জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসন: কারণ ও প্রতিকার
এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD)লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসন: কারণ ও প্রতিকার। আলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক, উপাচার্য মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এবং জনাব আব্দুল করিম কিম, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও সদস্য সচিব ,ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সিলেট। আলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব আব্দুল হাই চৌধুরী, পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ০৬/০২/২০২৫ তারিখ রাত ০৮:০০ টা থেকে ৮:৪৫ মিনিট।
আব্দুল হাই চৌধুরীঃ সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, আমরা সেটাকে ‘ক্লাইমেট ইনডিউসড ইম্প্যাক্ট’ বলছি। এই প্রভাবের কারণে বিভিন্ন খাতে নানামুখী পরিবর্তন ঘটছে। তাই, ডক্টর জাহিরুল হক, আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে চাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসন কীভাবে হচ্ছে? মানুষ কীভাবে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে? আমি মূলত ধারণাগতভাবে স্পষ্ট করতে চাই, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অভিবাসন কি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, নাকি এটি বহুমাত্রিক ও বিস্তৃত পরিসরে ঘটছে?
ড. জাহিরুল হকঃ জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে এখন সবাই অবগত। ২০-২৫ বছর আগে এটি নিয়ে আলোচনা কম হলেও এখন এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্পষ্ট। ১৯৬০-এর দশক থেকে জলবায়ু পরিবর্তন চলমান থাকলেও তখন মানুষ এটিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আজ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় ও জলবায়ু হটস্পটে অবস্থিত দেশগুলো এর বিরূপ প্রভাব গভীরভাবে অনুভব করছে।জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। অভিবাসন প্রধানত দুই ধরণের হতে পারে- আন্তর্জাতিক অভিবাসন: এক দেশ থেকে অন্য দেশে বা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে স্থানান্তর। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন: একই দেশের ভেতরে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর, যেমন: ঢাকা থেকে সিলেট বা খুলনা থেকে বরিশাল ইত্যাদি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মূলত অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অভিবাসন মানবসভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তবে বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসনের পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, ২০২১ সালে প্রায় ২ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসিত হয়েছিলো। এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১৯ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ ও প্রভাবশালী একটি বিষয়। যেমন উন্নত জীবনের আশায় কেউ যদি বিদেশে চলে যায়, সেটি আকর্ষণজনিত অভিবাসন (Pull Factor)। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অভিবাসন বাধ্যতামূলক, যেখানে মানুষকে জীবনধারণের জন্য স্থানান্তরিত হতে হয় (Push Factor)। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরার প্রকোপ, নদীভাঙন ও কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা মানুষের বাসস্থান ও জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং টেকসই সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি।কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যা সমাধানের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতির মাধ্যমে আমরা এই সংকট মোকাবিলা করে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
আব্দুল করিমঃ আমাদের কাজ হলো পরিবেশ রক্ষা করা এবং পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা। আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশের ক্ষতির বিভিন্ন দিক প্রত্যক্ষ করছি, যা প্রতিরোধের জন্য মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।গবেষকরা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। তবে, সাধারণ মানুষও নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই পরিবর্তন অনুভব করছে। যদিও “জলবায়ু পরিবর্তন” শব্দটি অনেকের কাছে পরিচিত, তবুও অনেকেই এটিকে শুধুমাত্র “আবহাওয়ার পরিবর্তন” হিসেবে বোঝেন। উদাহরণস্বরূপ, শীতের সময়ে পর্যাপ্ত শীত অনুভূত না হওয়া, গ্রীষ্মে অস্বাভাবিক গরম পড়া, অথবা কৃষকদের প্রত্যাশিত সময়ে বৃষ্টি না হওয়া—এগুলো সাধারণ মানুষের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব চিত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে বৈশ্বিক কারণ যেমন কার্বন নিঃসরণ ও শিল্পায়ন রয়েছে, তবে স্থানীয় কিছু পরিবেশগত সমস্যাও এটি ত্বরান্বিত করছে। বৃক্ষহীনতা, নগরায়ণ, এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে। উদাহরণ হিসেবে, সিলেট শহরের গরম অনুভূতি এবং চা বাগান এলাকার ঠান্ডা অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। চা বাগানের ভেতরে প্রচুর গাছপালা থাকার কারণে তাপমাত্রা কম থাকে, কিন্তু শহরে যানবাহনের ধোঁয়া, এসি ব্যবহারের তাপ, এবং আলোকসজ্জার কারণে গরম বেড়ে যায়। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু বাস্তব প্রতিচিত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের স্থানান্তর (মাইগ্রেশন) দেখা যাচ্ছে। কিছু ইউরোপীয় দেশ থেকে মানুষ গ্রীষ্মের গরম এড়াতে শীতল অঞ্চলে চলে যায়। বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে লবণাক্ত পানি বিস্তার লাভ করবে, যা কৃষি ও মৎস্যসম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে, অনেক কৃষক চাষাবাদ ছেড়ে লবণ সহিষ্ণু চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া, জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা, এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থানান্তর বেড়ে গেছে। পানির অভাব, ফলনহীনতা, শিলাবৃষ্টি, এবং মৎস্যসম্পদের সংকটের কারণে সিলেট, চট্টগ্রাম, ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। ঢাকায় জীবনযাত্রার চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও অনেকে এখানে ভালো জীবনের আশায় চলে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, এবং ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এটি প্রতিরোধ ও অভিযোজনের জন্য ব্যক্তি, সমাজ, এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বৃক্ষরোপণ, টেকসই উন্নয়ন, এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা এই পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারি। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সচেতন হতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করা যায়।
আব্দুল হাই চৌধুরীঃ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি বা মাইগ্রেশন ঘটছে, তা কীভাবে দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে? বিশেষ করে হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে, এবং এর ফলে তারা কেন বাধ্য হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে? এই জলবায়ুজনিত মাইগ্রেশন আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে?
ড. জহিরুল হকঃ এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মাইগ্রেশন সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: ইকোনমিক ও নন-ইকোনমিক।
প্রথমত, ইকোনমিক মাইগ্রেশন সহজবোধ্য। উপকূলীয় ও হাওর অঞ্চলের মানুষ যখন জীবিকার সংকটে পড়ে, তারা বাধ্য হয়ে স্থানান্তরিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষ, যারা মূলত মাছ চাষ ও কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তাদের জীবিকা হারাচ্ছে। ফলস্বরূপ, তারা কর্মসংস্থানের সন্ধানে ঢাকা বা সিলেটের মতো শহরগুলোতে অভিবাসিত হচ্ছে। তবে, শহরে এসে তারা তাদের প্রথাগত পেশায় কাজ করতে না পারায় নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। শহরগুলোর ওপর অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হওয়ায় অবকাঠামো, সরকারি পরিষেবা ও নাগরিক সুবিধা সংকটের মুখে পড়ছে।
নন-ইকোনমিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাংস্কৃতিক ক্ষতি ও স্থানীয় জীবনযাত্রার পরিবর্তন। একসময় সুনামগঞ্জের মতো অঞ্চলগুলো ছিল সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, যেখানে মেলা, নদীসংলগ্ন কার্যক্রম এবং ঐতিহ্যবাহী সামাজিক বন্ধন দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু অভিবাসনের ফলে এসব ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। একইসঙ্গে, অভিবাসনের ফলে স্থানীয় সম্পদের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, যা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।
অধিকন্তু, কিছু ক্ষেত্রে অভিবাসন মানুষের জীবনযাত্রার অবনতি ঘটাচ্ছে। যেমন, কিছু অঞ্চলে অভিবাসনের ফলে বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নারীদের জীবিকা সংকট আরও গভীর হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আরও জটিল সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

আব্দুল হাই চৌধুরীঃ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের লোকজন যে চরমভাবে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে, সেটি আমরা সহজে দেখতে না পারলেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। আপনারা কীভাবে এর প্রভাব দেখছেন?
