উন্নয়ন আলোচনা পর্ব-১৩

ndicia24

ফেব্রু ১৬, ২০২৫ | প্রকৃতি ও প্রতিবেশ

বায়ু দূষণঃ স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও প্রতিরোধ

এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (AIRD)লিমিটেড একটি গবেষণাধর্মী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণামূলক কাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েব পোর্টাল হলো nDicia (এনডিসিয়া), এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা ‘উন্নয়ন আলোচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতার (টকশো) আয়োজন করে থাকি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নলেজ ডকুমেন্টেশন। আমাদের আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্ট nDicia-এর ওয়েব পোর্টালে থাকবে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাটি nDicia-এর Youtube চ্যানেলে থাকবে। ভবিষ্যতে, এই আলোচনাগুলোকে সম্পাদনা করে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ বায়ু দূষণঃ স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও প্রতিরোধআলোচনায় অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং ড. মুহাম্মদ মাহবুব হোসেন, প্রফেসর, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিভাগ, স্কুল অফ ডেটা অ্যান্ড সায়েন্সেস, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিআলাপচারিতার সঞ্চালনায় ছিলেন জনাব মাসুদ সিদ্দিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (এআইআরডি) লিঃ। অনুষ্ঠানটি nDicia-এর ইউটিউব এবং ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিলো ৩০/০১/২০২৫ তারিখ রাত ৮ টা থেকে ৮:৪৫ মিনিট।

মাসুদ সিদ্দিক: বায়ুদূষণ বিষয়টা নিয়ে একটু প্রাথমিক ধারণা দেন

. মাহবুবঃ একচুয়ালি, বায়ুদূষণ অনেক জিনিস দিয়ে হয়। একটা হচ্ছে কেমিক্যাল, বিভিন্ন সাইজের কেমিক্যাল। সেটা ডক্টর আহমেদ কামরুজ্জামান ভালো বলতে পারবেন, ওইটা সম্পর্কে এতটা জানি না। আমি মাইক্রোবায়োলজিস্ট। আমি যেটা বুঝি, মাইক্রোবস একটা এয়ার পলিউশনের বড় কারণ। আমার এক স্টুডেন্ট, শাহরিন, যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ছিল, সে আমার সুপারভিশনে কাজ করে দেখেছে যে ঢাকা শহরের বাতাসে আমরা ইতোমধ্যে নয়টা প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া (যারা ডিজিজ সৃষ্টি করে) আইডেন্টিফাই করেছি। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। আমরা ব্যাকটেরিয়া ডিটেক্ট করতে পারি, কিন্তু ভাইরাস ডিটেক্ট করা অনেক কঠিন। তবে অনেক ভাইরাসও আছে। কোভিডের সময় আমরা দেখেছি, ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে। দেয়ার লট অফ থিংস!

মাসুদ সিদ্দিক: ডক্টর কামরুজ্জামান, আপনি একটু এয়ার পলিউশন নিয়ে কিছু বলুন।

. কামরুজ্জামান: বলা হয়ে থাকে, আমরা খাবার ছাড়া কয়েকদিন বাঁচতে পারি। পানি ছাড়াও কয়েক ঘণ্টা বা মোটামুটি কয়েকদিন বাঁচা যায়। কিন্তু নিশ্বাস ছাড়া আমরা কয়েক মিনিট বা কয়েক সেকেন্ডের বেশি বাঁচতে পারব না। বলা যায়, বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো বাতাস। কিন্তু এই বাতাস যদি বিশুদ্ধ না হয়, তাহলে সেটি বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। নির্মল বাতাস মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। আবার দূষিত বাতাস মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অতিমাত্রায় দূষিত বাতাসকে গ্যাস চেম্বারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করা হতো। তবে বর্তমান বিশ্বে অনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে বাতাস আজকে একটি গ্যাস চেম্বারে রূপ নিয়েছে, যাকে আমরা বায়ুদূষণ বলি। WHO বলছে, পৃথিবীর মাত্র ৫-১০% মানুষ নির্মল বাতাসে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর নির্দিষ্ট কিছু শহরে হয়তো নির্মল বাতাস পাওয়া যায়, কিন্তু বাকি ৯০% মানুষ কোনো না কোনোভাবে দূষিত বাতাস গ্রহণ করছে। আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাসের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকা শহরকে “দূষিত বায়ুর রাজধানী” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বায়ুদূষণের বিভিন্ন দিক রয়েছে, যা আমরা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করব।

মাসুদ সিদ্দিক: আপনি যে বলছিলেন নির্মল বায়ু, ঢাকা শহর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে এই মুহূর্তে কেমন অবস্থানে আছে?

. কামরুজ্জামান: এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের আপডেট আমার কাছে নেই। তবে সাধারণত, শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) আমরা প্রায়ই টপ ৫ দূষিত শহরের মধ্যে থাকি। এমনকি, কোনো কোনো দিনে এক নম্বরে উঠে আসার ঘটনাও ঘটে।

মাসুদ সিদ্দিক: পার্টিকুলেট ম্যাটার নিয়ে একটু বিস্তারিত বলুন, প্রফেসর মাহবুব?

. মাহবুব : পার্টিকুলেট ম্যাটার বিভিন্ন সাইজের হয়। এই বিষয়টা ডা. কামরুজ্জামান আরও ভালো বলতে পারতেন। সাধারণত, পিএম ১০, পিএম ২.৫, পিএম ০.১ – এই তিন ধরনের পার্টিকুলেট ম্যাটার বেশি আলোচনায় আসে। এর মধ্যে পিএম ২.৫ সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, এটি ফুসফুসে গিয়ে জমে এবং নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আমি জাপানে দেখেছি, শীতের সময় সেখানে বাতাস অনেক ক্লিন থাকে। কারণ, বরফ ধুলাবালি আটকে রাখে। তবে যেখানে স্যানিটেশন খারাপ, যেখানে প্রচুর ধুলোবালি থাকে, সেখানে পার্টিকুলেট ম্যাটার বেশি থাকে। কিছু পার্টিকুলেট ম্যাটার খুবই ক্ষতিকর হতে পারে। যেমন, কিছু কিছু লেড (সিসা) প্যারালাইসিস ঘটায়, আবার কিছু ক্যান্সার বা কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করে। পার্টিকুলেট ম্যাটার কমানোর জন্য আমাদের ইন্ডাস্ট্রির চিমনিগুলো উঁচু করা উচিত। এমন কিছু প্রোডাক্ট তৈরি করা ঠিক হবে না, যেগুলো বিপজ্জনক ফিউম (বিষাক্ত ধোঁয়া) তৈরি করে।

মাসুদ সিদ্দিক: নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, লেড এই ধরনের উপাদানগুলো সম্পর্কে জানতে চাই?

. কামরুজ্জামান: সাধারণত, আমরা চার ধরনের এয়ার পলিউট্যান্টকে চিহ্নিত করতে পারি।

১. পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM): এটি বিভিন্ন সাইজের হয় এবং যত ছোট হয়, তত বেশি ক্ষতিকর। বিশেষ করে, পিএম ২.৫ বেশি গুরুত্ব পায়, কারণ এটি সরাসরি শ্বাসনালিতে প্রবেশ করতে পারে।

২. নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx): এটি গাড়ির ধোঁয়া, শিল্প কারখানা এবং কয়লা পোড়ানো থেকে আসে। এটি ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

৩. সালফার অক্সাইড (SOx): এটি মূলত কয়লা ও ডিজেল পোড়ানোর ফলে তৈরি হয়। এটি এসিড রেইনের (অম্লবৃষ্টি) একটি প্রধান উপাদান।

৪. লেড (Pb): এটি ব্যাটারি, পুরনো পেইন্ট ও কিছু শিল্প প্রক্রিয়া থেকে আসে। লেড শরীরে প্রবেশ করলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর।

মাসুদ সিদ্দিক: আমরা হেলথ হেজার্ডের ক্ষেত্রেও আসবো, তার আগে মাইক্রোবস নিয়ে প্রফেসর মাহবুব যা বলছিলেন, আপনি আরেকটু যদি ব্যাখ্যা করেন?

. মাহবুব: যেমন, একটি উদাহরণ দেই টিউবারকুলোসিস (TB) বেশি হয় এমন দেশগুলোতে সাধারণত অপরিচ্ছন্নতা বেশি দেখা যায়। কারণ, ব্যাকটেরিয়া খুব ছোট জীব, এদের হাত-পা নেই, যা দিয়ে তারা নিজে নিজে চলাচল করতে পারে। তাই, ধুলোকণা বা বাতাসের মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ধুলার কারণে ব্যাকটেরিয়া বহন হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। টিউবারকুলোসিসের ক্ষেত্রে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। এর একটি প্রধান কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা। শুধু টিউবারকুলোসিসই নয়, অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসও ধুলাবালুর মাধ্যমে পরিবাহিত হতে পারে। তাই, আমাদের মনে রাখতে হবে “More dust, more microbes.” অর্থাৎ, যত বেশি ধুলাবালি থাকবে, তত বেশি মাইক্রোবস ছড়াবে। সুতরাং, যত পরিচ্ছন্ন থাকব, তত বায়ুবাহিত মাইক্রোবস কম থাকবে।

মাসুদ সিদ্দিক: সোর্সগুলো কী কী?

. কামরুজ্জামান: সোর্স বলতে বুঝায় যেসব উৎস থেকে মাইক্রোবস বা দূষণ ছড়ায়। যেমন,
1.আমরা যদি রাস্তায় খাবার ফেলে রাখি, তা পচে গিয়ে বিভিন্ন মাইক্রোবস জন্ম নিতে পারে।
2. বাংলাদেশে অনেক ক্লিনিক্যাল ওয়েস্ট সঠিকভাবে ডিসপোজ করা হয় না, ফলে সেখান থেকে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
3. ৯৫% ব্যাকটেরিয়া মানুষের জন্য উপকারী হলেও বাকি ৫% মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
4. অপরিষ্কার ডাস্টবিন, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা—এগুলোও দূষণের অন্যতম কারণ।
5. ইনডোর এয়ার পলিউশন: এসি ব্যবহারের ফলে ইনডোর পরিবেশে অনেক সময় প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়, যা নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে।
6. ফ্যান চালালে বাতাস চলাচল করে, ফলে মাইক্রোবিয়াল লোড কম থাকে। কিন্তু এসির মধ্যে বাতাস স্থির থাকায় সেখানে মাইক্রোবস জমে যেতে পারে।

মাসুদ সিদ্দিক: ইটভাটাসহ অন্যান্য সোর্সগুলো নিয়ে কিছু বলবেন?

. মাহবুব : যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা, কলকারখানা এসব থেকে নাইট্রিক অক্সাইড ও সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা বাতাসের মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করে।

  • লেড (সীসা) দূষণের কারণে ক্যান্সার ও পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) হতে পারে।
  • সালফার ডাই অক্সাইড থেকে এসিড রেইন হয়, যা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর।
  • ঢাকার মতো শহরে বায়ুদূষণের কারণে গাছ বেড়ে ওঠাও কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ পাতাগুলো দূষিত ধুলায় ঢেকে যায়, ফলে গাছের সঠিকভাবে ফটোসিন্থেসিস (আলোকসংশ্লেষণ) বাধাগ্রস্ত হয়।

. কামরুজ্জামান: বায়ুদূষণের উৎস এবং কারণ দুটো আলাদা করে বোঝা দরকার।

বাংলাদেশে প্রধান ছয়টি উৎস থেকে বায়ুদূষণ হয়: রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া, গৃহস্থালির রান্না ও বর্জ্য পোড়ানো, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ

এসব উৎস থেকে দূষণ বেড়ে যায় মূলত কিছু কারণের জন্য: অব্যবস্থাপনা (যেমন, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণের অভাব), দুর্বল আইন প্রয়োগ, রাসায়নিক কীটনাশক ও অনিয়ন্ত্রিত কৃষিপ্রযুক্তি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ

মাসুদ সিদ্দিক: বায়ুদূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি কী কী, এবং কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

. কামরুজ্জামান: বায়ুদূষণ তিনভাবে ক্ষতি করে মানুষ, প্রাণী, এবং উদ্ভিদের জন্য।

মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি: শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা (ফুসফুসের রোগ, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস), হৃদরোগ ও স্ট্রোক, অকালমৃত্যু

সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণি: শিশু, গর্ভবতী নারী, প্রবীণরা, যাদের আগেই শ্বাসতন্ত্রের রোগ রয়েছে (যেমন, অ্যাজমা) এইভাবে বায়ুদূষণ আমাদের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্যও বিপদজনক হয়ে উঠছে।

. মাহবুব: বিশ্বে যে পরিসংখ্যান আছে, তা যথেষ্ট নয়। আমার ধারণা, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না যে এটি এয়ার পলিউশনের কারণে। যেমন, কোভিডের কারণে যখন মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন সারা দুনিয়াতে আমাদের দেশে মোট ২৮ থেকে ৩০ হাজার মানুষ মারা গেছে দুই বছরে। কিন্তু এয়ার পলিউশনে আরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু এগুলো দৃশ্যমান না হওয়ায় আমরা সেভাবে রিপোর্ট করছি না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে যে, বাংলাদেশের মানুষের আয়ু শহরে গড়ে সাত বছর এবং গ্রামে পাঁচ থেকে ছয় বছর কমে যাচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। তাহলে উন্নয়ন দিয়ে আমরা কী করবো, যদি আমাদের আয়ু সাত বছর কমে যায়? এখন আমাদের কী করা উচিত? আমি বিভিন্ন জায়গায় বলি, বাংলাদেশকে পুরোপুরি পরিষ্কার করতে মাত্র সাত দিন লাগবে, যদি সরকার চায়। এতে বড় কোনো বাজেট লাগবে না। যার বাসার সামনে ময়লা থাকবে, তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। অফিসের সামনে ময়লা থাকলে একই জরিমানা হবে। এটি টিভিতে প্রচার করা হবে। এরকম কয়েকদিন করা হলে সবাই সব পরিষ্কার করে ফেলবে। এটি আসলে সরকারের একটি উদ্যোগ নিতে হবে, এবং আমার বিশ্বাস, জনগণও এ ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন করবে। এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আমাদের সমাধানের দিকে যেতে হবে। যেসব ইন্ডাস্ট্রি সবচেয়ে বেশি দূষণ করছে, তাদের জন্য বিকল্প জ্বালানি বা অন্য কোনো উপায়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। যেসব ইন্ডাস্ট্রি বেশি দূষণ করছে, সেগুলোতে দূষণকারী ফুয়েল নিষিদ্ধ করতে হবে এবং অন্য জ্বালানি ব্যবহার করতে বাধ্য করতে হবে। আরেকটি বিষয়, জাপানে আমি দেখেছি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকেলের ব্যবহার ছিল অনেক বেশি। শত শত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সাইকেল ব্যবহার করতেন। আমাদেরও এ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এমন যানবাহনকে উৎসাহিত করতে হবে, যা কোনো দূষণ সৃষ্টি করে না। আমি দেখেছি, জাপানে সাইকেল চালকদের কতটা সম্মান করা হয়। গাড়ি চালকেরা ধীরে চলেন, সাইকেলের জন্য পথ ছেড়ে দেন। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো চিত্র। রিকশা এ গলি দিয়ে যাবে না, ও গলি দিয়ে যাবে না, কিন্তু গাড়ির ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ ছাড়া, ট্রাফিক জ্যামের কারণেও অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। কয়েক বছর আগের হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। রাস্তাঘাটে দোকান কমানো, ট্রাফিক নিয়ম মানা এবং প্ল্যানিং উন্নত করা গেলে ট্রাফিক জ্যাম কমবে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো ইটের ভাটা। এগুলো থেকে ব্যাপক বায়ুদূষণ হয়। আমরা যদি বাধ্যতামূলক করি যে ব্লক ইট ব্যবহার করতে হবে, তাহলে এটি কমবে।

মাসুদ সিদ্দিক: এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়, সম্প্রতি আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। জ্বালানির মানোন্নয়ন এবং রিফাইনারির সক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। ড. কামরুজ্জামান, আপনি কি এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

ড. কামরুজ্জামান: জ্বালানি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা যে ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করছি, সেটিও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। আমাদের দেশে এখনও ইউরো ১ ও ২ স্ট্যান্ডার্ডের ইঞ্জিন ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে বিশ্বে এখন ইউরো ৪ ও ৫ চলছে। ২০২০-২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআরটিএ একটি গবেষণা করেছিল, যেখানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের এক-তৃতীয়াংশ যানবাহনেরই ফিটনেস নেই। এগুলোর বেশিরভাগই গণপরিবহন। অথচ, গণপরিবহনকে উন্নত করার কথা থাকলেও, আমরা এটি অবহেলা করছি। সরকার ২৫ বছরের পুরনো গাড়ি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপে সেটি বাতিল করতে হয়। যদিও সরকারের সদিচ্ছা আছে, কিন্তু বিভিন্ন বাধার কারণে দূষণকারী যানবাহন এখনও রাস্তায় চলছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের দেশে ডিজেলে সালফারের পরিমাণ ৫০ পিপিএমের বেশি হওয়া উচিত নয়, কিন্তু ২০২২ সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তে ২০০ পিপিএম পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়, যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ।

মাসুদ সিদ্দিক: এখন আমরা আসি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংক্রান্ত ও রিসার্চগুলো সম্পর্কে। এগুলো আমরা সাধারণ মানুষরা জানতে চাই।

ড. কামরুজ্জামান: বাংলাদেশে ১০০ বা ১১০টির কাছাকাছি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং ৬০টির কাছাকাছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সাহিত্যের কাছাকাছি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে বলা যায় যে ২৫ থেকে ৩০টিতে সরাসরি পরিবেশ বিজ্ঞান পড়ানো হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট কিছু সাবজেক্ট রয়েছে, যেখানে পরিবেশ বিজ্ঞানের কিছু কোর্স পড়ানো হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলামে আমরা খুব বেশি বায়ু দূষণকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না। হয়তো এক-দুই লাইনে কিছু উল্লেখ থাকে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে শহরগুলোতে অবস্থিত, সেগুলো প্রায় সবই বায়ু দূষণের শিকার। বাংলাদেশের এমন কোনো শহর নেই, যেখানে বায়ুর মান WHO-এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ভালো বলা যায়। চট্টগ্রামের বায়ু দূষণ আছে, কক্সবাজারেও আছে। অথচ কক্সবাজারের বায়ু দূষণ চট্টগ্রামের চেয়েও বেশি এটি গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে। কিন্তু কক্সবাজারের যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তাদের গবেষণা করে এই তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরার কথা ছিল। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ছিল পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা ও তথ্য প্রদান করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছে না বা কোনো সুপারিশও করছে না। তাই, আমাদের পরিবেশগত সমস্যাগুলো শুধুমাত্র পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং জাতীয় সমস্যা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং জনসাধারণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। দেশে ১০০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যদি গড়ে প্রতিটি জেলায় দুইটি করে বিশ্ববিদ্যালয় থাকে, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিবেশগত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় বের করার জন্য কাজ করতে হবে। আমরা এখনো পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছি, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ব্যর্থ হয়েছেন। মাহবুব ভাই যা বললেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম যদি এই সমস্যাটা অনুধাবন করতে পারে, তাহলে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা পুরনোরা তাদের সহায়তা করতে পারবো, কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য ও উপাত্ত তাদেরকেই সংগ্রহ করতে হবে। বায়ু দূষণের মতো মরণঘাতী সমস্যা বন্ধ করতে ছাত্র-শিক্ষক ও জনগণ সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।

মাসুদ সিদ্দিক: প্রফেসর মাহবুব, আপনি একটু যোগ করুন গবেষণা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে।

. মাহবুব: বায়ু দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নয়, এটি প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পড়ানো উচিত। যদিও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান নেই, কিন্তু শিক্ষকদের জ্ঞান রয়েছে। তাই অন্য ক্লাসেও বায়ু দূষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আমরা যদি এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের সাথে কাজ করতে না পারি, তাহলে এয়ার পলিউশন দূর করা সম্ভব নয়। প্রশাসন যদি ব্যবসায়ীদের সাথে আপস করে, তাহলে তারা কখনোই বায়ু দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আমরা মসজিদের ওজুর পানি নষ্ট করে ফেলি। অথচ এই পানি যদি রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে ধুলা কমত এবং ধুলা হলো বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। এই ধুলার সাথে বিভিন্ন জীবাণু ও দূষণকারী পদার্থ থাকে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া, ঢাকা শহরে পানির স্তর ভয়ানকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি চেন্নাইতে পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। আমাদেরও এখন থেকে পানি সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে। বেসিনের পানিগুলো পুনরায় ব্যবহার করার একটি ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার যদি এটি বাস্তবায়ন করে, তাহলে পানি সংরক্ষণের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—জনগণের সাথে সরকারের মন্ত্রীদের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। ফলে জনগণের সমস্যাগুলো তারা বুঝতে পারেন না বা বোঝার সুযোগ পান না। এটি আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

মাসুদ সিদ্দিকঃ আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ।

ফেসবুকে মন্তব‌্য করুন