ্ধ। বাকি সময় তারা অন্যান্য মাছ ধরতে পারে। সঠিকভাবে কনজারভেশন করা গেলে, নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিকভাবেই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে সাময়িকভাবে তাদের বিকল্প জীবিকায়নের দিকেও যেতে হবে। তৃতীয়ত, পরিবেশবান্ধব কৃষি ও অর্গানিক চাষাবাদের ওপর নজর দিতে হবে। যেমন, আমরা একসময় আইপিএম (ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট) পদ্ধতি ব্যবহার করতাম, যেখানে পোকামাকড় দমনে প্রাকৃতিক উপায় গ্রহণ করা হতো। ধানক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা লাঠি দিয়ে পাখিদের বসার ব্যবস্থা করা হতো, যাতে তারা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। ফেরোমোন ট্র্যাপ এখনো ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে সবজি চাষে। আমার নিজের বাগানেও আমি এটি ব্যবহার করি। এটি আসলে কিছুই না, একটি সাবান পানির ট্র্যাপ, উপরে ঝুলানো থাকে একটি কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করার জন্য একটি বস্তু। ফলে এর আকৃষ্ট হয়ে অসে বাট কীটপতঙ্গগুলো সাবন পানিতে আটকা পড়ে মারা যায়। এরপর আসে ইকো-ট্যুরিজম। হাওর বা জলাভূমির জন্য এটি অন্যতম সম্ভাবনাময় বিকল্প। তবে এটি সব জায়গায় কার্যকর হবে না, যেখানে উপযুক্ত পরিবেশ আছে, সেখানেই এটি কার্যকর হবে। আমি বর্তমানে যে প্রজেক্টে কাজ করছি, সেখানে ইকো-ট্যুরিজমের জন্য কিছু ইকো-ট্যুরিজম বোট তৈরি করা হয়েছে। জেলেরা এতে সম্পৃক্ত হচ্ছে, কারণ ইকো-ট্যুরিজম মানে শুধু নৌকা ভ্রমণ নয়, বরং স্ট্রিট ফুড বিক্রি, হস্তশিল্প এবং অন্যান্য পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও এর অংশ। ইতোমধ্যে বেশ কটি স্ট্রিট ফুড ভ্যান চালু করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এগুলো স্থানীয় মৎস্যজীবী পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই পরিচালনা করছে, আমরা শুধু আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি। স্পিডবোটের বদলে সাধারণ নৌকা ব্যবহার করে পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি, যাতে পরিবেশের ক্ষতি কম হয়। এ ছাড়া, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য আরও অনেক কিছু করা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রকল্পে ইতোমধ্যে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমাদের আলোচনাটি মূলত উন্মুক্ত জলাশয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে যে চরাঞ্চল জেগে উঠছে, সেখানে বনায়নেও বাংলাদেশ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামুদ্রিক শৈবাল চাষ কি বিকল্প জীবিকায়নের সম্ভাবনা হিসেবে আসতে পারে না?
ড. আলী আজহারঃ অবশ্যই! ইদানীং, বাংলাদেশ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ‘সাস্টেইনেবল কোস্টাল বেনিফিশি’ প্রকল্পের মাধ্যমে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও গবেষণার জন্য অর্থায়ন করছে। কয়েকটি সংস্থা এই বিষয়ে গবেষণা করছে, যার মধ্যে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও এআইআরডি যৌথভাবে কাজ করছে। আমার মনে হয়, আরো গবেষণা হলে ভবিষ্যতে ভালো গবেষণালব্ধ ফলাফল আসতে পারে, যা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। তবে শুধু উৎপাদন করলেই হবে না, এটি কীভাবে বাজারজাত করা হবে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। উপকূলীয় বনায়নেও বাংলাদেশ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ও বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। তবে বাংলাদেশে কোস্টাল এরিয়াতে বনায়নের কাজ এখনো সীমিত পরিসরে হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রয়োজনের এ খাতে তুলনায় বিনিয়োগ এখনো কম। যেহেতু সরকারি প্রকল্প ছাড়া এসব উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়, তাই ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমরা এ বিষয়ে আরও আলোচনা করবো, বিশেষ করে উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে। তবে তার আগে, ডক্টর রিয়াজ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সম্পৃক্ত করার জন্য কী ধরণের কৌশল নেওয়া যেতে পারে?