আব্দুল করিমঃ মাইগ্রেশন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়, যা পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয়। হাওর অঞ্চল থেকে মানুষ ক্রমশ সিলেট শহর বা ঢাকায় চলে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই মাইগ্রেশন কি সত্যিই হাওর অঞ্চলের জনসংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে? সঠিক উপাত্তের অভাবের কারণে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। জলবায়ু পরিবর্তন এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। হাওরের মানুষের ঐতিহ্যগত জীবনযাত্রা চাষাবাদ ও মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাছের উৎপাদন কমে গেছে এবং কৃষিকাজও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একইভাবে, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন টর্নেডো ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এসব বিপর্যয়ের ফলে অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়, পরে ফিরে গিয়ে দেখে তাদের সম্পদ ও আবাদী জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, মাইগ্রেশন শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঘটছে না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভূমির ব্যবহারের পরিবর্তন, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণও মানুষের স্থানান্তরের অন্যতম প্রভাবক। বিশ্বব্যাপীও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে—ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, সৌদি আরবে অপ্রত্যাশিত অতিবৃষ্টি, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিধস ইত্যাদি। এসব সংকট দুর্বল জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশ্বের শক্তিশালী দেশ বা সম্প্রদায় যখন দেখবে যে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তখন তারা বিকল্প সমাধানের পথ খুঁজবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা কীভাবে নেওয়া হবে এবং কত দ্রুত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
আব্দুল হাই চৌধুরীঃ প্রফেসর জহিরুল, আপনি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, হাওর, খাসিয়া পুঞ্জি, উপকূলীয় অঞ্চলগুলো এবং নদী ভাঙ্গন সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন, সে বিষয়ে আরও কিছু বিস্তারিত জানতে চাই। বিশেষ করে, নদী ভাঙ্গনের ফলে যে অন্তর্মুখী (ইন্টার্নাল) মাইগ্রেশন ঘটে, তা কীভাবে বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলছে? জামালপুরে এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় তিনি বলেছিলেন যে, তাঁকে ২২ বার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে নদী ভাঙ্গনের কারণে। আপনি কি এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ করবেন? আর, গ্লোবাল মাইগ্রেশন সম্পর্কেও আপনার বক্তব্যটি কি আরও একটু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে পারেন?
ড. জহিরুল হকঃ এখানে যে নদী ভাঙ্গন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের একটি পুরনো সমস্যা, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে এটি আরও প্রকট হয়েছে।বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ এবং এখানে বৃষ্টি ও হিমালয়ের পানি একত্রিত হয়, ফলে নদী ভাঙ্গন একটি প্রাচীন সমস্যা। তবে নদী ভাঙ্গন শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। মূলত নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে। একটি জরিপের ফল অনুযায়ী, বাংলাদেশে আগামী ১০-২০ বছরের মধ্যে প্রায় এক কোটি জলবায়ু শরণার্থী তৈরি হবে, যাদের অধিকাংশই নদী ভাঙ্গন বা উপকূলীয় অঞ্চলের কারণে ঢাকায় আসবে। এই শরণার্থীদের জীবন-জীবিকা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আপনি যে স্থান পরিবর্তন করার কথা বলেছেন, এটি অনেক মানুষের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যাদের ভূমি হারিয়ে যায় তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মাইগ্রেট করে। বাংলাদেশ ২০৫০ সালে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তাতে দেশের এক-চতুর্থাংশ অঞ্চল সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যাবে এবং নদী ভাঙ্গনের কারণে আরও অনেক মানুষ স্থানান্তরিত হবে। এখন গ্লোবাল মাইগ্রেশনের দিকে আসলে, পৃথিবীজুড়ে এমন পরিস্থিতি চলছে। ২০০৯ সালে যখন আমি মাস্টার্স করছিলাম, তখনও অনেক আলোচনা হয়েছিল যে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করা হচ্ছে, কিন্তু এর ফলে মানুষের মুভমেন্ট রোধ করা যাচ্ছে না। যে কথা বলছিলাম, তা হলো ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাইগ্রেশন আরও তীব্র হবে এবং এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো পৃথিবীতেই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তবে, যেহেতু আমরা জলবায়ু শরণার্থী নিয়ে কথা বলছি, এই ক্ষেত্রটি আইনগতভাবে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ, শরণার্থী হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত রয়েছে, যেমন ধর্ম, জাতি বা জাতিগত বৈশিষ্ট্যগত কারণে মানুষকে শিকার হতে হয়। বর্তমানে, নদী ভাঙ্গন বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে মাইগ্রেশন ঘটছে, তা প্রায় “ভিতরে স্থানান্তর” (Internal Displacement) হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, কারণ এসব মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের জন্মভূমি ত্যাগ করছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনের আওতায় তাদের আবেদন গ্রহণ করা কঠিন। এটি একটি বড় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা বিশ্বব্যাপী আরও গুরুত্ব পাবে।
আব্দুল হাই চৌধুরীঃ আমরা দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলে সৃষ্ট মাইগ্রেশন বিষয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছি। তবে, এখন প্রশ্ন হল আমরা কী করতে পারি? বাংলাদেশ সরকার কী পদক্ষেপ নেবে? বৈশ্বিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর কী ভূমিকা হবে? এই সমস্যার সমাধান কোথায়? আমাদের তো কোনো না কোনো সমাধান খুঁজতেই হবে।আব্দুল করিম সাহেব, আপনি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের জন্য কাজ করছেন, বিশেষত এই ধরণের সংকট মোকাবেলায়, এবং আপনার প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। আপনার মতে, আমাদের কী করতে হবে?
আব্দুল করিমঃ জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা আজ দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীজুড়ে উষ্ণতা বাড়ছে এবং এর জন্য মূলত উন্নত দেশগুলো দায়ী, কারণ তারা অতিরিক্ত ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি, উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ফসিল ফুয়েলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তবে এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের জন্য, আগে আমরা শুধু ক্ষতিপূরণের দাবি তুলতাম, তবে এখন সেটি আর যথেষ্ট নয়। ক্ষতিপূরণ পেলেও আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। তারা যদি একবার বা দুবার ক্ষতিপূরণ দেয়, তবে প্রতিবছর কীভাবে আমরা তা চাইব? প্রকৃত সমস্যা এখানেই, ক্ষতিপূরণ নয়, আমাদের মূল দাবি হল উন্নত বিশ্ব তাদের কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করুক, যা পৃথিবীজুড়ে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। যেহেতু তারা সহজে এটি বুঝবে না, আমাদেরও নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের নিজেদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন, আমাদের দেশের নদী, জলাশয়, বনভূমি ধ্বংসের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে। যদি আমরা নিজেদের দেশের পরিবেশ রক্ষা না করি, তাহলে আমরা কীভাবে অন্যদের কাছে দাবি করবো যে তারা নিজেদের পরিবেশ সুরক্ষা করবে? আমাদের অবশ্যই নিজেদের দেশের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে হবে, যাতে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবে এই বিষয়ে দাবি রাখতে পারি।
আব্দুল হাই চৌধুরীঃ খুব সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। প্রথমে আমাদের নিজেদের পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, নিজেদের মধ্যে শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তারপর অন্যদের কাছে কিছু দাবি তোলা উচিত। যদি আমরা নিজেদের পরিবেশের ক্ষতি করি, তবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করলে কোনো সমাধান আসবে না। ড. জাহিরুল হক, আপনার এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কী মতামত? আপনার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য কী হবে? আমরা কীভাবে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারি?
ড. জহিরুল হকঃ বর্তমান সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো অ্যাডাপটেশন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে সমস্যা সমূহ তৈরি হচ্ছে, যেমন নদীভাঙন, লবণাক্ত পানি ঢুকে যাওয়া, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ইত্যাদি, আমাদের সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। এজন্য আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো এলাকায় নদী ভাঙন বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ক্ষতি হয়, সেখানে আমাদের উচিত বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তাছাড়া, যেসব এলাকায় কৃষি জমি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে, সেখানকার মানুষের জন্য নতুন জীবিকার ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শুধু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নয়, আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। যদি আমরা প্রকৃতির ক্ষতি করি, বনভূমি ধ্বংস করি, নদী দূষণ করি, তা হলে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জীবনযাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই, আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং প্রকৃতির ক্ষতি না করা। যখন আমরা পরিবেশে ক্ষতি কমাতে সফল হবো, তখন আমাদের বক্তব্য বিশ্বমঞ্চে আরও গ্রহণযোগ্য হবে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবেলা করতে আমাদের দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, বরং পুরো সমাজের। একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে, কারণ এককভাবে কোনো সমাধান আসবে না।
আব্দুল হাই চৌধুরীঃ সম্মানিত দর্শকবৃন্দ, আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করছি। আর জনাব আব্দুল করিম এবং ড. জহিরুল হক সাহেব, এই আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করে আপনারা নিজেদের অমূল্য সময় ব্যয় করেছেন, এজন্য আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। অত্যন্ত মূল্যবান মতামত প্রদান এবং বিষয়টিকে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য nDicia-এর পক্ষ থেকে আপনাদেরকেও অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।