উত্তমাশা অন্তরীপ Cape of Good Hope

আবদুস সামাদ ফারুক
সাবেক সিনিয়র সচিব

সেপ্টে ১৩, ২০২১ | প্রবাসের গল্প

Ended soon

উত্তমাশা অন্তরীপ শব্দগুলো পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম স্কুলে। অর্থ বুঝিনি, মুখস্ত হয়ে রয়েছে সারাজীবন। শৈশবে পড়া অনেক কিছু বিশেষত সম্পূর্ণ নতুন বিষয় কিংবা ভালো লাগার বিষয় মুখস্থ থেকে যায় সারাজীবন। উত্তমাশা অন্তরীপের সাথে জগৎ বিখ্যাত নাবিক ভাস্কো দা গামার নামটি স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ভাস্কো দা গামা উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ভারতের কালিকট বন্দরে পৌছান ২ মে ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।

গত ২০-২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ দক্ষিন আফ্রিকা ভ্রমণের সুযোগ পাওয়ায় Cape of Good Hope, Cape Town দেখার সুযোগ পেয়ে যাই। উত্তমাশা অন্তরীপ বা Cape of Good Hope এর কথা বার বার শুনেছি। এ বার দেখার সুযোগ পাওয়ায় অসীম আনন্দ অনুভব করি।

সরকারী কাজের শেষে কেপ টাউন ও ডারবানের বহু আকর্ষণীয় স্থাপনা দেখার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা হয়। কেপ টাউন বন্দর, পোর্ট এলিজাবেথ, ডারবান পোর্ট পরিদর্শন শেষে আমরা কেপ টাউনের ও ডারবানের আকষর্নীয় স্থান সমূহ ঘুরে ঘুরে দেখি। আমি ছাড়াও এই প্রতিনিধি দলে পায়রা বন্দর কতৃপক্ষের তিনজন পদস্থ কর্মকর্তা, নেদারল্যান্ডের Royal HasKoning DHV এর দুজন কর্মকর্তা অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। আমাদের গাড়ীর চালক ছিলেন সালেগ পেটারসন ও রফিক জ্যাকভ। ভালোমত গাড়ী চালানোর পাশাপাশি গাইড হিসেবেও তারা স্মরণীয় দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিন আফ্রিকার ইতিহাস ও পর্যটন আকর্ষণ সম্পর্কে তাদের ধারণা চমৎকার। সেটিও ছিল আমাদের আনন্দময় ভ্রমণের জন্য খুবই সহায়ক।

উত্তমাশা অন্তরীপ বলতে কী বুঝায়:
অন্তরীপ হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের কোন অংশ ক্রমশ সরু হয়ে জল অংশে সাধারণত সাগরে প্রবেশ করলে সেই সংকীর্ণ অংশকে অন্তরীপ বলা হয়। তিন দিকে জল এক দিকে স্থল। পর্তুগীজ অভিযাত্রী বার্থোলোমিউ ডিয়াজ ১৪৮৮ সালে প্রথম কেপ এলাকায় পৌছান। এই পাথুরে অন্তরীপটির নাম দেন Cape of Good Storms। পর্তুগালের শাসক দ্বিতীয় জন তার নাম পরিবর্তন করে Cape of Good Hope রাখেন। যার বাংলা অর্থ উত্তমাশা অন্তরীপ। সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাড়ায় উত্তম+আশা= উত্তমাশা। আফ্রিকান ভাষায় এর নাম Kaap Die Gioeie Hoop, ডাচ ভাষায় Kaap de Goede hoop, পর্তুগীজ ভাষায় Cabo Da Boa Esperanca।

দ্বিতীয় জন এই সমুদ্রপথটিতে ভারত ও দূরপ্রাচ্যের সাথে ইউরোপের ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের মাধ্যমে নতুন আশা দেখেছিলেন। তাই Cape of Good Hope এর নামকরণে সেই আশার প্রতিফলন দেখা যায়। উত্তাল আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব উপকূল ঘেষে বিপদ সংকুল বিক্ষুব্দ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশেষ করে Cape of Good Hope অতিক্রম করে পতুর্গীজ নাবিকরা ভারত মহাসাগর হয়ে ভারত ও দূর প্রাচ্যে পাড়ি জমান।
আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের সর্ব দক্ষিণের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। আর দক্ষিণ আফ্রিকার সর্ব দক্ষিনে ১৫০ কিমি. পূর্ব-দক্ষিণপূর্ব দিকে Cape of Good Agulhas অবস্থিত।

Cape Agulhas এর বিশেষত্ব হলো আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের স্রোত এখানে মিলিত হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের পানি গভীর নীল ও ঠান্ডা। ভারত মহাসাগরের পানি কেপ এলাকায় সবুজ ও উষ্ণ। পূর্বে ভুল ধারণা ছিল যে Cape of Good Hope আফ্রিকার সর্বদক্ষিণে এবং এখানেই দুই মহাসাগরের সংযোগস্থল।

আরব বণিকরা ভারত, সিংহল ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে মনিমুক্তা, রেশম ও সুগন্ধি মশলা সংগ্রহ করে ভূমধ্যসাগরের বন্দরগুলিতে বিক্রয় করতো। ইটালীর বণিকরা এসব পণ‌্য ইউরোপের বাজারে চালান করেন।

১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ‌্যের পতন ঘটলে প্রাচ্যের দেশগুলিতে যাতায়াতের একমাত্র স্থলপথটি ইউরোপীয়দের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখন ইউরোপের কাছে নতুন জলপথের অনুসন্ধান জরুরী হয়ে পড়ে। পর্তুগীজ নাবিকগণ নতুন জলপথ ও নতুন দেশ আবিষ্কারে সব সময়েই অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পর্তুগালের যুবরাজ হেনারী (১৩৯৪-১৪৬০) স্মরণীয় এই কারণে যে তিনি নতুন নৌ-যন্ত্রপাতি ও দিক নির্ণয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কারে সহায়ক ভূমিকা রাখেন।

বিশাল আকৃতির পাথরে পাথরে গাথা প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এই পর্বত Cape of Good Hope এর চূড়ায় পায়ে হেটে ওঠা প্রায় দুঃসাধ্য। ছোট আকারের Aerial Cable Way রয়েছে। এর এক কামরায় ভর করে আমরা চূড়ায় উঠলাম। দুচোখ মেলে তাকাতেই পশ্চিম দক্ষিণ দিকে আটলান্টিক মহাসাগরের বিস্তৃত নীল জল রাশি। মুহূর্তে মুহূর্তে একের পর এক নীল ঢেউ আঘাত হানছে Cape Point এর পাথরে পর্বতে। আর পূর্ব দক্ষিণ দিকে ভারত মহাসাগরের সবুজ ও উষ্ণ জলরাশি। দুই মহাসমুদ্রের তিন দিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলের সাথে জলের খেলা, জলের মিলন ও গর্জনে হৃদয় তখন রোমাঞ্চিত। চোখে এক অজানা শান্তির পরশ। এই Aerial Cable Way চূড়ার উপর থেকে পৃথিবীর বড় বড় শহর গুলির যথা নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনী, টরেন্টো এর দিক নির্দেশক চিহ্ন ও দূরত্ব দেয়া রয়েছে। আমরা যখন কেপের চূড়ায় আমাদের গাড়ী চালক রফিক জ্যাকভ আটলান্টিকের দিকে তাকিয়ে জানায় ঐ পাশের দেশ ব্রাজিল আর দক্ষিণে আফ্রিকা এক ভূখণ্ডে ছিল। আটলান্টিকের জন্মের মধ্য দিয়ে দুই দেশ দুই পাড়ে পড়ে যায়।

Cape Point Light House :
Cape Point এ দাড়িয়ে দুই মহাসাগরের জলের কল্লোল এবং দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলের খেলা দেখা শেষে আমরা বাতিঘর দেখতে যাই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩৮ মিটার উচ্চতায় Cape Point এ ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাতিঘর প্রথম নির্মাণ করা হয়। এই বাতিঘরটি ১৮৬০ সনের ১লা মে তারিখ থেকে আলোক বিচ্ছুরণ শুরু করে। তখন ২০০০টি মোমবাতির আলোর শক্তি নিয়ে ১২ সেকেন্ড ধরে আলোক বিচ্ছুরণ করে। সমুদ্র পথে জাহাজ এই বাতিঘরের আলোক নির্দেশ পেয়ে চলাচলে সহায়তা পায়। পরবর্তিতে ১৯৩৬ সালে অপর একটি বাতিঘর নির্মিত হয়। এই বাতিঘরটির ক্ষমতা ১৯মি. ক্যান্ডেল পাওয়ার।
Cape of Good Hope অন্য তিনটি কারণে গূরুত্বপূর্ণ। ইহা Table Mountain National Park এর অংশ। Cape Peninsula তে ডাচরা ১৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে কেপ উপনিবেশ স্থাপন করে যার ফলে কেপের পরিচিতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে এই এলাকা Cape of Good Hope Provinee সংক্ষেপে Cape Provinee হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দুই মহাসাগরে উত্তাল পথে জাহাজ চলাচলে বাতিঘরটি গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উত্তমাশা অন্তরীপ ও ভাস্কো দা গামা:
পৃথিবী বিখ্যাত এই পর্তুগীজ নাবিক প্রথম ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ আবিস্কার করেন। ১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে গামা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে যাত্রা করে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতের কেরালা উপকূলে কালিকট বন্দরে ১৪৯৮ সালের ২০ মে উপস্থিত হন। তিনি ভারত থেকে জাহাজ ভরে মসলা ও মূল্যবান দ্রব্যাদি সঙ্গে নিয়ে ফিরে যান।

এই পথ ধরেই পরবর্তীতে ওলন্দাজ, ফরাসী ও ইংরেজ বণিকরা ভারতে আসে। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কো দা গামা দ্বিতীয় বার কালিকট বন্দরে আসেন। ভারতের কোচিনে বানিজ্য কুটি স্থাপন করে।

ইউরোপ থেকে ভাস্কো-দা গামার আবিষ্কৃত পথে ৪০০ বছর ধরে প্রায় ৪ মাস সময় নিয়ে বাণিজ্য জাহাজ ভারতে আসতে থাকে। সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে ইউরোপের জাহাজ এই পথে ভারতে আসতে থাকে। পরবর্তীতে লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের সাথে সুয়েজখালের (দৈঘ্য:১৯০কি.মি. এবং গভীরতা ২৪মি.) সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় ইউরোপ থেকে ৪ সপ্তাহে জাহাজ ভারতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে এই সব জাহাজকে ৭০০০ কি.মি. পথ কম ঘুরতে হয়।

পর্তুগীজ পর্যটক ও নাবিক ভাস্কো দা গামা পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসায় ইউরোপের সাথে এশিয়া ও ভারতের ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ইউরোপের সংস্কৃতি ভারতে আসে। তারই পথ ধরে ইউরোপের অন্যান্য জাতি ভারতে আসা শুরু হয় ‍ও সাম্রাজ‌্যবাদের প্রসার ঘটে। ১৫২৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পর্তুগীজ সাম্রাজ‌্যের গর্ভনর হিসাবে ভাইসরয় উপাধি দিয়ে তাকে নিযুক্ত করা হয়।

কেপে ইউরোপীয় আগমন ও অভিযান:
আধুনিক যুগের সূচনায় প্রথম ইউরোপীয় পর্তুগীজ অভিযাত্রী বার্টো লোমিও ডায়াস ১২ মার্চ ১৪৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কেপে পৌছান। তিনি কেপের নামকরণ করেন Cape of Storms.
আদিবাসী খৈ খৈ বাসিন্দাগণ তখন কেপে বসবাস করতেন। সেখানে ডাচরা ১৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করে। খৈ খৈ জনগোষ্ঠী প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে এখানে বসবাস শুরু করে। ৬ এপ্রিল ১৬৫২ সালে কেপ থেকে ৫০ কি.মি. উত্তরে টেবল বে তে (Table Bay) ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য রসদ সরবরাহ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ডাচ কলোনী প্রশাসক হন জন রিবেক। এটাই বলা যায় Cape Town এর গোড়াপত্তন। সমুদ্রে দূরপথে যাত্রীদেরকে খাদ্য সরবরাহের কাজ এই ক্যাম্প থেকে শুরু করা হয়।

ফ্রান্স থেকে ধর্মীয় কারণে বিতাড়িত হয়ে নেদারল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া ফরাসী প্রটেষ্ট্যান্টদের একটি দল ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর Cape of Good Hope এ আগমন করে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষ কৃষক খুজছিল, তারা এ দলে পেয়ে গেল। কেপ কলোনী পরবর্তী ১৫০ বছরে কেপের উত্তর ও উত্তর পূর্বে শত মাইল বিস্তৃত হয়ে যায়।

নেপোলিয়ানের যুদ্ধের সময় ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসীরা ডাচ প্রজাতন্ত্র দখল করে। Battle of Blaauwberg এর পরে ১৯ জানুয়ারী ১৮০৬ সালে ব্রিটিশরা Cape Colony দখল করে নেয়। ১৯১০ সালে Union of South Africa প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ কলোনী টিকে থাকে এবং ১৯১০ সালে ইহা ইউনিয়নে অন্তর্ভূক্ত হয়।
(চলবে…)

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন