সিজারিয়ান প্রসবের সাথে শৈশবকালীন রোগের সম্পর্ক: গবেষণা প্রাপ্ত ফলাফল

মোহাম্মদ নাঈম হাসান
উন্নয়নকর্মী ও গবেষক nayeem5847@gmail.com

সেপ্টে ৮, ২০২১ | স্বাস্থ‌্যকথা

Ended soon

সিজারিয়ান ডেলিভারি (সি-সেকশন) এমন একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি যা প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে, যা মা অথবা সন্তানের জীবনের ঝুঁকির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি এটি মহিলাদের মধ্যে একটি পছন্দের পদ্ধতি হয়ে উঠেছে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে যে এটি স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে ব্যথাহীন, আরামদায়ক, নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর। সি-সেকশন ডেলিভারির হার বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত বেশ কয়েকটি সাধারণ রোগে ভুগছে। যেমন জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ইত্যাদি। বেশ কয়েকটি গবেষণায় শৈশবের নির্দিষ্ট কিছু রোগের ক্ষেত্রে মা বা শিশুর বৈশিষ্ট্যগুলোর উপর সামাজিক-জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রভাবের তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু সি-সেকশন এবং শৈশবকালীন রোগের মধ্যে সম্পর্ক এবং/অথবা সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণগুলো চিহ্নিত করা ও শৈশবের রোগগুলোকে একত্রিত করে তার উপর প্রভাব বিস্তারকারী সম্ভাব্য সকল কারণ চিহ্নিত করার মতো গবেষণা বাংলাদেশে এখনও হয়নি।

সম্প্রতি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায় এসব বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করা হয়। সংক্ষেপে, গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল সি-সেকশন এবং শৈশবের রোগের মধ্যে সম্পর্ক পরীক্ষা করা এবং শৈশবের রোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা।

২০২০ সালে গবেষণাটির উপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নাল এ প্রকাশিত হয়। এ গবেষণায় আরও যুক্ত ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাঈম হাসান, জেনিফার জাহান, সুমাইয়া জাহান, ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা কলেজ অফ মেডিসিন, ডিপার্টমেন্ট অফ ইমারজেন্সি মেডিসিন এ কর্মরত মুহাম্মদ আব্দুল বাকের চৌধুরী এবং ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এপিডেমিওলজি বিভাগ এর শিক্ষক ড. নেছার উদ্দিন আহমেদ।

এই গবেষণায় মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে [এমআইসিএস (MICS), ২০১২ এবং ২০১৯] এবং বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে [বিডিএইচএস (BDHS), ২০১১ এবং ২০১৪] থেকে চারটি জাতীয় প্রতিনিধিত্বমূলক ডাটা সেট ব্যবহার করা হয়েছে এবং ২৫,২৭০ জন মা ও সন্তানদের নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। শৈশবের সাধারণ রোগের (জ্বর, ছোট বা দ্রুত শ্বাস, কাঁশি, মলের সাথে রক্ত এবং ডায়রিয়া) পৌন:পুনিকতা-কে (Count) ডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবল (dependent Variable) এবং সি-সেকশনকে এক্সপোজার ভেরিয়েবল (exposure variable) হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মায়ের বয়স, বসবাসের স্থান, বিভাগ, মায়ের শিক্ষা, সম্পদের সূচক, শিশুর বয়স, শিশুর লিঙ্গ এবং জন্মের সময় শিশুর আকার মডেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডাটা এনালাইসিস (data analysis) করতে নেগেটিভ বাইনোমিয়াল রিগ্রেশন (Negative Binomial Regression) মডেল ব্যবহার করা হয়েছে।

বিডিএইচএস(BDHS) ডাটাতে সি-সেকশনের প্রাদুর্ভাব ২০১১ সালে ১৭.৯৫% থেকে ২০১৪ সালে ২৩.৩৩% হয়েছে। এছাড়াও, এমআইসিএস (MICS)-এ আট বছরের মেয়াদে (২০১২ সালে ১৭.৭৪% থেকে ২০১৯ সালে ৩৫.৪১%) প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। উভয় জরিপে শৈশবের রোগের উপর সি-সেকশনের কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। শুধুমাত্র ২০১৪ বিডিএইচএস(BDHS)-এ দেখা যায় যে সি-সেকশন ৫% শৈশব রোগের ঝুঁকি বাড়ায় [Risk Ratio (RR): 1.05, 95% CI: 0.95, 1.17, p = 0.33]।

শৈশবকালীন রোগের ঝুঁকি পরীক্ষার জন্য অন্য সব ভেরিয়েবল মডেল এ যুক্ত করার পর বিভাগীয় শহরগুলোতে সমস্ত জরিপের বছরগুলিতে শিশুর বয়স এবং জন্মের সময় শিশুর আকারের উপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম বিভাগে বসবাসকারী শিশুদের রোগের ঝুঁকি বেশি [2011 BDHS RR: 1.22, 95% CI: 1.08, 1.38] এবং ঢাকা বিভাগে যা (2019 MICS RR: 1.21, 95% CI: 1.08, 1.35)। মাতৃত্বের বয়স, শিক্ষা এবং সম্পদের সূচক কিছু জরিপের ফলাফলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখিয়েছে।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশে সি-সেকশন ডেলিভারি সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও আমরা সি-সেকশন ও শৈশবকালীন রোগের মধ্যে তিনটি সার্ভে ডাটাতে উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাইনি, কিন্তু বিডিএইচএস ২০১৪ এর ফলাফলে সি-সেকশন বৃদ্ধির সাথে সাথে শৈশবকালীন রোগের কিছুটা বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। যেহেতু সি-সেকশন ও শৈশবকালীন রোগের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, অতএব আমরা ধারনা করতে পারি যে এখনই এর লাগাম টানা না হলে ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও প্রখর হতে পারে। উচ্চ সি-সেকশন হার মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর যেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপরও চাপ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে আমরা বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর সুপারিশ করছি।

এই গবেষণা কাজটি সম্পর্কে বিস্তারিত কেও জানতে আগ্রহী হলে, নিচে প্রদত্ত লিংকে দেখে আসতে পারেন।

https://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371%2Fjournal.pone.0242864&fbclid=IwAR2xPtRVJlZ4sNlD6nd_G4Lg7gGRmpeWwKens2kiATz719SrbpmGIvmhmHA

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন