পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোঃ ভবিষ্যতের নির্মাণ শিল্প
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD)লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোঃ ভবিষ্যতের নির্মাণ শিল্প। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন ড. মো. আমিরুল ইসলাম, পানি সরবরাহ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ এবং ইঞ্জিনিয়ার রাফায়েল ত্রিপুরা, পরিবেশবিদ ও পরামর্শক এশিয়ান ডেবলপমেন্ট ব্যাংক। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক, ব্যবস্থাপনাপরিচালক, এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ২৭/০২/২০২৫ তারিখ রাত ০৮:০০ টা থেকে ৯.০০ মিনিট।
মাসুদ সিদ্দিকঃ ইকোফ্রেন্ডলি ইনফ্রাস্ট্রাকচার সম্পর্কে আপনি একটু প্রাথমিক ধারণা দিতে পারেন, পরিবেশবান্ধক অবকাঠামো বলতে কি বোঝানো হয়?
আমিরুল ইসলামঃ পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ বলতে আমরা বুঝি যে, আমরা যখন কোনো কাজ করি, সেটার একটি সুফল তো থাকে, কিন্তু তার পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর দিকও থাকতে পারে। যেমন, রান্নার সময় আমরা আগুন জ্বালিয়ে বাতাসে অক্সিজেন কমিয়ে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করি। দীর্ঘদিন এই গ্যাসের সংস্পর্শে থাকলে ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে যেসব মা-বোনরা রান্নার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তারা এর প্রভাব অনেক বেশি অনুভব করেন। এছাড়াও, নির্মাণ কাজের সময় সিমেন্টের ধুলাবালি এবং অন্যান্য উপাদান আমাদের শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যদি শ্রমিকরা সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না নেন, যেমন মাস্ক না পরা, তা হলে তাদের স্বাস্থ্য বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। এভাবে, সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিলে নির্মাণ কর্মীরা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, যেমন পায়ে রডের খোঁচা বা মাথায় ইট পড়া, যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তাই, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের সময় এইসব বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি।
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ যদি আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাই, ২০০০ সালে পৃথিবীর বিশ্ব নেতারা যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (MDG) নির্ধারণ করেছিলেন, তার মধ্যে ৮টি গোল ছিল। এই গোলগুলোর মধ্যে সপ্তম যে গোলটি ছিল, সেটা ছিল “এনভায়রনমেন্টাল সাস্টেইনিবিলিটি”। সেই সময় থেকেই পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছিল, এবং এমডিজি এর সময়সীমা ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার পর, এসডিজি (SDG) ২০৩০ সালের টার্গেট নিয়ে আমাদের সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ এসেছে। আশ্চর্যজনকভাবে যেখানে পরিবেশগত সাসটেনিবিলিটির লক্ষ্য ছিল সপ্তম পয়েন্টে, সেখানে এসডিজিতে এটি আরও বিস্তৃত হয়ে ষষ্ঠ থেকে ত্রয়োদশ পয়েন্ট পর্যন্ত চলে গেছে। ফলে, পরিবেশের সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় এখন আরো গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে, এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, যেমন প্রগ্রেস রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, বিশ্ব মাত্র ১৭% ট্র্যাকের মধ্যে রয়েছে। এর পেছনে কোভিডের প্রভাব এবং পৃথিবীজুড়ে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ কাজ করেছে। এখন, যখন পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলা হয়, তখন বুঝতে হবে, “পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো” আসলে কী। একে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, “একটি উন্নয়ন যেটি বর্তমানের চাহিদাগুলো পূরণ করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনীয়তা পূরণের ক্ষমতাকে আপস না করে।” অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশ বান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করা, যেটি তাদের জন্যও একইভাবে নিরাপদ এবং টেকসই থাকবে। যদি শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজন চিন্তা করি, তবে ভবিষ্যতে যে পরিবেশগত সংকট তৈরি হবে, সেটা উপেক্ষা করা হবে, কিন্তু আমাদের উচিত এমন অবকাঠামো নির্মাণ করা, যাতে তারা নিরাপদে বাস করতে পারে, এবং সেই অবকাঠামো পরিবেশের উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। এটি আমাদের দায়িত্ব, কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদের মতো পরিবেশের অধিকারী হয়ে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন কাটাতে পারবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমরা জানি যে, যেকোনো ধরণের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যেমন ড্যাম, টুরিস্ট গেট, ব্রিজ, বা মাল্টিস্টোর্ড বিল্ডিং শুরু করার আগে আমাদের একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হয় – পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA)। এটি কেন করা হয় এবং এর পরে কীভাবে আমরা যে রেকমেন্ডেশনগুলো পাই, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করি, তা নিয়ে আমিরুল ভাই আপনি একটু বিস্তারিত বলবেন?