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ আমাদের জলাশয়গুলোর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় জনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অনেক সময় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করে। তাদের সচেতন করতে হবে, যেন তারা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জানে। অনেক সময় তারা বুঝতে পারে না যে, বায়োডাইভারসিটি ধ্বংস হলে তাদের জীবনেও কী ধরণের প্রভাব পড়বে। তাই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে তারা সংরক্ষণমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় এবং টেকসই জীবিকায়নের সুযোগ পায়।
মাসুদ সিদ্দিক: ঠিক আছে, এটা সচেতন করাটা বড় জরুরি, না? আমাদের বাচ্চাদের, আগামী প্রজন্মকে সচেতন করার জন্য শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে অথবা আমাদের প্রাইমারি লেভেলে এগুলোকে জোরালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন আছে কিনা?
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ এটা খুব ভালো উদ্যোগ হবে, কারণ আমরা যে মৎস্যভোগী বাঙালি, আমাদের জলাশয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে সারা জীবন। সুতরাং, এই জলাশয়গুলো কিভাবে উৎপাদনশীল থাকবে, কিভাবে আমাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, সে বিষয়ে বিস্তারিতভাবে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার, যাতে মানুষ বুঝতে পারে এবং সচেতন হতে পারে। এটাও একটা পদ্ধতি হতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিক: মূল্যবোধ তৈরি করবে, তারা বাচ্চাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করবে। এটা ভালো উদ্যোগ হতে পারে।
ড. আলী আজহারঃ আসলে, এটা একটা বড় ইস্যু। নীতিগতভাবে কিছু অংশ যোগ করা যায়। কারণ, এটা শুধু জাতীয় ইসু নয়, আন্তর্জাতিক বিষয়ও। যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করি, মানুষের ফুড চেইনের একটা বড় অংশ জলজ পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত। যদি এক জায়গায় কোনো সমস্যা হয়, তাহলে আমাদের পুরো খাদ্য ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে নিয়ে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, যেন সবাই বুঝতে পারে যে পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না, ছোট মাছ ধরা যাবে না। আমি একটা সহজ উদাহরণ দেই, গ্রামে যদি চোর আসে এবং কেউ চোর, চোর বলে চিৎকার করে, তাহলে শত শত মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে চোর ধরতে। এটাই সচেতনতা।
মাসুদ সিদ্দিক: আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে সাপ দেখলেই মেরে ফেলা। অথচ প্রত্যেকটি প্রাণী পরিবেশ ও খাদ্যশৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা দরকার। সরকারি উদ্যোগের কথা বলেছি, এবার বেসরকারি সংস্থাগুলো কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে? পরিবেশ ও জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তারা কী ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে? আজহার ভাই ও ডা. রেয়াজ, আপনারা কী বলবেন?
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাগুলোর একটা বড় সমস্যা হলো অর্থায়ন। অধিকাংশ সংস্থা বিদেশি অনুদান বা সরকারি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। নিজেদের অর্থায়নের সক্ষমতা অনেক কম। তবে স্থানীয় এনজিও, ক্লাব বা সংগঠনগুলোর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। স্থানীয় যুবক বা মুরুব্বিরা যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়। যেমন, বাংলাদেশে ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি হয়। একইভাবে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়েও সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। তাছাড়া যখন মোহনগঞ্জে কর্মরত ছিলাম, তখন মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি সফল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলাম। বিশেষ করে, আমরা মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম, যা অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল। মানুষ খুব সুন্দরভাবে বিষয়টি গ্রহণ করেছিল, এবং প্রোগ্রামটি সফল হয়েছিল। এছাড়া, কিছু গ্রামভিত্তিক সংগঠন জলাশয়ে মাছের চাষ করছে। সরকার যদি তাদের আরও সহায়তা দেয়, তাহলে এই কার্যক্রম আরও সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে। মৎস্য অধিদপ্তরকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিক: সবচেয়ে বড় কথা হলো, মূল্যবোধ তৈরি করা জলজ প্রাণীগুলো আমাদের উপকারে আসে, তাই এগুলো হত্যা করা যাবে না। আমি জাপানে দেখেছি, ছোট মাছ জালে উঠে এলে তারা সাথে সাথেই পানিতে ছেড়ে দেয়। আমাদের দরিদ্র জেলেদের পক্ষে এটা কঠিন, কারণ তারা মাছ বিক্রি করে আয় করে। সরকারি সংস্থার উদ্যোগের পাশাপাশি, এনডিসি ওয়েব পোর্টালও তো একটি বেসরকারি উদ্যোগ। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি মানুষের কাছে সচেতনতা পৌঁছানোর জন্য। অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাগুলোও কি এগিয়ে আসতে পারে না?
ড. আলী আজহারঃ অবশ্যই, এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। কারণ, শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগ দিয়ে কিছু সফল করা সম্ভব নয়, যদি জনসম্পৃক্ততা এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ না থাকে।
ড. রিয়াজ উদ্দিনঃ আমি উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাই এবং প্রশংসা করি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
মাসুদ সিদ্দিক: আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ।