Ended soon
একাত্তর টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। প্রৌঢ় মা একে ডাকছেন, ওকে ডাকছেন, ছেলেকে, নাতনিকে। কারো সে ডাক শোনার সময় নেই, সবাই ব্যস্ত। বিজ্ঞাপনে পরে বলা হচ্ছে আপনার সব কথা শোনার জন্য আমরা আছি। সে তারা আসলেই আছে কিনা, এটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
বিষয় হলো আমাদের প্রৌঢ়, প্রৌঢ়া বাবা মায়েদের জীবন কি করে কাটে? তাঁরা সমাজের সবচেয়ে উপেক্ষিত অংশ। আমরা আজীবন তাঁদের আঙুল ধরে উঠে দাঁড়িয়েছি, হাঁটতে শিখেছি, জীবন গড়ে নিয়েছি। তাঁরা কখনো অপত্যে, কখনো প্রাচ্য দেশীয় সংস্কৃতির কারণে, কখনো ব্যক্তিক দায়িত্বে, কখনো সামাজিক দায়িত্বে সন্তানদের লালন পালন করেন, শিক্ষা দীক্ষা প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়ে দেন। নিজেদের জীবনের শখ আহ্লাদ অপূর্ণ রেখে সঞ্চয় করেন, অতপর সন্তানদের হাতে তুলে দেন জীবনের সর্বস্ব। বয়স হয়ে গেলে সেই সন্তানের কাছেই পিতামাতা হয়ে ওঠেন বোঝা। পিতামাতাকে সম্মান আর সময় দেয়ার মতো অবকাশ থাকেনা অধিকাংশ সন্তানের।
“তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়, তারা জীবনের সন্তান সন্ততি…” কাহলিল জীবরানের কাব্য পড়েননি অনেক বাবা মা। তাঁরা সন্তানকে ভাবেন তাঁদেরই সম্পদ। গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে জন্মদানের জীবন পণ প্রক্রিয়া, কোলের ওমে বড় করা, আধো বুলি থেকে জীবনের মহাযজ্ঞের জন্য তৈরি করে তোলা সবই যে তাদের হাত ধরে হয়। সবই যে তাদের নিজের নিঃশ্বাসের মতো চেনা। এই সন্তানদের যে নিজের জগৎ হয়, তাদের সেই জগৎে ছেড়ে দিতে হয় আমাদের প্রাচ্যের বাবা মায়েরা তা জানেন না মোটেই। উন্নত দেশের মতো এই প্রৌঢ় বাবা মায়ের দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্র বা সমাজ নেয় না, শিশুর দায়িত্বও নেয় না।
এই শিশুর যুবক বেলায় তার উপর অধিকার ছেড়ে দেয়া বাবা মায়ের কাছে মৃত্যুর মতোই নিরুপায় আর নির্মম সত্য। তাঁরা সহজে তা মানতে পারেন না। আগের জীবনে যে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সমর্থন দিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়েছেন, শেষ বয়সে সেসব ফিরে পাওয়ার ক্ষমতাও আর নেই। টের পান তাঁর সন্তান আর তাঁর নেই, এক অসহায়ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন তাঁরা। ছেড়ে দিতে হয় নিজ হাতে গড়া সংসারের অধিকার, ছাড়তে হয় সন্তানের অধিকার। সমস্ত জীবন রক্ত নিংড়ে বড় করেছেন যে সন্তানকে, নিজের মুখের গ্রাসটিও তুলে দিয়েছেন সন্তানের মুখে, আজ নিজে দুবেলা ভাতের জন্যও তাকিয়ে থাকেন সেই সন্তানদের দিকে।
আমাদের অধিকাংশ সন্তানেরা কখনোই বিষয়টি তলিয়ে ভাবে না। কখনোই বাবা মায়ের অসহায়ত্ব বুঝে তার দিকে বিশেষ নজর দেয়ার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে না। বাবা মায়ের কাছে যা আজীবনের অধিকার আঁকড়ে থাকার লড়াই, সন্তানদের কাছে তা হয়ে ওঠে উপেক্ষা আর অবহেলা প্রদর্শন। এই সংকটে পিতামাতার ভূমিকা কখনো অযৌক্তিকও হয়ে ওঠে অস্বীকার করি না। কিন্তু সমগ্র জীবনের বিনিময়ে সন্তানকে তৈরি করার পর এই বার্ধক্যে তাঁদের অধিকার আঁকড়ে থাকার অযৌক্তিকতাকে মেনে ও মানিয়ে চলার দায়িত্ব সর্বাংশে সন্তানের উপরই বর্তায়। কারণ, মূলত তাদের তখন আর কোন উপায় থাকে না। না থাকে নিজেদের আয় রোজগারের মতো শারীরিক সামর্থ্য, না থাকে আশ্রয় নেয়ার মতো কোন জায়গা। অধিকার, সংসার, আশ্রিতের মতো অপমানকর অবস্থান মেনে নিয়েও আশ্রয় হারাবার ভয়ে কুণ্ঠিত তাঁদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
আমার চারপাশে আমি কয়েকটি পরিবার দেখেছি, পিতামাতার প্রতি এমন অমানবিক আচরণ। যা পাড়াপড়শি, সালিশ বৈঠক পর্যন্ত গড়িয়েছে। আহারে, আমি নিজের চোখে দেখেছি ছোট ছেলেটা সাদা ইউনিফর্ম পড়ে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে, রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে কাঁদছে গণিতে এক কম পেয়েছে বলে। বাবা এসে আমার কাছে বৃত্তান্ত শোনাচ্ছেন, এই ভুলটার জন্য শিক্ষক এক নাম্বার কাটতে পারেন কিনা। ছেলেকে কান্না ভুলানোর জন্য আইসক্রিম কিনে দিচ্ছেন। আর আজ সেই ছেলে…!
অনেকে অভিভাবকেরও দোষ দেবেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার পেছনে দৌড়াতে শিখিয়ে স্বার্থপর করে গড়ে তুলেছেন তো অভিভাবকরাই। একথা অস্বীকার করার জো নেই। একটা ভালো রেজাল্টের জন্য ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র কিনতেও দ্বিধা করেননি তিনি। নিশ্চয়ই সে অভিভাবকেরই দোষ। কিন্তু আপাদমস্তক অনৈতিকতা আর দুর্নীতিতে ডুবে থাকা একটা সিস্টেমে অভিভাবকরাই বা কোথায় নীতি নৈতিকতা শিক্ষা পান? উপরন্তু অভিজ্ঞতা তো তাঁদের দেখিয়েছে, একটি কাগজের সার্টিফিকেট দিয়েই বিবেচিত হবে তাঁর সন্তানের ভবিষ্যত। নজরুলের মতো, ‘হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান‘ বলার মতো হিম্মত সবার কিভাবে হবে, কেনোই বা হবে? স্কুল পালানো কজনই বা রবীন্দ্রনাথ হতে পেরেছেন?
বলছিলাম আমাদের প্রৌঢ় অভিভাবকদের সময় কিংবা জীবন কাটানোর কথা। নিঃসঙ্গ দিনে বসে বসে সিরিয়াল দেখা আর দুবেলা অন্ন জোগানোর দিন থেকে আমরা কি এঁদের মুক্তি দিতে পারি না? সামান্য একটু সময়ই তো! সন্তানকে কোয়ালিটি সময় দিচ্ছি না বলে যে হাপিত্যেশ, তার থেকে একটু যদি পিতামাতাকে দেই, কতো স্বার্থক হয়ে ওঠে তাঁদের বিগত জীবনের শ্রম।