আমিরুল ইসলামঃ আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো প্রজেক্টের জন্য পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) করা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজেক্ট ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক ক্যাটাগরি হচ্ছে ‘রেড ক্যাটাগরি’। এই ক্যাটাগরির প্রজেক্টগুলোর জন্য আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র (Environmental Clearance) নিতে হয়, যার মধ্যে EIA একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। EIA প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা প্রথমে প্রকল্পের সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাবগুলি চিহ্নিত করি এবং তার পরেই কীভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নির্ধারণ করা হয়। তারপরে, যখন প্রকল্পের অনুমোদন পাওয়া যায়, তখন কাজের চলাকালে রেকমেন্ডেশনগুলো মনিটর করা হয় এবং বাস্তবায়ন করা হয়।
মাসুদ সিদ্দিকঃ রেড ক্যাটাগরির প্রজেক্ট, কিন্তু এ ধরণের প্রজেক্টের রেটিং বা ক্যাটাগরি কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? কোন সূচক বা ইন্ডিকেটর দেখে?
আমিরুল ইসলামঃ রেড ক্যাটাগরিতে বড় বড় শিল্প কারখানা, ১০০ ফুটের উপরে ব্রিজ, রাস্তা, রাসায়নিক কারখানা এবং অন্য অনেক ধরনের প্রজেক্ট অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমে পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা চিহ্নিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি রাস্তা বা ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা চিহ্নিত করি, পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে যেমন ধুলা, শব্দদূষণ, পানি দূষণ, এবং আরো অনেক কিছু। এর পরিপ্রেক্ষিতে, পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়তে পারে, তা কমানোর জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরে, যদি কোনো প্রকল্পের জন্য কিছু রিকমেন্ডেশন দেওয়া হয়, তাহলে তা কিভাবে মনিটর করা হয় এবং বাস্তবায়ন হয়? একটি উদাহরণ দিয়ে কি বুঝানো যাবে?
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ আমি সম্প্রতি বান্দরবনে আছি, যেখানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বেশ কিছু প্রকল্প শুরু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এখানে ৭৫ মিটার একটি ব্রিজ তৈরি হবে, যা এখনই টেন্ডারে চলে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ৬০টি ক্লিয়ারেন্স আমরা ইতিমধ্যেই নিয়েছি। এর পরেও, সোশ্যাল অ্যাসেসমেন্ট, রিসিটেলমেন্ট প্ল্যানসহ আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমরা সাইটে গিয়ে টোপোগ্রাফিক পরীক্ষা, সয়েল টেস্টিং করেছি এবং আশেপাশে বসবাসরত মানুষের জীবনের ওপর কী ধরণের প্রভাব পড়বে, তা খেয়াল রেখে ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করেছি। এর মধ্যে ধুলাবালি এবং শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, যেমন, পানি ছিটানো, শেডিং স্থাপন, এবং কাজের সময় নির্ধারণ।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আরও স্পেসিফিকভাবে বলতে চাই যে, আমি নিজে দেখেছি হালদা নদীর উপর একটি বিশাল সুইচ গেট ছিল। এই সুইচ গেটটি চালু করার পর হালদা নদীর যে অংশে বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের প্রজনন হয়, সেই অংশটা শুকিয়ে গেছে অথবা সমুদ্র থেকে লবণাক্ত পানি ভেতরের দিকে চলে এসেছে। এটা যে একটা বড় সুইচ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল এবং বহু টাকা খরচ করা হয়েছিল, পরে এটিকে রেমিডিয়াল মেজার নেওয়ার জন্য পরিবেশবান্ধব করা হয়েছে। তাহলে এই ধরণের বিশাল নির্মাণের আগে এসব বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত নয় কি? আপনার মন্তব্য কী?
আমিরুল ইসলামঃ আসলে আমাদের দেশে আমরা পূর্বে এ ধরণের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করতে একটু বিলম্বিত হয়েছিলাম। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে কিছু উদাসীনতা ছিল, কিন্তু এখন তারা এগিয়ে এসেছে এবং এখন প্রতিটি কাজে Environmental Management Plan তৈরি করতে হয়। যেমন, যদি রাস্তা নির্মাণ করেন, তখন সেই রাস্তার কারণে একাধিক সমস্যা হতে পারে। প্রথমত, রাস্তা নির্মাণের ফলে যে সামাজিক বন্ধন ছিল, তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যদি রাস্তা বনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে বনাঞ্চলের জীবজন্তুর জন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। আবার, যদি সঠিক পরিমাণে ড্রেন বা কালভার্ট না থাকে, তবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। এই কারণে, যে পরিমাণ কালভার্ট বা ব্রিজ দরকার, তা নিশ্চিতভাবে তৈরি করতে হয়। এছাড়া, মেশিন চালানোর ফলে শব্দ দূষণ হয়, যা আশেপাশের মানুষ, বিশেষত স্কুল বা বস্তির মানুষের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে। এজন্য, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে যন্ত্রপাতির মান ও পার্টসগুলো নিয়মিত মেরামত করা উচিত। আরেকটি উদাহরণ হিসেবে, যখন নির্মাণ কাজ করা হয়, তখন ব্যবহৃত পানি পুকুর বা নদীতে পড়ে গিয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটাতে পারে। সেক্ষেত্রে, সেই পানি পিউরিফাই করে দূষিত পদার্থগুলো সরিয়ে ফেলে পুনরায় ব্যবহার করা উচিত অথবা নির্দিষ্ট স্থানে জমা করা উচিত। এই ধরনের নানা কার্যক্রমকে অবশ্যই পরিকল্পনা করে ও সিরিয়ালভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমরা আরেকটা উদাহরণ দিতে পারি, যেমন বাংলাদেশের নিকলী হাওরে যে অল ওয়েদার রোড তৈরি করা হয়েছে, সেটা এখন একটি পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে। কিন্তু, এই হাওরটি কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে হাওরের জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্য সম্পদের উপর, সেটা এখন আমরা বুঝতে পারছি। ভবিষ্যত চিন্তা না করে কোনো কিছু নির্মাণ করা উচিত নয়। আমরা আরেকটা কথা শুনে থাকি, যে ওয়েল ডিজাইন, ওয়েল প্ল্যান্ট, স্মার্ট কনস্ট্রাকশন, এই যে স্মার্ট নির্মাণ প্রযুক্তি এ বিষয়ে আপনি একটু বলুন, স্মার্ট নির্মাণ প্রযুক্তি কিভাবে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করবে?
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ এখন আমরা চিন্তা করছি যে পরিবেশবান্ধব স্মার্ট ডিজাইন, যেখানে শুধু অবকাঠামো নয়, বরং একাধিক দিকের চিন্তা থাকবে। এই যেমন, সোশ্যাল ইনক্লুশন এটা ২০১০ থেকে এখন পর্যন্ত একটা নতুন চাহিদা হিসেবে এসেছে। প্ল্যানিং, কনস্ট্রাকশন, আর ইকোনমিক সাসটেইনেবিলিটি, সোশ্যাল সাসটেইনেবিলিটি, অর্থাৎ ওয়েলবিং, ইকনোমিক ওয়েলবিং, আর এনভায়রনমেন্টাল ওয়েলবিং এই সব কিছু একত্রিত করেই ডিজাইন করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, একটা রাস্তা তৈরি করার সময় আমরা শুধু রাস্তা তৈরির কথা ভাবি না, বরং কমিউনিটির মতামত এবং প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করি। যেমন, মাটি কাটার ক্ষেত্রে, কেবল কাটলেই হবে না, আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে কীভাবে সেটা সাস্টেইনেবল রাখা যাবে, পাহাড়ি এলাকায় স্লোপের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে। এছাড়া, কমিউনিটির অধিকার, বিশেষত ইন্ডিজেনাস জনগণের অধিকার এবং জেন্ডারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন রাস্তা তৈরি করতে চাই যা সকলের জন্য সমানভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য হবে এবং যা পরিবেশগতভাবে নিরাপদ থাকবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ স্মার্ট কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি, যেমন শব্দ দূষণ কমিয়ে নির্মাণ করা, নির্মাণ সামগ্রী এমনভাবে ব্যবহার করা যেন তা বাতাস বা আশেপাশে দূষণ না সৃষ্টি করে, এসব বিষয় বাংলাদেশের নির্মাণ প্র্যাকটিসে কোথায় সমস্যা আছে? কেন আমাদের দেশে বিদেশের মতো কনস্ট্রাকশন সাইটে পর্দা দিয়ে ঘেরা থাকে না?
আমিরুল ইসলামঃ সমস্যাটা হচ্ছে মানসিকতা ও প্রয়োজনীয় প্রভিশন না থাকা। প্রকল্পে যথাযথ প্রভিশন রাখতে হবে এবং এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। ঠিকাদার এবং প্রকল্প পরিকল্পনাকারীদের এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। কেবল পরিকল্পনা করে থাকলে হবে না, বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, একটি বিল্ডিং নির্মাণের সময় ইট যদি কারো মাথা বা শরীরের উপর পড়ে, তাহলে সেটি বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। সেজন্য বিল্ডিং নির্মাণের চারপাশে পর্দা লাগানো প্রয়োজন। রাস্তা নির্মাণেও একই রকম ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে পানি বা অন্যান্য বর্জ্য আশেপাশের জলাশয়ে না গিয়ে পানির দূষণ না হয়। আমাদের দেশে অনেক সময় পুকুরের পানি আমরা ব্যবহার করি, সেই পুকুরে গোসল করি, রান্না-বান্না করি, আবার সেই পুকুরেই প্রসাব-পায়খানা চলে যায়, ফলে পানি দূষিত হয়ে যায়। এর ফলে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্যও হুমকিস্বরূপ। যেমন ধরুণ, হাওরের ইনফ্রাস্ট্রাকচারগুলো আমরা দেখি এসব ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কারণে বা অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ওপর কী ধরণের হুমকি আসছে বা ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে? আপনারা যে কাজ করছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
আমিরুল ইসলামঃ হাওর, বিল, বন এগুলো বিশেষ শ্রেণির প্রাণীদের জন্য অভয়াশ্রম। যদি কোনো বিলে আমরা অনবরত ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালাই বা পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন ঘটাই, তাহলে সেখানে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া, যখন রাস্তাঘাট বা ব্রিজ নির্মাণ করা হয়, তখন শুধু মানুষের চলাচলে সুবিধা হয় না, বরং প্রাণীগুলোও তাদের আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। এছাড়া, কৃষিক্ষেত্রে কীটপতঙ্গ দমনের জন্য আমরা ইনসেক্টিসাইড ও পেস্টিসাইড ব্যবহার করি, যার ফলে শুধু ক্ষতিকর পোকামাকড়ই ধ্বংস হচ্ছে না, বরং আমাদের জন্য উপকারী পোকামাকড় ও দেশি মাছও বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। এখন আমরা লক্ষ করছি, অনেক জলাশয়ে বা পুকুরে দেশি মাছের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এই সব সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সচেতন হতে হবে, এবং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।

মাসুদ সিদ্দিক: পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতা অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এর বাইরে আর কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে এনভায়রনমেন্ট-ফ্রেন্ডলি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে?
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রথমত, আপনি ঠিকই বলেছেন, মানসিকতার বিষয়টি একটি বড় বাধা। আমি যদি আমার এলাকার কথা বলি, অহরহ দেখি মানুষ পাহাড় কেটে ঘর বানাচ্ছে, রাস্তা নির্মাণ করছে। এতে গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ২০-৩০-৪০ বছর আগে যেখানে সহজেই পানি পাওয়া যেত, এখন তা আর পাওয়া যায় না। এর মূল কারণ হলো আমাদের স্বার্থপরতা। আমরা প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দিচ্ছি না। নদী, খাল, বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, বালি ও পাথর উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।এখন যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাব? আমি সব সময় এই বিষয়টি বলে আসছি এবং যেখানে সুযোগ পাই, সেখানেই বলি। মানুষের এই স্বার্থপরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকার, পরিবেশবিদ ও এনজিওদের সমন্বিতভাবে প্রচারণা চালিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নইলে, আগামী দিনেও একইভাবে চলতে থাকলে আমরা প্রকৃতির সব কিছু হারিয়ে ফেলব। এজন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতি ও কড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।
মাসুদ সিদ্দিকঃ একই সাথে, এই যে প্রজেক্টগুলো ডিজাইন করা হয়, ডিজাইনিং স্টেজে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ বা অপারচুনিটি বা রিসোর্স রাখি না, বিশেষ করে ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট রাখি না। এই ধরণের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কি মনে হয় যে সরকারের আরও সচেতন হওয়া দরকার? পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে ডিজাইনটাও সেভাবে হওয়া উচিত, তাই না?
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ ইদানিং, বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং জাইকার সাথে আমি প্রায় সাত বছর কাজ করেছি। এই সমস্ত সংস্থাগুলোর কনসার্ন হলো, যে কোনো ডেভেলপমেন্ট কাজ করতে গেলে তাদের অবশ্যই একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট করতে হয়। এটি একটি বিশাল ব্যাপার। এই ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টের মধ্যে, যদি একটি সামান্য টিউবওয়েল ইনস্টলও করতে হয়, তাহলে ৬০ থেকে ৭০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট তৈরি করতে হয়। এতে অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও অন্যান্য বিষয় ইনক্লুড করা হয়।
এই প্ল্যানিং এখন বিভিন্ন সংস্থাগুলো করে থাকে এবং শুধু প্ল্যানিং করেই থেমে থাকে না, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ও তারা টাইম টু টাইম এটি মনিটর করে। প্রকল্পের সাথে যারা জড়িত, যেমন ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি ও ইনডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। আমি গত ১০-১২ বছর ধরে এই কাজের সাথে জড়িত ছিলাম, তাই জানি যে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোতে এবং অন্যান্য প্রকল্পগুলোতেও যদি এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে আশা করা যায়, ভবিষ্যতে আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে পারবো।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমাদের প্ল্যানিং ও ডিজাইনিং তো করা হয়, বিশেষ করে কনস্ট্রাকশন প্ল্যানেও বাজেট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু প্রপার মনিটরিং হয় কি? কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয় কি?
আমিরুল ইসলামঃ সরকার এখন উদ্যোগ নিয়েছে যে সব প্রকল্পেই একটি এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং ব্যবস্থা থাকবে এবং পরিবেশগত কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট বাজেট সংযুক্ত থাকবে। প্রতিটি প্রকল্পের এস্টিমেটে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে এবং বাজেটও নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, তা নিবিড়ভাবে মনিটর করা দরকার। ঢাকাতে কিছু ক্ষেত্রে এখন এটি অনুসরণ করা হচ্ছে। কর্মচারীরাও সঠিক পোশাক ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে কাজ করছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চল বা অন্যান্য জায়গায় এই বাস্তবায়ন কম দেখা যায়। ঠিকাদার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই মনিটরিং ছাড়া কাজ করে ফেলে। বিশেষ করে রাস্তা নির্মাণের সময় দেখা যায়, কারও জমি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। এটি একটি বড় সমস্যা। এসব মনিটরিংয়ের জন্য প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদদের আরও সক্রিয় হতে হবে। সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় জনগণের মতামত গ্রহণ করা উচিত, যাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। উদাহরণস্বরূপ, বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানোর কারণে কারও জমির ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হলে তাকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার। এসব মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি।
মাসুদ সিদ্দিকঃ পরিবেশগতভাবে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে আমাদের কি কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালের গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার?
আমিরুল ইসলামঃ হ্যাঁ, যেমন আমরা ইট ব্যবহার করি। বর্তমানে কৃষিজমির মাটি কেটে ইট তৈরি করা হয়, যা ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট করে। এর ফলে টপ সয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জমি গর্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কৃষিকাজ সম্ভব হয় না। বিকল্প হিসেবে মডিফাইড ব্রিকস ব্যবহার করা যেতে পারে, যা এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন করছে। এসব ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির ওপর চাপ কমানো সম্ভব। এছাড়াও, ব্রিক ফিল্ডের ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশকে দূষিত করে, যা গাছপালা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই, সরকার বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে কী পরিকল্পনা করছে, তা আমাদের জানা দরকার।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমার প্রশ্ন হলো সরকারের কি এমন কোনো পরিকল্পনা আছে যেখানে বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে? যেমন, আপনি একটু আগে “মডিফাইড ব্রিক্স” সম্পর্কে বললেন। একইভাবে, মেন্ট বা রডের ক্ষেত্রে এই “মডিফাই” ধারণাটি কীভাবে প্রযোজ্য?
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ ব্রিক ফিল্ডগুলো বন্ধ করার একটি পরিকল্পনা আছে, যা ২০২৭ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য এটি ধাপে ধাপে নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে, সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে ব্রিক ফিল্ড বন্ধ করার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের সমঝোতার ভিত্তিতে স্থানীয় চাহিদা বিবেচনা করে কিছু ব্রিক ফিল্ড এখনো চালু রয়েছে। হঠাৎ করে সব ব্রিক ফিল্ড বন্ধ করা সম্ভব নয়, কারণ বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী এখনো পর্যাপ্তভাবে সহজলভ্য হয়নি। ইট নির্মাণ খাতটি কন্সট্রাকশন সেক্টরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে বার্ন করা ইটের বিকল্প হিসেবে রেডিমেড ব্রিকস পাওয়া যাচ্ছে, যা পোড়ানোর প্রয়োজন হয় না। এছাড়া, সান-ড্রাই ব্রিক, সিমেন্ট ও মাটির মিশ্রণে তৈরি বিকল্প নির্মাণ সামগ্রীও ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, এগুলো এখনো চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নয়। এই সেক্টরে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন প্রয়োজন। সরকার যদি ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করে, তবে এসব পরিবেশবান্ধব সামগ্রী আরও সহজলভ্য হবে। বর্তমান রেডিমেড ব্রিকের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই এটি আরও সাশ্রয়ী করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যদি সরকার ও ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে আরও পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করতে পারব, যা পরিবেশের জন্য ভালো হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের কী ধরণের নীতিগত সুপারিশ থাকতে পারে? ইকো-ফ্রেন্ডলি অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার কী ধরণের নীতি নির্ধারণ করতে পারে?
আমিরুল ইসলামঃ আমাদের দেশ আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যায় অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার কারণে কন্সট্রাকশন খাতে চাহিদা ব্যাপক। এর ফলে প্রচুর ইট ব্যবহৃত হয়, যা কৃষিজমি ধ্বংস করছে। এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড নষ্ট হওয়ার কারণে সেখানে ভবিষ্যতে কৃষিকাজ করা সম্ভব হয় না। তাই সরকারকে এ বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে সরকার যদি কিছু বিকল্প নির্মাণ সামগ্রীকে ভর্তুকি-সহায়তা (সাবসিডি) দেয়, তাহলে পরিবেশবান্ধব, মেশিন-প্রসেসড ব্রিকস সহজলভ্য হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আমরা রেমিডিয়াল মেজারগুলো সম্পর্কে আপনাদের কাছে জেনেছি বা শুনেছি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো (Environment-friendly Infrastructure) উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা কী হওয়া উচিত? আপনার সুপারিশ কী? আপনি একটি বা দুটি সুপারিশ বলুন।
আমিরুল ইসলামঃ সরকারের প্রথম এবং প্রধান সুপারিশ হলো, যে কোনো প্রকল্পে পরিবেশ সংরক্ষণের কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করা। বর্তমানে এগুলো বাধ্যতামূলক থাকলেও কার্যকর মনিটরিং নেই। পাশাপাশি, জনগণকে এ বিষয়ে আরও শিক্ষিত করা দরকার। প্রস্তুতির ওপর সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং জনগণকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দিতে হবে। আমি মনে করি, মিডিয়া এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একটি উদাহরণ দিই আগে গ্রামে স্যানিটারি ল্যাট্রিনের প্রচলন ছিল না, সবাই ওপেন ল্যাট্রিন ব্যবহার করত। প্রথম দিকে ডিপিএইচই মিরেশ্বরাই এ কিছু স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরি করে বাড়িতে বিতরণ করেছিল, কিন্তু মানুষ তা ঠিকভাবে ব্যবহার করেনি। পরবর্তীতে, যখন সচেতনতা বৃদ্ধি করা হলো এবং ল্যাট্রিনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করা হলো, তখন ধীরে ধীরে এটি জনপ্রিয়তা পায়। প্রায় ১৫-২০ বছর পর এখন গ্রামাঞ্চলে ৯০% মানুষ স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। ঠিক একইভাবে, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্যও সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এবং সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ সরকারের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা কী হবে? অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
রাফায়েল ত্রিপুরাঃ সরকারের তরফ থেকে প্রথমত সচেতনতা সৃষ্টি করা একটি বিশাল কাজ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্র পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। যেমন, আমি দেখেছি বান্দরবানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের জন্য মাত্র একজন কর্মকর্তা আছেন, যার কোনো যানবাহন বা প্রয়োজনীয় জনবল নেই। এই ধরনের ঘাটতি দূর করতে হবে। তৃতীয়ত, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরির জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সরকারকে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবেশ, নবায়নযোগ্য শক্তি (সোলার, হাইড্রো পাওয়ার), বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি ও স্যানিটেশন এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে, টেকসই প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ রক্ষার সচেতনতা তৈরি করা দরকার, যাতে তারা ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনাদের ধন্যবাদ।